মুজিববর্ষ-মানে আমরা এটা বুঝি শতবর্ষের সাক্ষী। তুমি মহান জন্ম তোমার ইতিহাস হবে দেশ হবে মহীয়ান তুমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতা রক্ত দিয়ে স্বাধীন করে গেছেন। তাঁর রক্তের ঋণ আমাদের শোধ করতে হবে। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যদি ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেটে প্রাণ না হারাতেন তবে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ তিনি শতায়ু হতেন। আবার কাকতালীয়ভাবে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে বাংলাদেশ তাঁর স্বাধীনতার অর্ধ-শত বার্ষিকীতে পদার্পণ করবে। কি আশ্চর্য এক মিলের সেতু বন্ধন বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের গড়ে ওঠা বাংলাদেশের। কিন্তু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালিকে জাতি হিসেবে আমরা মাত্র ৫৫ বছর ৪ মাস পেয়েছি। স্বাভাবিক মত্যু হলে শতায়ু তিনি হতেন না, তা কে বলতে পারে! যদি তিনি তাঁর অতি প্রিয় বাংলার মাটিতে শতবর্ষ বেঁচে থাকতেন তবে এই দিনটি জাতি তখন কীভাবে পালন করত, তা ভাবলে মনেপ্রাণে শিহরণ জাগে। সেই উপলব্ধি থেকেই হয়তো বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার সে দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলেক্ষ্য ২০২০-২০২১ খ্রীস্টাব্দকে মুজিব বর্ষ হিসেবে উদযাপনের ঘোষণা দিয়েছে।
জয় বাংলা- এ শ্লোগান আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাইতো গত ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯ জয় বাংলা’কে জাতীয় ¯েøাগান হিসেবে ঘোষণা দেন মহামান্য হাইকোর্ট। আর এই ¯েøাগান যার মুখে মুখরিত ছিলো সে আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় সংগ্রামী বাঙালির প্রিয় নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাঁর নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ অভিজাত এক বংশে শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুনের ঘরে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে শিশু। বাবা-মা আদর করে নাম রাখলেন ‘খোকা’। টুঙ্গিপাড়ার একটি বনেদী পরিবারের নাম শেখ পরিবার। এই পরিবারের উত্তরসূরী শেখ পরিবারের সুপরিচিত ব্যক্তি শেখ হামিদ গড়ে তোলেন একটি টিনের ঘর। শেখ হামিদের একমাত্র পুত্র শেখ লুৎফর রহমান একজন সজ্জন ব্যক্তি। টুঙ্গিপাড়ায় এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া শেখ মুজিব স্কুল জীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কৈশোরে তাঁর রাজনীতির দীক্ষাগুরু ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
শেখ মুজিবুর এর পিতা শেখ লুৎফর রহমান আদালতে চাকরি করতেন। তার মাতা সায়েরা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। পিতা-মাতার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে তিনি একজন খ্যাতনামা সৎ আইনজীবী হবেন। টুঙ্গিপাড়ার সেই শেখ বাড়ির দক্ষিণে ছিল কাছারি ঘর। এখানেই মাস্টার, পÐিত ও মৌলভী সাহেবদের কাছে ছোট্ট মুজিবের হাতেখড়ি। একটু বড় হলে তাদের পূর্ব পুরুষদের গড়া গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু হয়। এরপর পিতার কর্মস্থল মাদারীপুরের ইসলামিয়া হাইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে কিছু দিন লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে পিতা বদলি হয়ে গোপালগঞ্জে যোগদান করলে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। বিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতেন তিনি। পছন্দ করতেন ইতিহাসের বই। এসব কারণে প্রধান শিক্ষক গিরিশ চন্দ্রসহ সকল শিক্ষকের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিব। শিশুকাল থেকেই শেখ মুজিবুর ছিলেন পরোপকারী এবং অন্যায়ের প্রতিবাদী। মাত্র তের বছর বয়সে প্রতিবাদের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকা কালে তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে প্রথম বারের মতো কারাবরণ করেন শেখ মুজিবকে। ম্যাট্রিকুলেশন পাসের পর কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়ন কালে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন।
ছাত্রজীবন থেকেই নিজেকে ছাত্র-যুবনেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেন, যোগ দেন আওয়ামী মুসলিম লীগে, যা পরে অসা¤প্রদায়িক চেতনা নিয়ে আওয়ামী লীগ নাম নেয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট পালনকালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত তিনি বারবার কারারুদ্ধ হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন জনদাবি আদায়ের আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিব। বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শেখ মুজিবকে বারবার কারাগারে যেতে হতে হয়েছে। আর আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ তাকে নিয়ে যায় বাঙালির নেতৃত্বে। ১৯৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট লাভ করে।
কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির এ নির্বাচনী বিজয়কে মেনে নেয়নি। এরপর বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ দেন। ’৭১-এর মার্চে শুরু করেন অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করার পর সে রাতেই বন্দি হন বঙ্গবন্ধু। তবে তার আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে অন্তরীণ থাকলেও তার নামেই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে বাঙালি। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় আসে। এরপর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি তিনি পা রাখেন স্বাধীন ভ‚মিতে। সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের দায়িত্বভার নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, যদিও ওই সময়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র থেমে ছিল না।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে জাতীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এগোতে থাকে দেশ। কিন্তু বেশী দনি আর যায়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট এক দল সেনা কর্মকর্তার হাতে নিজ বাসভবনে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য রাজপথে নেমে কারাগারে যার জীবন কেটেছে, সেই দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে অবসান ঘটে স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়কের এবং তা বাঙালিদেরই হাতে।
আমি একজন ছবি প্রেমী মানুষ। ছবি আঁকতে ভালোবাসি। জন্মের পর থেকে ভালো মন্দ বোঝার থেকে ছবি আঁকাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। ছবি এঁকে ইতিহাস সম্পর্কে অনেক জানার চেষ্টা করছি। ইতিহাসের অধ্যায়ে খুঁজে খুঁজে একটি মানুষকে ছাড়া কারো জীবনকে নিয়ে গর্ব করার মতো পেলাম না। তাই তাঁর আদর্শে জীবনের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছি। আমার জীবনের সর্বোচ্চ দিয়ে আমি একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করলাম। খুলনা শহরে থাকি বিধায় এটির নামকরণ দেই খুলনা আর্ট একাডেমি। ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত করার পর থেকে এ পর্যন্ত হাজার হাজার শিক্ষার্থী কে আমি শিক্ষা দিয়েছি। ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য শিল্পী গড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে চারুকলা ভর্তি কোচিং চালু করি। এখানে সবাই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে আমার কাছে আসে। আমি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মোকাবেলা করে থাকি। আমার শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১৮৭ জন এই পর্যন্ত পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছেন। বিশ্বভারতী এবং রবীন্দ্রভারতীতে স্কলারশিপ নিয়ে ৮ জন পড়ার সুযোগ পায়। নবীন শিল্পীদের পথনির্দেশিকা দিয়ে থাকি এই জন্য খুলনা থেকে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্দেশ্যে আমাকে সম্মাননা স্মারক দিয়েছেন। আমার ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিভিন্ন অজানা তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করি এবং তাদের ছবি আঁকার জন্য অনুপ্রেরণা যোগাই। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে সমস্ত বাঙ্গালিদের জন্য শুভকামনা এবং মুজিববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।
(লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, খুলনা আর্ট একাডেমি)
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত