সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : সুন্দরবনের দক্ষিণে অবস্থিত দুবলার চরে চলে ‘সাহেবদের’ শাসন। সাগর, বন সবখানেই তাদের আধিপত্য। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে চরের অন্তত ২০ হাজার জেলের জীবন ও জীবিকা। ফলে চরে হাড়ভাঙা খাটুনির পরও ভাগ্যের বদল হয় না বলে অভিযোগ সেখানকার জেলেদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুন্দরবন এলাকার জেলেদের কাছ থেকে মাছ কেনেনÑ এমন ব্যবসায়ীদের একটি সমিতি রয়েছে। দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপ নামের সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সমিতির সঙ্গে যুক্ত অন্যরা সাধারণ জেলেদের কাছে ‘সাহেব’ নামে পরিচিত। এই সাহেবরাই সেখানকার জেলে ও মাছ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। একসময় দুবলার চরে শুঁটকির ব্যবসা পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করতেন প্রয়াত মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন। তার মৃত্যুর পর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা যায় তার ভাই কামাল উদ্দিন আহম্মেদের হাতে। কয়েক যুগ ধরে সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদ আঁকড়ে ধরে আছেন তিনি।
জেলেদের অভিযোগ, সুন্দরবন জলদস্যু থেকে মুক্ত হয়েছে। নেই মুক্তিপণের আতঙ্ক। তার পরও দুবলার চরে হাসি নেই তাদের মুখে। এর কারণ, দুবলার চরে কারা মাছ ধরবেন, কোন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করবেন, কোন মাছের দাম কত হবেÑ সবই ঠিক করেন প্রভাবশালী ‘সাহেবরা’। তারাই জিম্মি করে রেখেছেন ৯৮৫ জেলে-মহাজনসহ প্রায় ২০ হাজার মৎস্যজীবীকে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দুবলার চরে গিয়ে দেখা যায়, চরটিতে সচল রয়েছে একটি মাত্র মোবাইল ফোন কোম্পানির নেটওয়ার্ক। তবে যেদিন বেশি মাছ ধরা পড়ে, সেদিনই ডাঙ্গার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ থাকে জেলেদের। এই সুযোগে পানির মাছ পানির দামে কিনে নেয় মহাজনদের লোকজন। জেলেরা বিশাল জেলে পল্লীতে একসময় ছিল দস্যুদের লক্ষ্য। তবে র্যাবের তৎপরতায় সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হলেও সংকট পিছু ছাড়েনি তাদের।
এদিন তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, বছরে সাত মাস দুবলার চর ফাঁকা থাকে। থাকে না মানুষের তেমন পদচারণা। বাকি পাঁচ মাস থাকে লোকে লোকারণ্য। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা প্রান্তিক জেলেরা গড়ে তোলেন বসতি। সাগর ও নদী থেকে ধরে আনা মাছ এখানে শুকানো হয় রোদে। সরকার প্রতি বছর এই শঁটকি পল্লী থেকে ছয়-সাত কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে। একদিকে সিন্ডিকেট, অন্যদিকে মহাজনরা খায় লাভের অংশ। কিন্তু জেলেদের নিয়ে ভাবে না কেউ।
এ বিষয়ে দুবলার চরে মাছ ধরতে আসা জেলে নজরুল ফকির বলেন, ‘ক্ষমতা সব সাহেবদের। কামাল সাহেব, টোকেন সাহেব, কামরুল সাহেবসহ অনেক সাহেব আছে এখানে। এই সাহেবদের কাছ থেকে দাদন (অগ্রিম টাকা নেওয়া) নিতে হবে। এক লাখ টাকা নিলে পাঁচ লাখ টাকার মাছ বুঝে নেবেন তারা। মহাজন বা সাহেবদের কারবার হওয়ায় কোনো মাছ বাইরে বিক্রি করা যায় না। জলদস্যু না থাকলেও এই সাহেবদের অত্যাচারে জেলেরা বন্দি। এখান থেকে আমরা মুক্তি চাই।
আরেক জেলে সেলিম মাঝি বলেন, ‘এই চরের রাঘববোয়ালদের হাত থেকে সরকার আমাদের উদ্ধার করুক। যাদের লাইসেন্সে এখানে মাছ ধরা হয়, সেই সাহেবদের অর্ধেকের বেশি মাছ বুঝিয়ে দিতে হবে। কথা বলার কোনো অধিকার নেই। এভাবে দিতে দিতে জেলেদের ছেঁড়া জাল আর ভাঙা ট্রলার নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হয়।
৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দুবলার চরে মাছ ধরতে আসা জাহাঙ্গীর হোসেন নামে এক জেলে বলেন, ‘রাত জেগে রোদে পুড়ে সাগরে মাছ ধরতে হয়; অনেক কষ্ট। এরপর সাহেবদের কাছে সেই মাছ বিক্রি না করলে গালাগাল করে, নির্যাতন করে।’
এদিকে, শীত মৌসুমে দুবলার চরে জেলে ও অন্যান্য কর্মী মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার লোক বাস করেন। কিন্তু সেখানে নেই কোনো মেডিকেল ক্যাম্প, নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা।
নাহিদুল ইসলাম মৃধা নামে এক জেলে বলেন, এখানে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। চরের কুয়া থেকে পানি তুলে খেতে হয়। এতে পেটে অনেক সমস্যা হয়। এ ছাড়া এখানে হাসপাতালের কোনো ব্যবস্থা নেই। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে পর্যাপ্ত চিকিৎসারও কোনো ব্যবস্থা নেই।
ইয়াছিন শেখ নামে আরেক জেলে বলেন, সাগরে মাছ ধরতে গেলে অনেক সময় পানি সাপ নামে একধরনের বিষাক্ত সাপের কামড় খেতে হয়। এ জন্য এখানে ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা রাখা হলে তাদের জীবনের ঝুঁকি কমে যেত। এ ছাড়া অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে দুবলার চর থেকে তাদের নদীপথে বাগেরহাট বা খুলনায় হাসপাতালে নিতে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে। এ জন্য জরুরিভাবে একটি সরকারি হাসপাতালের দাবি করেন তারা।
এ ব্যাপারে দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘জেলেদের এই অভিযোগ কতটুকু সত্য তা আমার জানা নেই। এখানে দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের একটি সমিতি আছে। জেলেরা চাইলে সমিতিতে অভিযোগ দিতে পারেন। এরপর এর সুষ্ঠু সমাধান করা যেতে পারে।
কিন্তু দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপ সমিতির খোদ কামাল উদ্দিন আহম্মেদই কয়েক যুগ ধরে সাধারণ সম্পাদকের পদ আঁকড়ে রাখায় সেখানে কোনো জেলে অভিযোগ দিতে সাহস পান না বলে জানা গেছে।
মাছ শিকার আর শুঁটকির মৌসুমে কথিত সাহেবদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিষয়ে জেলেরা লিখিত অভিযোগ দিলে দুবলার চরকে সাহেবমুক্ত করা হবে জানিয়ে পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মো. নুরুল করিম বলেন, দুবলার চরে সুপেয় পানির সমস্যা দীর্ঘদিনের। কিন্তু এবার জেলেদের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর স্বাস্থ্যসেবার জন্য গত সোমবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আলোচনা হয়েছে। এ সময় দুবলার চরে অন্তত একজন চিকিৎসক এবং পর্যাপ্ত ওষুধের ব্যবস্থা করতে সিভিল সার্জনকে অনুরোধ করা হয়েছে। সিভিল সার্জন তাকে আশ্বস্ত করেছেন