সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল-হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়াল-মুলক, লা শারীকা লাক’- অর্থাৎ উপস্থিত ‘হে আমার আল্লাহ, উপস্থিত। উপস্থিত, তোমার কোনো অংশীদার নেই, উপস্থিত। নিশ্চয় সকল প্রশংসা ও নিয়ামত তোমার এবং রাজত্ব, তোমার কোনো অংশীদার নেই’- এ তালবিয়াহ উচ্চারণ ও মহান আল্লাহ তা‘আলার এককত্ব ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণায় আকাশ-বাতাস মুখর করে ২০ লক্ষাধিক হজযাত্রী আজ মানব জাতির আদি পিতা আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.)-এর পৃথিবীতে প্রথম সাক্ষাতস্থল এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিদায় হজ্জের স্মৃতিবিজড়ি আরাফাত ময়দানে সমবেত হবেন।
আজ পবিত্র হজ। শ্বেতশুভ্র পোশাকে আবৃত এসব হজযাত্রী জাবালে রহমতের পাদদেশ ও মসজিদে নামিরার আশপাশে অবস্থান নিয়ে জীবনের পরম কাক্সিক্ষত হজ পালন করবেন। মূলত এ দিনটির জন্যই পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন সক্ষম মুসলিমরা। জান্নাত থেকে বিতাড়িত বাবা আদম ও মা হাওয়া আলাইহিমাস সালাম পৃথিবীতে দীর্ঘদিন একাকি ঘুরতে ঘুরতে এ আরাফাতের ময়দানে এসেই মিলিত হন। ‘রব্বানা যালামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফির লানা লানাকুন্না মিনাল খসিরিসন- এ দোয়া পড়ার পর আল্লাহ তা‘আলা তাদের ক্ষমা করেন এবং দু’জনের মিলন ঘটান। তাদের মিলনের স্মৃতিকে অমøান করে রাখতেই আজ পৃথিবীর মুসলিমের এই মিলনমেলা প্রতি বছরই একবার করে দৃশ্যমান হয়।
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার স্ত্রী-পুত্রকে জনমানব ও খাদ্যপানীয় বিহীন মরুপ্রান্তরে ছেড়ে যাওয়ার সময় দো‘আ করেছিলেন, ‘সুতরাং মানবের মধ্য থেকে একদলকে এর দিকে ধাবিত করে দাও এবং তাদেরকে ফলফলাদি দ্বারা আহার যোগাও’। এ দোয়ার প্রতিফলন দেখা যায় পবিত্র হজে। সমগ্র বিশ্বের মুসলিমরা পাগলপারা হয়ে ছুটে আসেন সউদী আরবের মক্কা নগরীর পানে। তাদের একটাই চাওয়া আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্টি ও তার ক্ষমা।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত হজযাত্রীর সংখ্যা ১৪ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে বাংলাদেশি হজযাত্রীর সংখ্যা ৮৬ হাজার ৯৫৮ জন। বাংলাদেশি হজযাত্রীদের হজ ব্যবস্থাপনা মনিটরিং দলের দলনেতা ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন এবং ধর্মসচিব একেএম আফতাব হোসেন প্রামানিকও হজের আনুষ্ঠানিকতায় রয়েছেন।
গতরাতেই অধিকাংশ হজযাত্রীকে মোয়াল্লিমরা গাড়িতে করে নিয়ে আসেন আরাফাতে নির্ধারিত তাঁদের তাঁবুতে। অনেকে আজ সকালেও আসবেন। তাদের সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে হবে। এটাই মূলত হজ। আল্লাহর নবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল-হাজ্জু আরাফাহ’। অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই হচ্ছে হজ। এখানে হজযাত্রীদের ফজর ছাড়াও যোহর ও আসর নামাজ আদায় করতে হবে।
আরাফাত প্রান্তরে অবস্থিত মসজিদে নামিরায় আজ পবিত্র হজের খুতবা দেবেন পবিত্র মসজিদুল হারামের ইমাম ও খতিব শায়খ ড. সালেহ বিন হুমাইদ। ২০ লাখেরও বেশি হাজির উদ্দেশে তিনি হজের খুতবা পেশ করবেন। মক্কা ও মদিনার পবিত্র দুই মসজিদের তত্ত্বাবধানকারী জেনারেল প্রেসিডেন্সি বিভাগ জানায়, এ বছর আরাফার ময়দান থেকে প্রচারিত হজের খুতবার অনুবাদ প্রচারিত হবে বিশ্বের ২০টি ভাষায়। খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের তত্ত্বাবধায়নে এটিই এখন পর্যন্ত হজের খুতবা অনুবাদের সবথেকে বড় প্রজেক্ট। ২০টি ভাষার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা, ফরাসি, ইংরেজি, ফার্সি, উর্দু, হাউসা, রুশ, তুর্কি, পাঞ্জাবি, চীনা, জার্মান, সুইডিশ, ইতালিয়ান, মালায়ালাম, বসনিয়ান, ফিলিপিনো, মালয়, সোয়াহিলি, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ এবং আমহারিক ইত্যাদি। আর এ অনুবাদ খুতবা চলাকালীন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের অন্তত একশ’ কোটি মানুষ সরাসরি শুনতে পাবেন। আজ হজের খুতবার বাংলা অনুবাদের দায়িত্বে থাকবেন সউদী আরবে অধ্যয়নরত বাংলাদেশের চার শিক্ষার্থী। তারা হলেন– ড. খলীলুর রহমান, আ ফ ম ওয়াহিদুর রহমান মাক্কী, মুবিনুর রহমান ফারুক ও নাজমুস সাকিব। গত দুই বছরও এই চার বাংলাদেশি হজের খুতবার অনুবাদের দায়িত্বে ছিল।
হজের আরবি খুতবাটি মানারাতুল হারামাইন ওয়েবসাইট (যঃঃঢ়ং://সধহধৎধঃধষযধৎধসধরহ.মড়া.ংধ/) ও তাদের মোবাইল অ্যাপে শোনা যাবে। এ ছাড়া বাংলায় হজের খুতবা শোনা যাবে মানারাতুল হারামাইন ওয়েবসাইট ও তাদের মোবাইল অ্যাপে।
আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থানের মাধ্যমে হজ আদায় করবেন ২০ লক্ষাধিক ভাগ্যবান। সেখানে তারা মহান আল্লাহর কাছে কাকুতি মিনতি করে জীবনের সব গুনাহের ক্ষমা চাইবেন। এজন্য মোয়াল্লিমদের পক্ষ থেকে হাজী সাহেবদের বিভিন্ন কর্ণারে গিয়ে একা একা দোয়া করার আহ্বান জানানো হয়। বিশাল তাঁবুতে হজযাত্রীদের অধিকাংশই মোয়াল্লিমের তত্ত্বাবধানে যোহর আসর নামাজ আদায়সহ তাদের বিভিন্ন অপরাধের কথা স্মরণ করে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইবেন। এখানে গুনাহ মাফ না হলে তার চেয়ে দুর্ভাগা পৃথিবীতে একটিও থাকবে না। আর গুনাহ মাফের মাধ্যমে তারা হয়ে উঠবেন বেগুনাহ বা মাসুম।
সূর্যাস্তের সাথে সাথে মাগরিব না আদায় করেই হাজী সাহেবদের যাত্রা শুরু হবে মুযদালিফার উদ্দেশ্যে। সেখানে যাওয়া মাত্র মাগরিব ও এশা এক আজানে, দুই ইকামাতে আদায় করবেন তারা। এরপর মুযদালিফায় মসজিদে মাশআরিল হারামের আশপাশে উন্মুক্ত আকাশের নিচে মাথা খোলা অবস্থায় রাত্রীযাপন করবেন হজযাত্রীরা। পরের দিনগুলোতে জামারাতে নিক্ষেপের জন্য এখান থেকেই পাথর সংগ্রহ করেন হজযাত্রীরা। এজন্য বিশেষ ধরনের ছোট ছোট পাথর ছড়িয়ে রাখা হয় পুরো মুযদালিফাজুড়ে।
১০ যিলহজ সূর্যোদয়ের পর আবার মিনায় ফিরে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পূর্বে বড় জামারাতে ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ, কুরবানী সম্পন্ন করার পর মাথা মু-ন করে ইহরাম পরিত্যাগ করবেন হাজী সাহেবরা। সুযোগ বুঝে মক্কায় গিয়ে ফরজ তাওয়াফ করতে হবে ৩ দিনের মধ্যে। ১১ ও ১২ যিলহজও হাজী সাহেবদের সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পর ৩টি জামারাতে ৭টি করে মোট ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। যারা সংক্ষেপ করতে চান ১২ যিলহজ সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করবেন। নইলে ১৩ যিলহজ সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পর আবারও ৩টি জামারাতে ৭টি করে ২১টি কঙ্কর মেরে মিনা ত্যাগ করতে হবে।
পরিশেষে মক্কায় ফিরে বিদায়ের দিন বিদায়ী তাওয়াফের পূর্ব পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে প্রতি ওয়াক্তের নামাজ ও যত বেশি সম্ভব তাওয়াফে সময় কাটাবেন হাজী সাহেবরা। আল্লাহ তা‘আলা সকলকে সহীহ তরিকায় হজ পালন করে মাসুম বা গুনাহমুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাবনার সাথে সাথে, সউদী কর্তৃপক্ষ হজযাত্রীদের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা রক্ষার জন্য প্রস্তুতি জোরদার করেছে। স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী ডা. আবদুল্লাহ আসির ৫০ হাজার চিকিৎসা ও প্রশাসনিক কর্মী মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছেন – যা হজের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দল। তাপ-সম্পর্কিত অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য তিনটি ফিল্ড হাসপাতাল এবং ৭১টি জরুরি প্রতিক্রিয়া কেন্দ্র সম্বলিত ৭শ’টিরও বেশি হাসপাতালের শয্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার খালেদ আল তালা’আ নিশ্চিত করেছেন যে, হজযাত্রীদের স্বাস্থ্য স্থিতিশীল রয়েছে এবং গত বছরের তুলনায় স্বাস্থ্যসেবা ক্ষমতা ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে ৯৮ হাজারেরও বেশি চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করা হয়েছে।
হজ শুরু হওয়ার সাথে সাথে দেশটির সতর্কতামূলক প্রস্তুতি সমস্ত হজযাত্রীদের জন্য একটি নিরাপদ, নিরবচ্ছিন্ন এবং আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতির ওপর জোর দেয়।
লাব্বাইকা ধ্বনিতে মুখর হবে আরাফাত ময়দান পবিত্র হজ আজ

Leave a comment