সাড়ে চার দশক আগে ইস্টবেঙ্গলের কাছে পাঁচ গোল খাওয়ার ক্ষতে মোহনবাগানিরা ‘সান্ত্বনা’ পেতে পারেন! ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এ সুচিত্রা সেনের মুখোমুখি ধ্রুপদী দৃশ্যে বাঙাল ভানুকেও ২৪টা মালপোয়া খেতে হয়েছিল।
বিজন ভট্টাচার্যের চিত্রনাট্যে নির্মল দে-র সঙ্গে কাজ করার সময়ে গোড়ায় নাকি কেদার ওরফে ভানুর অত দিনের কাজই ছিল না। কিন্তু শুটিংয়ের তোড়ে চিত্রনাট্য বদলাতে থাকে। এর পরে মেসবাড়ির ঘরে সুচিত্রা সেনের মুখোমুখি স্পর্ধিত বাঙাল তরুণ। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘সিনের অনেকটাই বাবার ‘ইম্প্রোভাইস’ করা। মালপো ভেজেছিলেন পরিচালক নির্মলবাবুর স্ত্রী। কেটে-কেটে শট নেওয়ার সময় বাবাকে ২৪টা মালপো খেতে হয়েছিল। ‘মাসিমা মালপো খামু’ সংলাপটাও সম্ভবত বাবার মুখে-মুখেই তৈরি।’’
১৯২০ সালের ২৬ অগস্ট বিক্রমপুরে জন্ম সাম্যময় অর্থাৎ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ভানুর শতবর্ষ পূর্তির এই দিনটাতেও সুচিত্রা সেনের সামনে সেই সংলাপ শুধু বাঙাল নয়, বাঙালিরই একটা কালজয়ী মন্ত্র হয়ে রয়েছে। ‘সাড়ে চুয়াত্তরে’র সেই দিনগুলোয় বাঙাল লব্জে ‘ডায়ালগটির’ অবশ্য অন্য ব্যঞ্জনা। খাস কলকাতার ছাপ্পা-মারা ‘আউটসাইডার’ বাঙালের স্পর্ধার স্মারক। চলতি মাসেই শতবর্ষ পূর্ণ করেছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবও। যার লাল-হলুদ পতাকা এক সময়ে লাখো দেশহারা বাঙালির আশ্রয় হয়েছিল। আমাদের অজান্তে ইতিহাস কিছু অদ্ভুত রূপকথা তৈরি করে। ভানু ও ইস্টবেঙ্গলের মিলে যাওয়ার সমাপতনও রূপকথা ছাড়া আর কী!
ঢাকার জগন্নাথ কলেজে সত্যেন বসুর স্নেহধন্য ছাত্রটির কলকাতা চলে আসা, আচম্বিতে তাঁর নামে পুলিশের ‘হুলিয়া’ বের হওয়ার ধাক্কায়। ব্রিটিশদের কোনও এক চরকে খুনের মামলায় ‘সাম্যময়’-এর নাম জড়িয়ে গিয়েছিল। এর পরে ময়দানে ইস্টবেঙ্গলের সদস্য গ্যালারির গেটে দীর্ঘদিন দেখা গিয়েছে সেই টিংটিঙে তরুণকে। গম্ভীরমুখে মেম্বারদের কার্ড জরিপ করছেন। লালহলুদের জাঁদরেল ফুটবল কর্তা মন্টু বসুর বসুশ্রী হলের আড্ডায় নিয়মিত উপস্থিতি ভানুর। সেই বসুশ্রীতেই থাকতেন আমেদ খান। ভানুর প্রিয় বন্ধু পঞ্চপাণ্ডবের ধনরাজ, ভেঙ্কটেশ বা পাখি সেন। অগ্রজপ্রতিম রাখাল মজুমদার, ছোনে মজুমদারদের সঙ্গেও অন্তরঙ্গতা। মোহনবাগান-ইস্টার্ন রেলের চুনী-পিকে বা নিজের প্রিয় দলের রামবাহাদুর-বলরামের খেলা অবশ্য খুব বেশি দেখতে পাননি ভানু। মাঠে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তত দিনে তাঁর প্রিয় ইস্টবেঙ্গলের মতো ‘মাসিমা মালপো খামু’র সেই ছেলেটিও বাঙালি বা বাঙালের আবেগের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
তবে বাঙাল কথা বলে তিনি লোক হাসিয়েছেন, এই কথাগুলোয় ঘোর আপত্তি ছিল ভানুর। ‘‘বাঙাল কথা শুনলে লোকে হাসলে তো কলোনিগুলোয় প্রতি মুহূর্তে মানুষ হেসে গড়িয়ে পড়ত— বলতেন বাবা! অভিনয়ের জোরেই যে মানুষের হাসি পায়! এটাই বোঝাতে চাইতেন,’’ বলছিলেন ভানুপুত্র গৌতম। তবু সিনেমার পর্দায় বা কৌতুক নকশায় তাঁর মুখের লব্জে অধরা বাপ-পিতেম’র স্পর্শ খুঁজে পেত দেশহারা বাঙালি। ইস্টবেঙ্গলকে দুয়ো দিতে তখন কলকাতায় রোল ওঠে ‘হারল কারা, বাস্তুহারা’! পাল্টা আগ্রাসনে ফুটো ঘটি ঝুলিয়ে মোহনবাগানের উপরে বদলা নেন বাঙালরা। ‘‘বাঙাল-ঘটির ঝগড়ায় কিছু নিষ্ঠুর রসিকতাও উদ্বাস্তুদের বাজত। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের মতো দেবব্রত বিশ্বাসের গান বা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংলাপও সে-সময়ে পূর্ববঙ্গীয়দের কাছে একটা অবলম্বন, সত্তার আধার,’’ বলছিলেন ফিল্ম স্টাডিজ়ের শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। ভানু একা নন, তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু জহর রায়, তুলসী চক্রবর্তী, নৃপতি-নবদ্বীপ থেকে রবি ঘোষেরা বাংলা ছবিতে হলিউডি নিঃশব্দ ছবির চার্লি চ্যাপলিন, বাস্টার কিটনদের মতোই মূর্তিমান বারুদ। সঞ্জয়বাবু প্রায়ই বলেন, ‘‘শাপভ্রষ্ট রাজপুত্তুরদের কথা। হাসির মোড়কে, যারা নিয়ত স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ে।’’
আবার হাস্যরসে ভরপুর ইমেজের আড়ালে অভিনেতা ভানুর গভীরতর সত্তাও হারিয়ে গিয়েছে। রুশ বিপ্লবের তিন বছর পরে জন্মানো ছেলের নাম সাম্যময় রেখেছিলেন ইতিহাসবিদ মাতামহ। কচি বয়সে বিনয়-বাদল-দীনেশের, শেষ জনের চেলা ভানু ইতিহাসের মগ্ন পাঠক। জহর রায়ের মৃত্যুর দিনে আকাশবাণী ভবনে রেকর্ডিং সেরে কাঁদতে কাঁদতে ভানুর স্টুডিয়ো থেকে বেরোনোর দৃশ্য এখনও কেউ কেউ মনে রেখেছেন। সেখানে অপেক্ষারত আকাশবাণীর অন্য আগন্তুকেরা কিন্তু তখনও ভা
এই ভানুই তাঁর স্নেহধন্য সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের কাছে আজও অবিসংবাদিত গুরু। ‘‘আমার মেজদি ভানুদার আপন মামিমা। ওঁর ভরসাতেই বাবা আমায় অভিনয় করতে ছেড়েছিলেন।’’ দেশভাগের আখ্যান নিয়ে ‘নতুন ইহুদি’ নাটকের জন্য ‘ইস্টবেঙ্গলের মেয়ে’ সাবিত্রীকে ভানুই খুঁজে আনেন। বাংলা ছবির কৌতুকাভিনেতা হিসেবে খ্যাত শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের মনে আছে হাতিবাগানের থিয়েটার পাড়ায় দূর থেকে ভানু, জহর, বিকাশ রায়, দিলীপ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়দের দেখার শিহরন। শ্রাবন্তী মজুমদারের স্টুডিয়োয় বেতারে অভিনয়ের সময়ে ‘ভানুদা’র টিপ্সও পেয়েছেন শুভাশিস।
ভানুর অজস্র সিনেমা, কৌতুক-নকশা ছড়িয়ে নেটরাজ্যে। ঝুলি ভরে ‘পুতুল নেবে গো’ গাইতে থাকা সেই ভানুর মূর্তিই এখন বাঙালির সংস্কৃতির একটি সৌধ। হাসির ভাব ও বাঙাল বুলির লব্জে পর্দার ভানু দেশভাগ-উত্তর সব বাঙালির খণ্ডিত সত্তার প্রতীক।