জন্মভূমি ডেস্ক : ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৭ নেতাকর্মী, যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে পঙ্গু হয়েছেন বা গুমের শিকার হয়েছেন, তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেছেন।
আজ রোববার (১৭ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ওই নেতাকর্মীরা নিজেদের উপস্থিতি থেকে অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগকারীরা হলেন— দেলোয়ার হোসেন মিশু, নুরুল আমিন, কামরুজ্জামান, মো. আলমগীর হোসেন (বগুড়ার শেরপুর), আব্দুল করিম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুরের মো. জনি ইসলাম এবং সাইফুল ইসলাম।
এছাড়া, মোট ৫৩ জনকে আসামি করা হয়েছে, তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অনেক সদস্যের নাম অভিযোগে এসেছে।
অবশ্য, অভিযোগের মধ্যে সরকার বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম আসেনি।
অভিযোগ- ১
মো. জনি ইসলাম। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শাখার কর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে টেবিলে বসে পড়াশোনা কারছিলেন। রাত ১১টার দিকে প্রশাসন, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ১৫/২০ জন বাড়িতে এসে, পড়ার টেবিল থেকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে তাড়াহুড়ো করে বিনোদপুর বাজারে অবস্থান করা গাড়িতে উঠিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। সেখান থেকে রাজপাড়া থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। আনুমানিক রাত ১২টার পর থেকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে চালানো হয় চরম বর্বরতা। তার হাতের কব্জি এবং পায়ের তালুতে চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাকে রক্তাক্ত করে ফেলা হয়। এরপর শুরু হয় আসল নাটক।
রাত দেড়টা থেকে ২টার পর, তাকে থানা থেকে বের করে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় দাঁত তলা নামক স্থানের একটি আম বাগানে। সেখানে গাড়ি থেকে নামিয়ে তার বাম পায়ে শটগান ঠেকিয়ে ৩টি রাউন্ড গুলি চালানো হয়। গুলির শব্দ শুনে এলাকাবাসী এগিয়ে এলে, দ্রুত তাকে গাড়িতে উঠিয়ে এবং আহত পায়ে পুলিশ উপর্যুপুরি আঘাত করতে থাকে। এরপর নিয়ে যাওয়া হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। হাসপাতালে দীর্ঘ সময় পড়ে থাকলেও, কোনো চিকিৎসা তারা নিতে দেয়নি। পরে তার বাবা জানতে পারেন, আহত অবস্থায় তিনি মেডিকেলে রয়েছেন।
খবর পেয়ে পরিবারের লোকজন হাসপাতালে যান। সে সময় তৎকালীন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডবলু সরকারও হাসপাতালে যান। তিনি চিকিৎসকদের নিষেধ করেন, যেন জনি ইসলামকে কোনো চিকিৎসা না দেওয়া হয়। পরে ওই অবস্থায় ৩ দিন অতিবাহিত হয়। চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় ক্রমেই জনির অবস্থা খারাপ হতে থাকে, একপর্যায়ে পুলিশ হেফাজতে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেও ৫ দিন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। ৬ষ্ঠ দিন তার পা পরীক্ষা করা হয়। ৭ম দিন তার পা থেকে ব্যাপক দুর্ঘন্ধ বের হতে থাকে। এরপর ডাক্তারের পরামর্শে তার পা কেটে ফেলা হয়। সেখান থেকে তাকে বন্দুক যুদ্ধের নামে নাটক সাজিয়ে, মামলা দায়ের করা হয়। এবং কারাগারে পাঠানো হয়। বর্তমানেন তিনি ২৫টি মামলা নিয়ে দিনাতীপাত করছেন।
অভিযোগ- ২
মো. আব্দুল করিম, বাঁশখালী থানা ইসলামী ছাত্রশিবিরের একজন কর্মী। ২০১৩ সালে ৩ মার্চ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদ এবং মুক্তির দাবিতে শেখেরখীল রাস্তার মাথা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে শান্তিপূর্ণ একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা আকস্মিকভাবে হামলা ও গুলি চালায়। একপর্যায়ে একটি বুলেট এসে তার মেরুদণ্ডে লাগে। প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পর ডাক্তার তাকে চট্টগ্রাম সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
কিন্তু প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের বাধার কারণে স্থলপথে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। উপায় না পেয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিবিরের নেতাকর্মীরা বঙ্গোপসাগরের জলপথে ট্রলার যোগে চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাসপাতালে পৌঁছায়। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক আপারগতা প্রকাশ করে এবং করিমের মেরুদণ্ড অকার্যকর ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তিনি ১১ বছর ধরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং সেটাই তার স্থায়ী নিবাস।
অভিযোগ- ৩
মো. আলমগীর হোসেন, ইসলামী ছাত্রশিবিরের জনশক্তি ছিলেন। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে মির্জাপুর বাজার থেকে শন্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিল শুরু হয়। এরমধ্যে পুলিশ, বিজিবি এবং আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা উপর্যপুরী হামলা ও গুলি চালাতে থাকে। এ সময় একটি বুলেট এসে তার ডান কানে লাগে। সে আহত অবস্থায় পড়ে গেলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে গাড়িতে উঠানোর সময় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পুলিশের কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে, তাদের হাতে থাকা দেশীয় এবং আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে থাকে।
একপর্যায়ে তাদের হাতে থাকা রামদা দিয়ে দুপায়ে কোপ দেয় এবং মাথায় হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করলে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারা তাকে মৃত ভেবে ৩০ ফুট উঁচু ব্রিজ থেকে ফেলে দিলে মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। জ্ঞান ফিরে এলে সে নিজেকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পায়। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়। এরপর পঙ্গু হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেন তিনি। বর্তমানে একটি বেসরকারি হাসপাতালে দীর্ঘ ১১ বছর ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বর্তমানে তাকে হুইল চেয়ার ভর করেই তাকে চলতে হয়।