করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও রূপসা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মৎস্য ঘেরের পাড়ের জমিতে এবছর ব্যাপক শসার চাষ হয়েছে। গ্রামের রাস্তার পাশে বিস্তীর্ণ বিল জুড়ে শুধুই সবুজে ঘেরা শসা ক্ষেত। ঘেরের পাড়ে সারি সারি মাচায় ঝুলছে শসা আর শসা। আবহাওয়া অনুক‚লে থাকায় শসার বাম্পার ফলন হয়েছে এবং বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসির ঝিলিক। ক্ষেত থেকে শসা তুলে এনে স্থানীয় আড়তে ব্যবসায়ীদের কাছে ন্যায্যমূল্যে শসা বিক্রি করতে পেরে কৃষকরা অনেক খুশি।
রূপসা উপজেলার আনন্দনগর গ্রামের শসা চাষি নূরু শেখ বলেন, এবছর মৎস্য ঘেরের পাড়ে এক বিঘা জমিতে গ্রীন লাইন নামক হাইব্রিড জাতের শসা চাষ করেছি। এতে বীজ, সার, মাচা তৈরি, শ্রমিক ও কীটনাশক বাবদ প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ইতোমধ্যে ১শ’ মণ শসা (প্রতি মণ ৪ শ’ টাকা দরে) স্থানীয় আড়তে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। আরো প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার শসা বিক্রি করতে পারবো বলে আশা করছি। এ উপজেলার পুটিমারি গ্রামের কৃষক মিজান মুন্সি জানান, ঘেরের পাড়ে এক বিঘা জমিতে শসা চাষ করতে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ৪শ’ টাকা মণ দরে এপর্যন্ত ৭০ মণ শসা ২৮ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। এরকম দাম থাকলে আরো ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার শসা বিক্রি করতে পারবো বলে মনে করছি। মিজান মুন্সি আরো জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার শসার ফলন ভালো হয়েছে এবং দামও ভালো পাচ্ছি। কৃষকেরা বলেন, রূপসা উপজেলার আলাইপুর বøকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো: আবদুর রহমান করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও আমাদের পাশে থেকে শসা চাষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।
নুরু শেখ ও মিজান মুন্সি ছাড়াও আনন্দনগর গ্রামের আবুল হাসান, আল-আমিন, মোজাহিদ, ইকরাম, কালু, মাসুম, নোমান, হাবিব, টিপু, সহিদ, আজগার, জসিম, রিপন, ইমাম, নজরুল, সিরাজ, ইউসুফসহ শতাধিক কৃষক মৎস্য ঘেরের পাড়ে হাইব্রিড জাতের শসা চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। কৃষকরা জানান, শসা একটি লাভজনক ও অর্থকরী সবজি। বর্তমানে আমাদের দেশে হাইব্রিড জাতের অনেক শসা চাষ হয়ে থাকে। এ জাতের শসার ফলন অনেক বেশি। এটি স্বল্প সময়ের সবজি। জাতভেদে বীজ বপণের ৩৫-৪০ দিন পর থেকেই ফল তোলা যায়। ধানের তুলনায় শসা চাষে ২/৩ গুণ লাভ হয়। অল্প পুঁজিতে লাভ বেশি হওয়ায় মৎস্য ঘেরের পাড়ে শসা চাষ এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এলাকার কৃষকরা আরো বলেন, বসতবাড়ি কিংবা মাঠের চেয়ে ঘেরের পাড়ে শসা চাষ করে অধিক ফলন পাওয়া যায়। অন্য ফসলের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি লাভ হওয়ায় মৎস্য ঘেরের পাড়ে শসা চাষে ঝুঁকে পড়েছেন কৃষকেরা। ঘেরে শুধুমাত্র মাছ ও ধান চাষ করে একসময় যাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটত, ঘেরের পাড়ে শসা ও অন্যান্য শাক-সবজি চাষে এখন তাদের মুখে হাসি ফুটেছে।
রূপসা কৃষি অফিসের সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলার দুর্জ্জনীমহল, ডোমরা, চন্দনশ্রী, ভবানীপুর, পেয়ারা, জাবুসা, আমদাবাদ, দেবীপুর, নৈহাটী, সামন্তসেনা, তিলক, খাজাডাঙ্গা, স্বল্পবাহিরদিয়া, আলাইপুর, পুটিমারি, আনন্দনগর, পিঠাভোগ, গোয়ালবাড়িরচর, সিঁন্দুরডাঙ্গা, নারিকেলী চাঁদপুর, ডোবা, বলটি, নতুনদিয়া, ধোপাখোলা, গোয়াড়া, শিয়ালী, চাঁদপুর ও বামনডাঙ্গা গ্রামের মাছের ঘেরের পাড়ে প্রায় ২শ’ হেক্টর জমিতে এবছর শসা চাষ হয়েছে। তবে ঘাটভোগ ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে সবচেয়ে বেশি জমিতে শসা চাষ হয়েছে। ঘেরের পাড়ে শসা চাষ করে কম সময়ে অধিক ফলন ও ভালো দাম পেয়ে এসব গ্রামের কৃষকরা দারুণ খুশি। মূলত: ঘেরের পাড়ে শসা চাষ পাল্টে দিচ্ছে রূপসা উপজেলার অন্তত আঠাশ গ্রামের চিত্র।
ঘেরের পাড়ে উৎপাদিত শসা কেনা-বেচার জন্য গ্রামে গ্রামে গড়ে গড়ে উঠেছে শসার মওসুমি আড়ত। স্থানীয়ভাবে এ আড়তকে ‘গালা’ বলা হয়। তাই শসা বিক্রি করতে সাধারণত পরিবহন খরচ লাগে না। কৃষকেরা ক্ষেত থেকে শসা তুলে এনে আড়তে বিক্রি করেন। শসা চাষে মহিলা ও বেকার যুবকসহ স্কুল-কলেজের ছাত্রদেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে ট্রাকযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যাচ্ছে এখানকার শসা। স্থানীয় বাজারের ক্রেতারা টাটকা ও তাজা শসা কিনতে পেরে খুশি।
রূপসা উপজেলা কৃষি অফিসার মো: ফরিদুজ্জামান বলেন, অন্যান্য ফসলের তুলনায় মাছের ঘেরের পাড়ে শসা চাষ লাভজনক হওয়ায় এ উপজেলায় দিন দিন শসা চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘেরের পাড়ে কম খরচে শসা চাষ করে লাভবান হওয়ার জন্য এ উপজেলার প্রতিটি বøকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ চাষিদের পাশে থেকে সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। এছাড়া উপজেলা কৃষি অফিস থেকে এসব কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে। ফলশ্রæতিতে এবছর কৃষকেরা ঘেরের পাড়ে শসা চাষ করে আশাতীত ফলন পেয়ে লাভবান হয়েছেন। এতে কৃষকের মধ্যে ঘেরের পাড়ে শসা চাষে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। তারা আগামীতে মাছের ঘেরের পাড়ে আরও বেশি করে শসা চাষ করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।