
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে উপকূলীয় ১৮ জেলার ৯৩টি উপজেলা বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততার কবলে পড়েছে। দিন দিন উন্মুক্ত জলাধার কমে যাওয়ার কারণে তাপপ্রবাহ বাড়ছে। আর এর প্রভাবে মানুষসহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাণীকূল। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি, স্বাস্থ্য ও পানি খাত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় জাতীয়ভাবে সমন্বিত উদ্যোগ ও পরিকল্পনা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ খুব বেশি দায়ী না হলেও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় দিন দিন বাস্তুহীন ও গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি ফসল, মৎস্য উৎপাদন কমছে। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় খেটে খাওয়া মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশুস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। যে কোনো ধরনের নীতিমালা গ্রহণের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অভিমতকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় আনতে হবে। ভুক্তভোগী ও সংকটাপন্ন মানুষ কীভাবে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠবে বা কীভাবে ক্ষতিপূরণ পেতে পারে সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। সুস্থ্য জীবনযাপনের জন্য পরিবেশগত বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণ কমানো, বৃক্ষরাজি গড়ে তোলা, নদী-খাল, হাওর, বাঁওড়গুলোর পানিপ্রবাহ নিশ্চিত, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিশেষ করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন বন্ধ এবং ভূগর্ভস্থ পানির নির্ভরতা যথা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দেশি ও আন্তর্জাতিক আইন-নীতিমালাগুলোর সমন্বয় করতে হবে। সেইসঙ্গে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সচেতনভাবে এসব কাজে সম্পৃক্ত হতে হবে। ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সেটা যেমন আমরা জানি। তেমনি বিশ্ব নেতারাও জানে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে বাঁচতে ও সুরক্ষা পেতে নানা দিক নিয়ে ভাবছি, পরিকল্পনা করছি এবং সে অনুসারে কাজও করছি। তবে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা ৫৪টি নদীর ফয়সালা না হলে এর প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া বাস্তবিক অর্থে কঠিন। পানিপ্রবাহ না থাকায় নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। এক ফসলির জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন করায় পানি সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। কারণ উজানের পানি নেই। বাধ্য হয়ে সাগরের পানির ওপর ভরসা করায় লবণের মাত্রা বাড়ছে। সুন্দরবন সুরক্ষায় ঘষিয়াখালী খালের সুফল পাওয়া যাচ্ছে পুনঃখননের মাধ্যমে। ৫৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৩টি খাল খনন করার পরও পানি সংকটের সমাধান হচ্ছে না। নিয়মিত খনন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। উজানের পানি প্রবাহ আনতে ৫৪ নদীর সমাধান দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশি আছে কৃষি ও পানির ওপর। বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় মাছ চাষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে মাছের স্বাভাবিক উৎপাদনও বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ায় তাপমাত্রায় পরিবর্তন আসছে। মৌসুমি বৃষ্টি নিয়েও শঙ্কা বাড়ছে। লবণাক্ততা বাড়ছে। মিষ্টি পানির স্থলে লবণ পানি পৌঁছে গেছে। ফলে খাদ্য উৎপাদনের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যা উদ্বেগের বিষয়। সেইসঙ্গে মানব স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য নিরাময় ও অভিযোজনের ওপর জোর দিতে হবে। তবে আশঙ্কার কথা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কোনো তহবিল নেই। নিজস্ব উদ্যোগে পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি মানুষ থেকে আসে মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ। এটাই আমাদের জন্য প্রধান উদ্বেগের বিষয়। বায়ুমণ্ডলে কম কার্বন নিঃসরণ করতে হবে। পলিথিন উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণ বেশি হওয়ায় পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। দেশে ১০০ টন পলিথিন ব্যবহার হয়। যার ৫০ শতাংশ দেশে উৎপাদন হয়। বাকিটা বাইরে থেকে আসে। পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে অভিযান চলছে। জেল জরিমানা করা হচ্ছে। তবুও বন্ধ হচ্ছে না। দশমিক ৭ শতাংশ কার্বনডাই অক্সাইড মনুষ্য সৃষ্ট। এটা বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে সাধ্যমতো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশের নদী ও খালগুলো দিন দিন দখল হয়ে যাচ্ছে। বর্জ্য ও পলি অপসারণ করে খালের পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। এখন কেবল শহরেই নয়, গ্রামেও বাড়ি করতে হলে প্ল্যান নিতে হচ্ছে। এটা পরিকল্পিত উন্নয়নেরই অংশ। জলবায়ু পরিবর্তন ও শহরায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করে পদক্ষেপ নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিবর্তন মোকাবিলায় বাসযোগ্য শহরের পাশাপাশি পরিষ্কার নগর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দৃশ্যমান হচ্ছে। কেননা সেচের জন্য পানির অভাব দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে জলাবদ্ধতা, কৃষি শ্রমিক স্বল্পতা ও বেড়িবাঁধ সমস্যা তো রয়েই গেছে। নদী ও খাল খনন করাসহ স্লুইস গেট সংস্কার করা প্রয়োজন। খালের ইজারা মৎস্য চাষিদের দেয়ার কারণে কৃষক পানি পায় না। অথচ সরকার নামমাত্র রাজস্ব পায়। খালের পানি প্রবাহ গতিশীল থাকবে। জলাধার থাকতে হবে। জলাধার নেই বলেই তাপপ্রবাহ বাড়ছে। একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, প্রকৃতিকে বাঁধাগ্রস্ত করলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবে। ১৯৭৩ সালে জরিপে ৮ লাখ ৩৩ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা পাওয়া যায়। ২০০০ সালের জরিপে লবণাক্ততার মাত্রা ১ লাখ ২০ হাজার ৭৫০ হেক্টর। ২০০৯ সালের জরিপে লবণাক্ততা ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টর। ২০২১ সালের জরিপের ফলাফল আগামী নভেম্বরে প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ জমি লবণাক্ত হয়। ২০০০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত লবণাক্ত হয় ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ জমি। বৃষ্টি কমলে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। আগে আমন চাষের পর জমি পতিত থাকত। তবে আশার কথা হচ্ছে এখন ভুট্টা ও সূর্যমুখীসহ লবণসহিষ্ণু ধান চাষ হচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণা আর সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রণোদনা দেয়ার ফলে। প্রাকৃতিক কারণে আমাদের উপকূল লবণাক্ততার শিকার হচ্ছে। তবে আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের।
সাতক্ষীরা: লবণাক্ততায় পুড়ছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলের মাটি। এতে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্য। ব্যাহত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হওয়ায় উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিবারই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নতুন নতুন এলাকা নদীর লোনা পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। এতে মিষ্টি পানির পুকুরগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মাটির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে ফসল উৎপাদন। লবণের সঙ্গে যুদ্ধ করে মানুষকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। গাছপালা মরে মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে উপকূল।
বিশ্বব্যাংকের ‘রিভার স্যালাইনিটি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাভিডেন্স ফ্রম কোস্টাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের ১৯ জেলার ১৪৮টি থানার মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততায় আক্রান্ত হবে ১০টি নদীর পানি। এর মধ্যে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জ উপজেলার নদীগুলো উল্লেখযোগ্য। এসব এলাকায় এখনই ১০ পিপিটি মাত্রার লবণাক্ততা বিরাজ করছে। যা ২০৫০ সালের মধ্যে স্থানভেদে ১৫-২৫ মাত্রায় উন্নীত হতে পারে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কৃষক সিরাজুল ইসলাম জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তারা ফসল উৎপাদন করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, এমনিতে শ্যামনগরের পানি লোনা। তার ওপর প্রতিবছর বেড়িবাঁধ ভেঙে সবকিছু লোনা পানিতে ভেসে যায়। এ কারণে লবণাক্ততার মাত্রা বাড়ছে, কৃষি জমির পরিমাণ কমছে।
কৃষকদের এমন মন্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন কৃষিবিদরাও। তারা বলছেন, লবণাক্ততার কারণে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে দীর্ঘমেয়াদী।
এ বিষয়ে শ্যামনগরের কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা এই প্রতিবেদককে বলেন, প্রতিবছর শ্যামনগর উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়। সমস্যাটা শুধু প্লাবিত হওয়া নিয়ে নয়। একবার একটি উর্বর জমি লবণ পানিতে তলিয়ে গেলে, বৃষ্টিতে সেই লবণাক্ততা কাটাতে টানা দুই বছরের মতো সময় লাগে। কিন্তু লবণাক্ততা কাটতে না কাটতেই আবার প্লাবিত হয়। ফলে এখন এই অঞ্চলে ফসল কম হয়। বছরের পর বছর লবণ পানিতে তলিয়ে থাকায় জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি অফিসার নাজমুল হুদা‘মে ২০২১’ থেকে ‘মে ২০২২’ পর্যন্ত সময়কালের চিত্র তুলে ধরে বলেন, শ্যামনগর উপকূলীয় এলাকায় লবণের মাত্রা ৩ থেকে ৪ ডিএস/মিটার। যতদিন যাচ্ছে, লবণের মাত্রা আরও বাড়ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের পানির উচ্চতা বাড়ার ফলে লবণের মাত্রা ১৮ ডিএস/মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। যা মারাত্মক ক্ষতিকর। শুধু কৃষি-প্রাণবৈচিত্র্য নয়, লবণাক্ততায় ক্ষতি হয় মৎস্যচাষিদেরও।
এ প্রসঙ্গে শ্যামনগরের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য বলেন, মাটি একবার পানি থেকে লবণ গ্রহণ করলে সেই পানি মিষ্টি হতে প্রচুর সময় লাগে। এ সময়ে প্লাবিত হওয়া ঘের-পুকুর-জলাশয়ে মাছ চাষ করলে তাতে শতভাগ লোকসান হয়। মাছ প্রচুর খাবার খায় ঠিকই, কিন্তু লবণাক্ততার কারণে বড় হয় না।
তিনি বলেন, শ্যামনগর উপকূলের কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসহ পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায় লোনা পানির প্লাবন ঠেকাতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের আপাতত কোনো বিকল্প নেই।
এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনির পানি বরাবরই লোনা। আস্তে আস্তে কালিগঞ্জ উপজেলাকেও লবণাক্ততায় গ্রাস করছে। নদীর পানির উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লবণাক্ততায় গ্রাসকৃত এলাকার আওতা সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে প্রতিবছর একাধিক দুর্যোগে জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ ভেঙে উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা লোনা পানিতে প্লাবিত হওয়ায়। এতে মিষ্টি পানির আধারগুলো একেবারেই ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ছে। যার প্রভাব কৃষি, প্রাণবৈচিত্র্যসহ সরাসরি মানুষর জীবনে পড়ছে। জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। লবণাক্ততার আগ্রাসন কমাতে প্রাথমিকভাবে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণেই সরকারকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে সাতক্ষীরা উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।
আবহাওয়া ও জলবাযুর বিরূপ প্রভাবে উপকূলীয় এলাকার মাটি ও পানিতে দিন দিন বাড়ছে লবণাক্ততার পরিমাণ। এর ফলে মানুষের সুপেয় পানির যেমন অভাব দেখা দিচ্ছে, তেমনি কৃষি ও মৎস্য চাষ চরম হুমকির মুখে পড়ছে। লবণাক্ততার ছোবলে কৃষি-অর্থনীতি, জীবন-জীবিকাসহ অনেক ক্ষেত্রে ঘটছে নানামুখী সর্বনাশ। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনকে ‘রেড এলার্ট’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নতুন এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষের কর্মকান্ডের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে অপ্রত্যাশিত এবং অপরিবর্তনীয় উপায়ে। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে ঝুঁকিতে পড়বে কোটি কোটি মানুষ। ২১০০ সালের মধ্যে ভেসে যাবে উপকূল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যা প্রতিরোধে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার যেমন কমাতে হবে, তেমনি প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণও বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের উপকূলবর্তী প্রায় ৫৩ শতাংশ অঞ্চল লবণাক্ততা দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত। বর্তমানে দেশের উপক‚লবর্তী এলাকা ছাড়িয়ে এই লবণাক্ততা আক্রান্ত অঞ্চল ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দক্ষিণ-পূর্বে টেকনাফ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে খুলনা-সাতক্ষীরা পর্যন্ত ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দক্ষিণভাগে উপক‚লীয় তটরেখা ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের কোলে বিস্তীর্ণ চর-উপক‚ল-দ্বীপাঞ্চল। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, ল²ীপুর, চাঁদপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ ১৯টি উপক‚লীয় জেলার নদনদী খাল-বিল-খাঁড়ি, পুকুর-নলক‚পসহ পানির উৎসগুলোতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২৮.৬ লাখ হেক্টর উপক‚লীয় এলাকার মধ্যে ১০.৫৬ লাখ হেক্টর এলাকা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ত কবলিত। এই লবণাক্ততার কারণে শুকনো মৌসুমে বিশেষ করে রবি ও খরিফ-১ মৌসুমে ফসল চাষ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ সময়ে মাটির লবণাতক্ততা ৮.০ ডিএ/মি এর উপরে চলে যায়। এছাড়া এই সময়ে নদীর পানির লবণাক্ততা ২৫.০-৩০.০ ডিএস/মি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
লবণাক্ততা দিন দিন কৃষিজমি গিলে খাচ্ছে। জমি হারাচ্ছে উর্বরাশক্তি। ফল-ফসলের বর্ধন, ঘনত্ব বা নিবিড়তা এবং ফলন কমছে। খাদ্যনিরাপত্তা হচ্ছে বিঘিœত। দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার সমস্যা দীর্ঘদিনের। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কৃষি-খামার এমনকি জনস্বাস্থ্য। বিষিয়ে উঠেছে পরিবেশ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য। একবার জমি লোনাক্রান্ত হলে তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কঠিন। প্রায় ৪ কোটি উপক‚লবাসী কোনো না কোনোভাবে লোনার শিকার। উৎপাদনশীলতা কমছে সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় উপক‚লে। বেকার, স্থানান্তর ও পেশা বদল করছে মানুষ। প্রকট হচ্ছে দারিদ্র্য, আর্থ-সামাজিক সঙ্কট।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম এ প্রসঙ্গে ইনকিলাবকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বেড়ে যাচ্ছে। এরফলে অস্বাভাবিক সামুদ্রিক জোয়ারে নদ-নদী-খালের মিঠাপানি লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। মিঠাপানির মাছের বৃহত্তম প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীও লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। কৃষিজমি লোনাকবলিত হচ্ছে। লবণ ও চিংড়ি চাষে রূপান্তরিত হচ্ছে ব্যাপক কৃষিজমি। তাছাড়া পরিবেশ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্যের উপর পড়েছে বিরূপ প্রভাব। পরস্পর নির্ভরশীল জীবনচক্র ও খাদ্যশৃঙ্খল বিঘিœত হচ্ছে। অনেক প্রজাতির মাছসহ প্রাণিকূল, উদ্ভিদ বিলুপ্তির মুখে। লবণাক্ততার সমস্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুতর প্রভাবে পৃথিবী এবং সমুদ্র উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, কক্সবাজার উপক‚লে বছরে ৭ দশমিক ৮ মিলিমিটার হারে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। গত চার দশকে দ্বীপজেলা ভোলার প্রায় তিন হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা সমুদ্রের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের উপক‚লভাগে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে অস্বাভাবিক উঁচু জোয়ার এবং ছোট ছোট জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে ঘন ঘন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস সিডর, আইলা, আম্ফান, ইয়াসের আঘাতে অধিকাংশ উপক‚লীয় জেলা-উপজেলায় বেড়িবাঁধ কমবেশি বিধ্বস্ত। ভাঙাচোরা বেড়িবাঁধ দিয়ে অবাধে জোয়ারের পানি ঢুকে ডুবছে অনেক এলাকা। উপরের দিকে স্থলভাগে ছড়িয়ে পড়ছে সামুদ্রিক নোনা পানি এবং কৃষি-অকৃষি জমি ও লোকালয়ে আটকে যাচ্ছে। গ্রাস করছে মিঠা পানি বা স্বাদু পানির নদ-নদী-খালসহ পানির যাবতীয় উৎস। উপকূলে নদ-নদী-খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে নোনা পানির প্রসার ঘটছে দ্রæত। লবণাক্ত পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার ভূগর্ভস্থ পানিও লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। ফল-ফসলের চাষযোগ্য জমিতে লবণাক্ততার হার বেড়েই চলেছে। আবাদী জমির পরিমাণ কমছে, বাড়ছে পতিত জমি। ফলনও হ্রাস পাচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে সমগ্র কৃষি খাতে।
দেশের আবাদী জমির ৩০ ভাগ উপক‚লীয় এলাকায়। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) এবং লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের জরিপে জানা গেছে, ১৯৭৩ সালে দেশের উপক‚লীয় অঞ্চলে ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর লবণাক্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়। ২০০০ সালে লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ২০ হাজার ৭০০ হেক্টর। ২০০৯ সালের জরিপে লবণাক্ত জমি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টর। গত ৩৬ বছরে লবণাক্ত জমি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬ দশমিক ৭ ভাগ। এরমধ্যে গত ১০ বছরে বেড়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ।
গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী-খালগুলো প্রায় শুকিয়ে তলানিতে ঠেকে যায়। তখন উজানের দিক থেকে পানির স্বাভাবিক চাপ ও প্রবাহ থাকে না। অন্যদিকে নিয়মিত প্রবল সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে ভরে যায় উপক‚লের নদ-নদী, শাখানদী ও খাল-খাঁড়িগুলো। সমুদ্রের নোনাপানি স্থলভাগের দিকে এগিয়ে আসে। অনেক নিম্নাঞ্চলে নোনাপানি আটকে থাকে। এরফলে লবণাক্ততা বেড়ে যায়।
তাছাড়া পদ্মা নদীর উজানে গঙ্গায় ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ ও পানির প্রবাহ আটকে রাখার কারণে দক্ষিণ-পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় ভাটিতে অবস্থিত অনেকগুলো নদ-নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে পড়ে। এরফলে বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলে লবণাক্ততা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণাঞ্চল থেকে লবণাক্ততা বিস্তার লাভ করেছে ক্রমশ উজানভাগে যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বৃহত্তর কুমিল্লা-চাঁদপুরসহ উত্তর দিকে প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার পর্যন্ত। নোনার আগ্রাসন আরও উত্তর দিকে বিস্তারের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
চট্টগ্রাম শহরতলীতে অবস্থিত ‘মৎস্য ব্যাংক’ খ্যাত এশিয়ায় জোয়ার-ভাটানির্ভর মিঠাপানির রুই-কাতলাসহ বড় জাতের (কার্প) মাছের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষিত হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৮ পিপিটি (লবণাক্ততা পরিমাপক)। হালদা বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’র প্রভাবে প্রবল জোয়ারের সাথে হালদা নদীতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অতিমাত্রায় অনুপ্রবেশ ঘটে। এর বিরূপ প্রভাবে মিঠাপানির রুই-কাতলা মা-মাছরা এবার (২৬-২৭ মে) ডিম ছেড়েছে সাড়ে ৬ হাজার কেজি। অথচ আগের বছর ২০২০ সালে একযুগের রেকর্ড ভঙ্গ করে ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম মিলেছে।
লোনার আগ্রাসনে সমগ্র উপক‚লে কৃষিসহ সবক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব দৃশ্যমান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যশস্যের নিবিড়তার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে দক্ষিণাঞ্চল। দেশে ফসলের নিবিড়তা গড়ে ২শ’ ভাগ। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলে তা প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, লবণাক্ততার কবলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে কৃষি-খামার, প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য। তাছাড়া খাবারের জন্য মিঠাপানি এবং কৃষিজমিতে সেচের পানির সঙ্কট হবে আরও তীব্র। অনেক প্রজাতির মিঠাপানির মাছ বিলুপ্তির পথে, আরও প্রজাতি হারিয়ে যাবে। তবে ২০৫০ সালের কথা ওই প্রতিবেদনে বলা হলেও সঙ্কট আরো দ্রত হচ্ছে। মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) তথ্য মতে, দেশের উপক‚লীয় অঞ্চলে কৃষি-খামার ভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতিতে বর্তমানে বড় সমস্যার কারণগুলো হচ্ছে পানির উৎসগুলোতে এবং কৃষিজমিতে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা, লোনায় দীর্ঘ সময়ে পানিবদ্ধতা, সেচের পানিতে লবণাক্ততা। এতে করে অনাবাদী ও পতিত জমি বাড়ছে।
লবণাক্ততা কবলিত উপক‚লে রোগব্যাধির প্রকোপ বৃদ্ধি ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় বাংলাদেশের উপক‚লীয় এলাকায় ২০ শতাংশ প্রসূতি লবণাক্ততার কারণে অকাল গর্ভপাতের শিকার হচ্ছেন। গর্ভাবস্থায় অধিক মাত্রায় লবণাক্ত পানি পান করলে খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপ হয়। এ কারণে গর্ভাবস্থায় সন্তান মারা যাওয়ার হার বেশি। আইসিডিডিআরবি’র এক গবেষণায় বলা হয়েছে, লবণাক্ততার কারণে উপক‚লের মহিলারা অকাল গর্ভপাতের শিকার হচ্ছেন শুধু তাই নয়। একই কারণে তিন শতাংশ শিশু মারা যায়। তাছাড়া ডায়রিয়া, আমাশয়, হৃদরোগ, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি বেশিমাত্রায় লক্ষ্য করা যায় উপকূলীয় অঞ্চলে।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত