সিরাজুল ইসলাম শ্যামনগর : প্রতি বছরের মতো এবারও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২৪উদযাপন করছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘লবণাক্ততা রোধ করি, মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করি।’ পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যটি যথাযথ। দেশের মোট ১২টি জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী জমির পরিমাণ প্রায় ১.৫ মিলিয়ন হেক্টর। এসব এলাকায় কৃষকের প্রাণিসম্পদ ও জীবিকায়নের উপর জমির লবণাক্ততার ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। উপকূলবর্তী জমিগুলোর মাটিতে লবণাক্ততা তৈরি এক দিনে হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন সময়ে সুপার সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতির কারণে উপকূলবর্তী আবাদি জমিগুলো লবণাক্ততায় পরিণত হয়। অনেক সময় এসব জমি লবণাক্ত পানি দ্বারা জলাবদ্ধ থাকে। লবণাক্ততার কারণে প্রাণিসম্পদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় সবুজ ঘাসের উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। পতিত জমিগুলো লবণাক্ততার কারণে ঘাস উৎপাদন কমে যায়, সুুপেয় পানির অভাব হয়। এসব কারণে গো খাদ্যের সংকট তৈরি হয় যা, প্রাণিসম্পদের উৎপাদন ও পুনঃ উৎপাদন বৈশিষ্ট্যগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবউপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা সহনশীল জাতের ঘাস চাষের মাধ্যমে উন্নত জাতের গাভী পালন করা সম্ভব। এসব অঞ্চল, বিশেষ করে সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে ধানের জমি ও চারণ ভূমি শূন্যের কোটায় পৌঁছেছে এবং ঘাসের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা উত্তরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট ও দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিসিডিবি লবণাক্তসহনশীল দেশীয় ঘাস চিহ্নিতকরণ ও চাষ প্রণালী বিষয়ক গবেষণা সম্পন্ন করেছে।
গবেষণায় বাংলাদেশের স্যালাইন প্রবণ সাতক্ষীরা জেলার অধীনে গবাদিপ্রাণির সংখ্যা, দুধ উৎপাদন, প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ঘাস চিহ্নিতকরণ এবং এর ঋতুভিত্তিক প্রাপ্যতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব জানতে একটি জরিপ সম্পূর্ণ করা হয়েছিল। লবণাক্তপ্রবণ অঞ্চলের (সাতক্ষীরা) অধীনে দুটি উপজেলার তিনটি পৃথক গ্রাম নির্বাচন করা হয়েছে। যথাঃ জাউয়াখালী, শামনগর, নরারচোক, দেবহাটা এবং পূর্বপাড়া, দেবহাটা। গবেষণা চলাকালীন সেসব এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল। আইলার প্রবল জোয়ারে জমি তলিয়ে গিয়েছিল। আইলার সময় সাগর থেকে জোয়ারের পানি এসে মূল ভূমিকে ডুবিয়ে দেয়। ফলে মাটির লবণাক্ততা (১০-১৮ পিপিএম) বৃদ্ধি পেয়েছিল। লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে বেশির ভাগ ফলমূল গাছ, ফডার ও বনজ গাছ ধ্বংসের ফলে ফসল ও প্রাকৃতিক ঘাসের উৎপাদন কমে যায় যা গবাদিপ্রাণি উৎপাদন ও খামারির জীবিকায়নকে প্রভাবিত করে। অধিকন্তু, চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষের জমিতে লবণাক্ত পানির প্রবেশ করানোর ফলে, ফসল ও গবাদিপ্রাণির উৎপাদনের ঝুঁকি আরও বেশি তৈরি করেছে। পূর্বে কৃষকরা তাদের পতিত জমিগুলোতেও ধান কাটার পর আবাদি জমিতে প্রাণী চরাতো। কিন্তু এখন দিন দিন পতিত ও চাষযোগ্য জমি চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এই অবস্থার কারণে এলাকায় প্রাণিখাদ্য ও চারণ ভূমির অভাব দেখা দেয়।
দুই-তিন দশক আগে, কৃষকরা জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রাকৃতিক চারণ ভূমিতে বা পতিত জমিতে প্রাণী চরাতো এবং বাকি ছয় মাস গবাদিপ্রাণি বাসাবাড়িতে আবদ্ধভাবে পালন করত। কিন্তু এই সময়ে কৃষকরা তাদের গবাদিপ্রাণির জন্য শুধু খড় এবং তুষ সরবরাহ করে যা স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়। পূর্বে এখানে প্রচুর পরিমাণে গোখাদ্য ও গবাদিপ্রাণীর জন্য প্রাকৃতিক ঘাসের আধিক্য ছিল। ক্ষেত থেকেই প্রাণি প্রয়োজনীয় খাদ্য খেয়ে খামারে ফেরত আসত। তিন দশক আগে কেউ উচ্চফলনশীল (HYV) সবুজ ঘাস চাষ করেনি, কিন্তু এখন তারা সবুজ ঘাস চাষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। আইলার আগে, এলাকায় প্রাকৃতিক সবুজ ঘাসের অভাব ছিল না। পুকুর/বিলে বিভিন্ন ধরনের দেশি ঘাস জন্মাতো। আগে এ এলাকায় ধান চাষ হলেও এখন নোনা পানির পাশাপাশি মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ফসল চাষে আগ্রহ কমে গেছে। তাই মানুষ এই জমিতে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ করছে। গবাদিপ্রাণি এই লবণাক্ত পানি খায় না। সুদূর থেকে পানি এনে খাওয়ানো হয়। এসব পরিস্থিতি গবাদিপ্রাণীর পানীয় জলের পাশাপাশি সবুজ ঘাস ও গোখাদ্যের সংকট তৈরি করেছে। অনেক দূর থেকে খাদ্য বহনও ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এসব কিছুই বদলে দিয়েছে কৃষকদের ঐতিহ্যবাহী প্রচলিত জীবিকায়ন পদ্ধতি।
গবেষণায় দেখা যায় যে, বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় ঘাস যেমন : দূর্বা, তেলি সাপনা, নোনা সাপনা, খুদ গেটি/খুদ কাছড়া এবং বাকসা ইত্যাদি বছরের সবসময় পাওয়া যেত কিন্তু অধিকতর পর্যবেক্ষণ অনুসারে নোনা সাপনা, তেলি সাপনা এবং বাকসা তুলনামূলক বেশি পাওয়া যেত। প্রাকৃতিক ঘাসের অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় এই তিনটি প্রাকৃতিক ঘাস এই এলাকায় বেশি উপযোগী ছিল। অনেক খামারি অধিকভাবে অভিযোজিত নোনা সাপনা ঘাস গবাদিপ্রাণির জন্য চাষ করছিল। গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, মোট শুষ্ক খাদ্য গ্রহণ (কেজি/প্রাণী/দিন), দুধ উৎপাদন (লিটার/প্রাণী/দিন), মোট মিথেন নির্গমন (গ্রাম/প্রাণী/দিন) এবং প্রতি ইউনিট দুধের জন্য মিথেন উৎপাদন (গ্রাম) ছিল যথাক্রমে ৪.৪৩±০.২০, ১.৮৩±০.১১, ১৫৩.৩৫±৭.১৪ এবং ৮৭.৫৮±৫.৯৭। ২-৩ দশক আগে মোট ৯১% কৃষক দেশি জাতের গবাদিপ্রাণি পালন করত কিন্তু কৃষকদের ২৭% এখন সংকর দুগ্ধজাত গবাদিপ্রাণি পালন করছে। ২-৩ দশক আগের তুলনায় বর্তমানে ৩৭ শতাংশ প্রাণী এবং ৫৩৯ শতাংশ দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান এবং ২-৩ দশক আগে প্রাণী পালের গড় আকার (প্রাণীর সংখ্যা/বসতবাড়ি) এবং দুধ উৎপাদন (কেজি/বসতবাড়ি) যথাক্রমে ছিল ৫.০২±৪.৯২ ও ৭.১১±৩.৬৩ (p=০.০৫২); ৩.২৩± ৩.১৪ ও ২০.৬৫±১১.৩৯ (p=০.০০০)। সুতরাং গবেষণায় প্রমাণিত যে, গবাদিপ্রাণি উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ছিল এবং কৃষকরা প্রাণিসম্পদ প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে ঝুঁকি প্রশমন কৌশল গ্রহণ করেছিল।
লবণাক্ততা সহনশীল দেশীয় জাতের ঘাস চাষ প্রযুক্তিদুধালো গাভীর লালন-পালনের জন্য ঘাস চাষ অপরিহার্য। কিন্তু বছরের সবসময় ও সবজায়গায় প্রয়োজনীয় ঘাসের সংকট রয়েছে। ঘাস উৎপাদন সাধারণত ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ুর ওপর নির্ভর করে। তাই জলবায়ু উপযোগী ঘাস চাষের মাধ্যমে দেশের সকল জলবায়ু ভঙ্গুর (Climatic vulnerable) এলাকায় ঘাস চাষ সম্ভব। যার মাধ্যমে এসব এলাকায় দুগ্ধ খামার গড়ে তুলে কর্মসংস্থান ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে।
উপরোক্ত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখা যায় যে, নোনা সাপনা, তেলি সাপনা ও বাকসা বছরের সকল সময় পাওয়া গেলেও স্থানীয় কৃষক ও খামারিদের তথ্য মতে নোনা সাপনা ঘাসটি অধিকভাবে স্থানীয় পরিবেশে অভিযোজিত (এডাপ্টেড), তাই তারা এই ঘাসটি তাদের গবাদিপ্রাণির জন্য চাষ করে থাকেন এবং মাঝে মধ্যে পার্শ্ববর্তী খামারির কাছে বিক্রিও করে থাকেন। উক্ত গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে লবণাক্ততাসহনশীল ঘাস ‘নোনা সাপনা (Panicum sp)’ চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খামারির অভিজ্ঞতা ও মাঠ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ঘাসটির চাষ প্রণালী নিম্নে উপস্থাপিত হলো।
নোনা সাপনা ঘাসের বৈশিষ্ট্য : ঘাসগুলো দ্রুত বর্ধনশীল। একবার লাগালে ৩-৪ বছর পর্যন্ত ঘাস উৎপাদন করা যায়। বছরের যেকোনো সময় কাটিং নেয়া যায়। তাই বছরে ৮-১০ বার ঘাস কাটা যায়। লবণাক্ত পানিতে ও পুকুর পাড়/ঘেরের আইলে ভালো হয়। আগাছা দমনের প্রয়োজন হয় না। প্রতি কাটিং এর ৪০-৬০ দিন পর আবার কাটা যায়।
চাষ প্রণালী : বছরের সকল সময় নোনা সাপনা জাতের ঘাস চাষ করা সম্ভব। তবে বর্ষার সময় এর বৃদ্ধি বেশি হয়। এ জাতের ঘাস ডাল বা মুথা থেকে হয়ে থাকে। প্রতি হেক্টরের জন্য ২০-২২ হাজার ডাল বা মুথা ৪৫০ বাঁকা করে লাগালে ভালো ফলন পাওয়া যায়। প্রতিটি মুখার বা ডালের দূরত্ব ৩০-৩৫ সেমি. এবং লাইন হতে লাইনের দূরত্ব ৬০-৭০ সেমি. হতে হবে। জমি বা ঘেরের আইলে এ জাতের ঘাস চাষ করা যায়। প্রথম চাষের পর গোবর সার প্রয়োগ করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে এবং প্রতি শতাংশে ইউরিয়া ৮০০ গ্রাম, ফসফেট (TSP) ৬০০ গ্রাম এবং পটাশ (MOP) ৪০০ গ্রাম সার প্রয়োগ করতে হবে। জমি সম্পূর্ণ প্রস্তুতের পরে কাটিং সংগ্রহ করতে হবে এবং উপরোক্ত পদ্ধতিতে লাগাতে হবে। ঘাস লাগানোর ৫০-৬০ দিন পর প্রথম কাটিং সংগ্রহ করা যাবে। এই ভাবে প্রতি কাটিং এর ৭-১০ দিন পর সার প্রয়োগ করলে ঘাসের ফলন ভালো পাওয়া যাবে। প্রতি কাটিংয়ের ৪০-৬০ দিন পর আবার এ জাতের ঘাস কাটা যায়।
দুগ্ধ ও ঘাস উৎপাদনে খামারিরা প্রচলিত জ্ঞান এবং উন্নত প্রযুক্তি অবলম্বন করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমিয়ে এনেছে। উপরোক্ত পদ্ধতিতে উপকূলীয় খামারিগণ লবণাক্ততা সহনশীল জাতের নোনা সাপনা ঘাস বছরব্যাপী চাষ করতে পারে। ফলশ্রুতিতে বছরব্যাপী গবাদিপ্রাণিকে কাঁচাঘাস সরবরাহের মাধ্যমে দুগ্ধবতী গাভীর দুধ উৎপাদন ৬০-৬৫% বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাছাড়া উন্নত পুষ্টির গ্রহণের মাধ্যমে, প্রাণী থেকে মিথেন নিঃসরণের হার কম হবে, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রশমিত করবে। উল্লেখিত ঘাস চাষ প্রণালী ও উৎপাদনের উপর ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। কৌলিক গবেষণার মাধ্যমে এর ফলন বৃদ্ধি করে লবণাক্ত সহনশীল দেশীয় নতুন সবুজ ঘাসের জাত উদ্ভাবিত হলে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাণিসম্পদ উৎপাদনের নতুন দিগন্ত তৈরি হবে।
লবণাক্তপ্রবণ এলাকায় প্রাণিখাদ্যে ও দুগ্ধ উৎপাদনে নোনা সাপনা ঘাসের চাষপ্রযুক্তি

Leave a comment