
স্যাঁতসেঁতে ঝুপড়ি ঘরে শ্রমিকদের বসবাস
মামুন খান
খুলনার চালকলগুলোতে কর্মরত কয়েক হাজার নারী শ্রমিক মারাত্মক শ্রম শোষণের শিকার হচ্ছেন। তারা নামেমাত্র মজুরি পাচ্ছেন। চরম অর্থকষ্ট তাদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি তাদের প্রতিদিনকার প্রয়োজন পূরণকে রিতিমত দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছে।
খুলনা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, নয় উপজেলাসহ মেট্রো অঞ্চলে লাইসেন্সধারী চাল কলের সংখ্যা ১শ’ ৯৭ টি। এর মধ্যে ১শ’ ৮০ টি চাতালের এবং ১৭ টি অটো রাইস মিল। তবে, উপজেলা এবং থানা পর্যায়ে চাল কলের পৃথকভাবে সুনির্দিষ্ট সংখ্যা কত? অনুমোদনহীন চাল কল আছে কিনা? সোমবার পর্যন্ত এ তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সংরক্ষিত ছিল না।
এদিকে, খুলনা জেলা চালকল মালিক সমিতির এক নেতা বলেছেন- প্রত্যেক চাতালের রাইস মিলে পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি ১২ থেকে ১৫/১৬ জন করে নারী শ্রমিক কাজ করেন। বিভিন্ন উপজেলায় কিছু অনিবন্ধিত চাল কল আছে। সেগুলোর মালিকেরা কেউ-কেউ শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছেন। খুলনায় চালকলগুলোতে কর্মরত নারী শ্রমিকের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি।
শ্রমিকদের সূত্রে জানা গেছে, চালকলে নারীরা সেদ্ধ করা ধান চাতালে শুকাতে দেয়া, শুকানোর সময় এক প্রকার নিড়ানি (কাটা ও পাটা) এবং পা দিয়ে বার-বার ধান ওলোট-পালোট করা, ধান গোছানো, মেশিনে ভাঙ্গানোর জন্য ধান ঢালা, ভাঙ্গানোর পর তুষ ও কুড়া আলাদা করে বস্তাজাত করার কাজ করেন।
সোমবার দুপুর প্রায় ১২ টা। আঠারোবেকি নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা নিপা রাইস মিলের চাতালে মাঝ বয়সী এবং বৃদ্ধ কয়েকজন নারী বসে ছিলেন। সেখানে কথা বলাকালীন হঠাৎই একজন যুবক তাদের ধান নাড়ার কাজে তাগিদ দিলেন। তাড়া শুনেই এক প্রকার দৌড়ে সবাই কাজে যোগ দেন। কাজের সময় মজুরি নিয়ে কথা বলতে তারা খানিকটা ইতস্তত বোধ করছিলেন। তাদের চোঁখে-মুখে অজানা শঙ্কা ফুটে উঠেছিল।
কাজের তাগিদ দেয়া যুবকটি দৃষ্টির আড়ালে গেলে কয়েকজন নারী শ্রমিক বলেন, সকাল সাত টা-সাড়ে ৭ টা থেকে বিকেল ৫ টা-সাড়ে ৫ টা পর্যন্ত তাদের কাজ করতে হয়। সপ্তাহে তিন দিন ভোর রাত দু’-তিনটা থেকে তাদেরকে সেদ্ধ করা ধান চাতালে নাড়ার কাজ করতে হয়। দৈনিক মজুরি ৬০ টাকা। ধান শুকানো শেষে মিলে ভাঙ্গানোর পর তারা জনপ্রতি চার কেজি করে চাল পান। প্রতি দু-তিন দিন পর তারা ওই চাল পান।
তারা বলেন, প্রতিদিন ৬০ টাকা ইনকাম এবং তিন দিনের মাথায় চার কেজি চাল-এ দিয়ে কোনো মতে পেটের ভাতের ব্যবস্থা হয়। পছন্দের মাছ-মাংশ জোটেনি দু’-এক মাসেও। চড়া দরের বাজারে যেয়ে শস্তা শাক-সবজি খুঁজতে হয়। নিরামিষ এবং মাঝে-মধ্যে নি¤œ মানের সাগরের মাছই প্রতিদিনের খাবার।
ওই মিলে কর্মরত একজন পুরুষ শ্রমিক বলেন, মজুরি নিয়ে কথা বলার পর কাজ চলে গেলে কোনো প্রতিকার করতে পারবেন? সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় এ প্রশ্নের উত্তরে নির্বাক থাকতে হয়েছে।
এদিকে, ওই মিলের মালিকপক্ষ বলেছেন, চাতালে কাজ করা নারীরা দৈনিক ৮০ টাকা মজুরি এবং দু’দিন পর-পর ৬/৭ কেজি করে চাল পেয়ে থাকেন।
ওই রাইস মিল থেকে কিছুদুর এগিয়ে পাশাপাশি দুইটি চালকল রয়েছে। প্রবেশ দ্বারে মিলের কোনো নাম লেখা না থাকলেও স্থানীয়রা বললেন, চালকলটির নাম হিমালয়। জনৈক জিয়া নামের একজনের কাছ থেকে মিলটি ভাড়া নিয়ে মিজান এবং আনন্দ নামে দুইজন ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
সেখানে কর্মরত কয়েকজন নারী শ্রমিক বলেন, প্রতিদিন জনপ্রতি ৫০ টাকা মজুরি এবং দু’-তিন দিন পর আড়াই কেজি অথবা তিন কেজি করে চাল দেয়া হয়। মজুরি বাড়ানোর কথা বলা হলে মালিক পক্ষ বলেছেন-সম্ভব নয়।
গোলপাতা এবং পলিথিনে ছাওয়া ছোটো-ছোটো ঝুপড়ি ঘরে শ্রমিকদের বসবাস। বিভিন্ন স্থানে স্যাঁতসেঁতে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। সেখানে অনেকে স্বপরিবারে বসবাস করছেন। সরেজমিন কয়েকটি চালকল পরিদর্শণকালে এ দৃশ্য চোঁখে পড়েছে।
শ্রমিকরা জানান, বিভিন্ন চালকলে স্বামী এবং স্ত্রী একই সাথে কাজ করেন। কারো-কারো সমিতির ঋণ রয়েছে। নি¤œ মজুরিতে সংসারের চাঁকা ঘোরে না। সমিতির কিস্তি পরিশোধের চাপ অনেককে দিশেহারা করে তুলেছে। কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসা খরচ যোগাতে চরম বিপাকে পড়তে হয়। অনেক পুরুষ শ্রমিক চালকলে কাজের পাশাপাশি ভ্যান-রিক্সা চালাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি)’র খুলনা জেলা সভাপতি এইচএম শাহাদাৎ দৈনিক জন্মভ‚মিকে বলেন, চালকল মালিকদের সরকারি নিয়ম অনুযায়ি কোনো মজুরি স্কেল নেই। যে কারণে মালিক পক্ষ ইচ্ছেমত মজুরি পরিশোধ করছেন। শ্রমিকরা অসংগঠিত হওয়ায় তাদের মজুরি বৃদ্ধিসহ অন্যান্য অধিকার আদায়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। রাইস মিলে শ্রম শোষন বন্ধে তিনি কল-কারখানা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।