
যন্ত্রদানব ট্রলিতে মৃত্যু থেমে নেই
জন্মভূমি রিপোর্ট : চলতি বর্ষাকালে ইটভাটাগুলোর উৎপাদন বন্ধ থাকলেও রূপসা উপজেলার বিভিন্ন সড়কে অবৈধ ট্রলির দৌরাত্ম্য থেমে নেই। বিভিন্ন স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণ কাজে ইট-বালু পরিবহণে ট্রলি ব্যবহার হচ্ছে। আনফিট বাহন ও অদক্ষ চালকদের বেপরোয়া গতির ট্রলির ধাক্কায় মানুষ মরছে। কয়েক মাস আগে অনুমোদনহীন ট্রলি চলাচল বন্ধে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি প্রতিবাদী কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছেন, তবুও যন্ত্রদানবের চলাচল বন্ধ হয়নি। অন্যদিকে, সেনেরবাজার টু কালিয়া সড়কের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে যানবাহনেরগতি রোধক তৈরি না করায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েই চলেছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়নের শোলপুর-যুগিহাটী বাদামতলা মাঠ সংলগ্ন সড়কে অবৈধ বাহন ট্রলির আঘাতে গাজী গোলাম মোস্তফা (৮০) নামে একজন গুরুতর জখম হয়েছিলেন। তিনি রাজধানী ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে টানা চারদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে বুধবার রাত সাড়ে ১০ টার দিকে মৃত্যুবরণ করেছেন। বৃহস্পতিবার বাদ আসর শোলপুর জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার সকালে মোস্তফা সেনের বাজার টু নড়াইল সড়কের বাদামতলা মাঠ সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ শোলপুর এলাকার একটি ইটভাটা থেকে ইটবাহী একটি ট্রলি তাকে ধাক্কা মারে। এতে তিনিমারাত্মক জখম হন। আহতের স্বজনেরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে খুলনা জেনারেল হাসপাতাল এবং পরবর্তীতে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
পুলিশ জানায়, অবৈধ বাহন ট্রলিটি এবং চালককে অঘটনের পরই পুলিশ আটক করেছিল। চালকের বয়স ১৬ বছর হওয়ায় সে আইনের সাথে সাংঘর্ষিক শিশু। তাই সমাজ সেবা কর্মকর্তার মাধ্যমে তাকে তার অভিভাভকদের জিম্মায় দেয়া হয়েছিল।
রূপসা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ শাহিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭ টার দিকে দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, এখন পর্যন্ত থানায় কেউ অভিযোগ জানাতে আসেন নি। ভিকটিম পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ প্রাপ্তি সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ যানবাহনগুলো বিভিন্ন কারখানা তথা গ্যারেজে তৈরি হয়। মিস্ত্রীরা যশোরের আর এন রোড, নগরীর শেখপাড়া এবং রাজধানী ঢাকা থেকে বিভিন্ন গাড়ীর পুরোনো যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করেন। কেনেন ট্রলারে অথবা ট্রাকটরের ব্যবহার করা ইঞ্জিন। এরপর তৈরি হয় এসব বাহন। আবার পাওয়ার টিলারের পেছনের অংশ ফেলে দিয়ে খোলা ট্রলি তৈরি হয়েছে।
রূপসা উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আশরাফুজ্জামান বাবুল দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, গত ৮ মার্চ অবৈধ যানবাহন বন্ধের দাবিতে সেনের বাজার ঘাট এলাকায় মানব বন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এরপর দাবি আদায়ের লক্ষে ১২ মার্চ সংবাদ সম্মেলন ও জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদাণ করা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে অনুমোদনহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়নি। চলতি বছর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ট্রলির ধাক্কায় এবং নিচে চাপা পড়ে আট জন মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন-চার জন।
সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ অনুসারে মোটরযানের ফিটনেস সনদ ব্যতীত বা মেয়াদ উত্তীর্ণ ফিটনেস সনদ ব্যবহার বা ফিটনেসের অনুপযোগী, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত রং পরিবর্তন করে জরাজীর্ন, বিবর্ণ বা পরিবেশ দুষণকারী কোনো মোটরযান চালনা অথবা চালনার অনুমতি প্রদাণ করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট আইনের ২৫ ধারার ওই বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
রূপসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কোহিনুর জাহান দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধেউপজেলা প্রশাসন জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার মাধ্যমে বিভিন্ন সময় অনুমোদনহীন ট্রলি আটক করার পাশাপাশি চালকদের অর্থদণ্ড করা হচ্ছে। গত আইন শৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ে সকাল ৮ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত ওইসব যানবাহনের বিরুদ্ধে কঠোর মনিটরিং চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। অভিযান চলমান রয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সেনেরবাজার টু কালিয়া সড়কের আশ-পাশে বেশ কয়েকটি খেলার মাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বাজার রয়েছে। এসব স্থান সংলগ্ন সড়কগুলোতে পর্যাপ্ত জনসমাগম হয়ে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ ওই সড়কটি দিয়ে প্রতিদিন রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়া উপজেলার পাশাপাশি পাশর্^বর্তী নড়াইল জেলার হাজারো মানুষ বিভিন্ন যানবাহনে চলাচল করেন। ভারী যানবাহন চলাচলের সংখ্যাও কম নয়। অবৈধ যানবাহনের দৌরাত্ম্যতো রয়েছেই। মোটর সাইকেল চালকেরা এবং ব্যাটারি চালিত ভ্যান চালকেরাও প্রায়ই বেপরোয়া গতিতে চলেন। ফলে ওই সড়কের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্পটে স্পিড ব্রেকার না থাকায় ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) খুলনা জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী এ কে এম আনিসুজ্জামান দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, স্পিড ব্রেকার নির্মানের ব্যাপারে মন্ত্রনালয়ের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। গ্রামীন জনপদে রাতের বেলা বিভিন্ন সড়কে অন্ধকার থাকায় স্পিড ব্রেকার ঝুঁকিপূর্ণ। তবে, এর পরিবর্তে র্যামবোন স্পিড নির্মাণ করার কার্যক্রম চলমান আছে। জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ের সুপারিশের প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় সড়কে একাধিক ছোট-ছোট খাদ বিশিষ্ট র্যামবোন স্পিড তৈরি করা হবে। যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন সড়কে গতি নিরোধক তৈরির ব্যাপারে বিশেষ বিবেচনার সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।