জন্মভূমি ডেস্ক : তিন বছর ধরে দ্রুত বাড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়। দাম বাড়িয়েও আয়-ব্যয়ের বড় ঘাটতি পোষানো যাচ্ছে না। এতে লোকসান বাড়ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)। তবে সে ঘাটতির পুরোটা ভর্তুকি হিসেবে দিচ্ছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। শুধু বেসরকারি খাতের রেন্টাল ও আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) থেকে উচ্চ দামে বিদ্যুৎ কেনার ঘাটতি পূরণে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। অন্যান্য খাতে পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী মিলছে না ভর্তুকি। এতে লোকসান ও ভর্তুকির মধ্যে পার্থক্য বাড়ছে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রেন্টাল ও আইপিপির বিদ্যুতের দামের পার্থক্যের পুরোটা ভর্তুকি হিসেবে পাচ্ছে পিডিবি। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, আর্থিক খরচ (সুদের হার) বৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়নের জন্য পিডিবির নিজস্ব ও সরকারি অন্যান্য কোম্পানির বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে। বাড়তি ব্যয় সমন্বয়ের জন্য বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রয়োজন। এমনকি বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল ও ছয় শতাংশ অগ্রিম আয়করের অর্থও ভর্তুকি ছাড়ের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিচ্ছে না অর্থ মন্ত্রণালয়।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান ছিল ৫১ হাজার ৩০০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এ ঘাটতি পূরণে সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি দেয়া হবে ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। যদিও ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষ হতে চললেও গত অর্থবছরের ভর্তুকির পুরোটা ছাড় করেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে এ অর্থ মূলত বেসরকারি খাতে রেন্টাল ও আইপিপিগুলোর বিদ্যুৎ কেনায় ঘাটতি মেটাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারি ও পিডিবির কেন্দ্রগুলোর ঘাটতি মেটাতে কোনো ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে না।
এদিকে চলতি অর্থবছর আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লা ও জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস এবং বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে লোকসান কিছুটা কমবে বলেই ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে লোকসান দাঁড়াতে পারে ৪৪ হাজার ৬০৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। যদিও চলতি মাসে ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তনের কারণে লোকসান আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে আগের প্রাক্কলনের ভিত্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সর্বোচ্চ ৩২ হাজার ১২৩ কোটি ১০ লাখ টাকা ভর্তুকি পাওয়া যাবে, যা দিয়ে রেন্টাল ও আইপিপির বিদ্যুতের দামের ঘাটতি মেটানো হবে।
এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবি লোকসান গুনেছিল ৩২ হাজার ৮৯১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। ওই অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এ হিসাবে ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত তিন বছরে পিডিবির লোকসান দাঁড়াবে এক লাখ ২৮ হাজার ৮০০ কোটি ৮২ লাখ টাকা। তবে পিডিবি ভর্তুকি পাবে মোট এক লাখ এক হাজার ৩১৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন বছরেই লোকসান ও ভর্তুকির পার্থক্য দাঁড়াচ্ছে ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
যদিও এর আগের বছরগুলোয় লোকসানের অনুপাতেই ভর্তুকি দেয়া হতো। ২০১৯-২০ অর্থবছর পিডিবির লোকসান ছিল সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ও ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল সাত হাজার ৪৩৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। আর ২০২০-২১ অর্থবছর পিডিবির লোকসান ছিল ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ওই অর্থবছর ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল ১১ হাজার ৭৭৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ওই দুই অর্থবছর ১৯ হাজার ৯৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা লোকসানের বিপরীতে ভর্তুকি দেয়া হয় ১৯ হাজার ২১৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ লোকসানের চেয়ে বেশি ভর্তুকি পায় পিডিবি।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সাল থেকে বেশকিছু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয় সরকার। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হতো ডলারে। যদিও বর্তমানে কুইক রেন্টালের সংখ্যা কমে এসেছে। তবে বিদ্যমান কেন্দ্রগুলোকে ডলারেই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের পর বেসরকারি খাতে বড় বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়, যেগুলো আইপিপি নামে পরিচিত। এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ সরাসরি ডলারে পরিশোধ না করলেও ডলারের বিনিময় হার ধরে টাকায় পরিশোধ করতে হয়। ফলে টাকার অবমূল্যায়নে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ব্যয় বাড়ছে প্রতি বছর।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছয় শতাংশ অগ্রিম আয়কর। লোকসানি সংস্থা হলেও পিডিবির বাল্ক বিদ্যুৎ বিক্রির ওপর তিন বছর আগে ছয় শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর আরোপ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এটি বাতিলে বিদ্যুৎ বিভাগ কয়েক দফা চিঠি দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসায় প্রতি বছর বাড়ছে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা। পাশাপাশি ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিলও ডলারে পরিশোধ করতে হয়। আদানি যুক্ত হওয়ায় ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বেড়েছে। ফলে এ খাতে ব্যয়ও অনেক বেড়েছে।
পিডিবির গত ১৫ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পিডিবি লোকসান গুনেছে এক লাখ ৬০ হাজার ৯৬৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। তবে মাত্র শেষ দুই অর্থবছর ৮৪ হাজার ১৯১ কোটি ৬২ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে পিডিবি। অর্থাৎ ১৫ বছরে পিডিবির লোকসানের ৫২ দশমিক ৩০ শতাংশই ছিল ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে। আর ২০০৮-০৯ অর্থবছরের সঙ্গে তুলনা করলে ২০২২-২৩ অর্থবছর লোকসান প্রায় ৬১ গুণ বেড়েছে পিডিবির।
রেন্টাল-আইপিপির বিদ্যুতের লোকসান ও ভর্তুকির পার্থক্য বাড়ছে

Leave a comment