সিরাজুল ইসলাম (শ্যামনগর), সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার হাটছালা গ্রামে এক সময় শুধু বর্ষা মৌসুমে ধান উৎপাদন হতো। লবণাক্ততার কারণে বছরের অন্যান্য মৌসুমে ফসল হতো না এখানকার মাটিতে।দিনমজুরি দিয়েই সংসার চালাতেন স্থানীয়রা।কিন্তু এখন দিন বদলেছে। হাটছালা গ্রামেই সারা বছর ফলে নানা ধরনের শাক-সবজি। এতেই ভাগ্য ঘুরেছে অন্তত ১০০ পরিবারের। বছরে তাদের উৎপাদিত সবজির মূল্য প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা।যদিও সেচের পানির সংকট রয়েছে তাদের। এ সংকট দূর করা সম্ভব হলে আরও ভালো ফসল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে এখানে।হাটছালা গ্রামের চাষিরা উৎপাদিত ফসল বিক্রি করেন স্থানীয় নকিপুর, বালিয়াডাঙ্গা ও মৌতলা বাজারে। পরে সেখান থেকেই এসব সবজি চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।প্রচণ্ড লবণাক্ততার মধ্যেও হাটছালা গ্রামে প্রায় ৩০ বছর আগে শাক-সবজির চাষাবাদ শুরু করেছিলেন স্থানীয় মনোতোষ মণ্ডল (৬০)। বাড়ির আঙ্গিনায় বারোমাসি সবজির চাষ থেকে ধীরে ধীরে পুরো গ্রামই এখন সবুজে ভরে উঠেছে। ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার ছাড়াই হাটছালা গ্রামে উৎপাদিত হচ্ছে সবজি।একসময় ফেরি করে হাতের শাঁখা-পলা বিক্রেতা মনোতোষ সবজি চাষ করেই ঘুরিয়েছেন ভাগ্যের চাকা। এখন তিনি ৮০ শতাংশ জমির মালিক। এক সময় হাটছালায গ্রামে সনাতন পদ্ধতিতে সবজি চাষ হলেও এখন আধুনিক প্রযুক্তিতে চাষাবাদ করছেন কৃষকেরা।ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, অনেক কৃষক গ্রিনহাউজ পদ্ধতির আদলে নিজস্ব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছেন। প্লাস্টিকের স্বচ্ছ আবরণ দিয়ে ঢেকে সেখানে বোম্বাই মরিচ, টমেটো, কাঁচা মরিচ, গাজর, লালশাক, বাটিশাক, পালংশাক, ফুলকপি বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন শাক-সবজিতে ভরে উঠেছে ফসলের ক্ষেত।
হাটছালা গ্রামের কৃষক প্রদীপ মণ্ডল জানান, দুই বিঘা জমিতে ফুলকপি, ওলকপি, লালশাক, টমেটো, পালংশাক, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করেছেন তিনি। গত বছর শীত মৌসুমে সবজি বিক্রি করে আয় করেন প্রায় ৬ লাখ টাকা। এ বছর আরও বেশি লাভের আশা করছেন তিনি।একই গ্রামের কৃষক অনুরুপা মণ্ডল জানান, এক সময় গ্রামগুলোয় নারীরা এতো কাজ করতেন না। তখন সামান্য ধান আবাদ হতো। সে সময় প্রায় প্রতিটি ঘরেই অভাব ছিল। এখন পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও মাঠে কাজ করেন। এ কারণে ১২ মাস সবজি চাষ হয়। এতে অভাবও ঘুচে গেছে এ গ্রামের চাষিদের।একই এলাকার অনুপ কুমার মণ্ডল জানান, কৃষাণ-কিষাণিরা সমানতালে কৃষি কাজ করছেন। নারীরা ক্ষেত সামলে সংসারের রান্নাসহ ছেলে-মেয়েদের দেখাশোনার দায়িত্বও পালন করেন। ফসল সংগ্রহ, বাজারজাতকরণ এবং নতুন নতুন সবজি ক্ষেত তৈরিসহ অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন পুরুষরা।কৃষক মনোতোষ বলেন, সবজি চাষের জন্য খুব বেশি জমির প্রয়োজন হয় না। তুলনামূলকভাবে মূলধনও কম লাগে। পরিশ্রমও অনেক কম। তবে যত্নে ত্রুটি করা যাবে না। কম সময়েই সবজি বিক্রির উপযোগী হয়ে ওঠে। প্রায় প্রতিদিনই বাজারে সবজি বিক্রি করা যায়। পরিবারের চাহিদাও মেটানো সম্ভব। এছাড়া চলতি মৌসুমে সবজির দামও বেশ ভালো। সব মিলিয়ে সবজি চাষকেই আমরা লাভজনক মনে করছি। সবজি চাষ করে ভালো আছে অন্তত ১০০ পরিবার।তবে তিনি আরও জানান, জমিতে সেচের পানি নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকেন গ্রামের কৃষকরা। বৃষ্টির পানিই একমাত্র ভরসা। বৃর্ষা মৌসুমে ক্ষেতের পাশে পুকুর কেটে সংরক্ষণ করে রাখা বৃষ্টির পানিতেই সবজি চাষ করা হয়। তবে তাতে চাহিদা মেটে না। এজন্য বেশি দামে পাশের গ্রাম থেকে সেচের পানি কিনে সবজি চাষ করেন তারা। মনোতোষের মত অন্যান্য কৃষকের দাবি, সেচের পানির ব্যবস্থা করা হোক। তাহলে এ গ্রামে আরো ভালো ফসল হবে।স্থানীয় কৃষকরা জানান, তাদের উৎপাদিত শাক-সবজি উপজেলার চাহিদা পূরণ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর কারণে এখন গ্রাম ঘুরে পাইকাররা ক্ষেত থেকে সবজি সংগ্রহ করে চালান করেন বড় বড় বাজারে।
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা বলেন, উপজেলার ভুরুলিয়া ইউনিয়নের (বর্তমান শ্যামনগর পৌরসভা) হাটছালা গ্রামে দেশি সবজি ছাড়াও লবণসহনশীল আলু চাষ হচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় এক হাজার ৫৮৪ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদিত হয় হাটছালা গ্রামে। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আমরা এখানকার কৃষকদের কারিগরি সহায়তা দিচ্ছি। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার ক্ষতি কাটিয়ে শীতকালীন সবজি চাষে ব্যস্ত সময় পার করছে সাতক্ষীরার কৃষকরা। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় এ বছর আগাম সবজি চাষে যথেষ্ট প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। যে সময় শীতকালীন আগাম সবজি খেত থেকে তুলে বাজারে বিক্রির কথা, সে সময় সবজির আবাদের জন্য খেত প্রস্তুতের কাজ করছেন চাষীরা।ফলে জেলার কৃষকেরা লোকসানের পাশাপাশি শীতকালীন সবজি চাষের মৌসুম থেকে পিছিয়ে পড়েছেন। তবে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা।কৃষকরা জানান, সাতক্ষীরায় উৎপাদিত সবজি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বড় একটি অংশ সরবরাহ হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। তবে এ বছর টানা ভারী বৃষ্টিতে জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে এসব এলাকার ফসলের ক্ষেত। ফলে এখানকার সবজি উৎপাদন শুরু করতে দেরী হয়েছে। সহযোগিতার দাবিও জানিয়েছেন তারা।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর জেলায় ৯ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে রবি ফসলের আবাদ হয়। এ বছর সাতক্ষীরা জেলায় নভেম্বর মাস পর্যন্ত ২ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজির আবাদ করে চাষিরা। জমি থেকে পানি কমে গেলে চাষাবাদ আরও বাড়বে। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় এবার ৫ হাজার ৩৩২ জন কৃষকের ৪ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ক্ষতির পরিমাণ ৩০ কোটি টাকারও বেশি বলে জানিয়েছে সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।