সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পানখালী গ্রাম। গ্রামটি সুন্দরবনের খুব কাছে। এই গ্রামেরই বাসিন্দা হরিপদ দাস ও তাঁর স্ত্রী গীতা রানী বনে মাছ কাঁকড়া ধরে সংসার চালাতেন। কিন্তু পহেলা জোন থেকে ৩১ শে আগস্ট পর্যন্ত ৩ মাসের জন্য সুন্দরবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করায় তাঁদের আয়ের একমাত্র পথও বন্ধ। স্বামীর বয়স ৬৫ এবং স্ত্রীর ৫৬ বছর। ছেলেরা বিয়ে করে আলাদা থাকেন। তাই তাঁদের দিন এখন অনেক কষ্টে কাটছে। শুধু গীতা রানী নন, সুন্দরবনে ঢুকতে না পারায় শ্যামনগর উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার জেলে পরিবার এখন দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে।
শনিবার এই প্রতিবেদক পানখালী গ্রামে গেলে গীতা রানী বলেন, ‘ছেলেরা বিয়ে করে আলাদা থাকে। বুড়া-বুড়ি দুজনই বনেগে মাছ কাঁকড়া ধুরে দিন কাটাতাম। হঠাৎ করে তিন মাসের জন্য বনে ঢুকার নিষেধাজ্ঞা দে তাগের চরম দুর্দিনের মধ্যে ফেলে। যাগে (যাদের) জেলে কার্ড নইছে, তারা কিছু চাল পালিও আমরা কিছুই পাইনে। এ বয়সেও মানুষের মালামাল বয়ে দিয়ে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে দিন পার করতিছি।’
শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ গ্রামের গৃহবধূ একাদশী মণ্ডল। মধ্যবয়সী ওই গৃহবধূ বলেন, কাঁকড়া মাছের প্রজনন মৌসুমের অজুহাতে সুন্দরবনে জেলেদের প্রবেশ বন্ধ করা হলেও মাছ কাঁকড়া শিকারের জন্যও বনে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এমন অবস্থায় সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।
সুন্দরবনের কাছের এলাকার কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৯ সালে বিভিন্ন অজুহাতে প্রায় ৯ মাস নদ-নদী থেকে মাছ ও কাঁকড়া ধরা বন্ধ রাখা হয়েছিল। এ ছাড়া প্রতিবছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি—এ দুই মাস কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম সুন্দরবনে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এ সময় তাঁদের কাঁকড়া শিকারের জন্য সুন্দরবনে যেতে দেওয়া হয় না। কিন্তু ওই সময় মাছ ধরার জন্য বনে যাওয়া যায়। কিন্তু মাছ কাকড়া ও বন প্রাণীর প্রজনন মৌসুম জুন।জুলাই ও আগস্ট মাসে। এই তিন মাসেও মাছ কাঁকড়া ধরার জন্য সুন্দরবনে যাওয়া যায় না। আগে এই সময়ে কাঁকড়া শিকারের জন্য সুন্দরবনে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো। কিন্তু এবার এই মৌসুমেও কাঁকড়া ধরার জন্য বনে ঢুকতে দেওয়ার অনুমতি না দিয়ে তাঁদের চরম দুরবস্থার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
আবাদ চণ্ডিপুর গ্রামের ইস্রাফিল হোসেন ও হাতেম সরদার বলেন, সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া ধরে পরিবারের সারা বছরের খরচ চলে। প্রতিবছর জোন জেলায় আগস্ট তিন মাসের জন্য প্রজনন মৌসুমের কারণে মাছ কাঁকড়া শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও এবার কাঁকড়া ধরার জন্যও বনে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। ফলে তাঁরা কয়েক হাজার পরিবার কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের খেত আর চিংড়িঘের প্লাবিত হওয়ায় এলাকায় কাজ মিলছে না। এমন পরিস্থিতিতে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ও মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তাঁদের সংসার চালাতে হচ্ছে।
পানখালী গ্রামের হরিপদ দাস এবং দেবেন্দ্র সরকার ও মালতী রানী জানায়, তাঁরা সরকারি প্রণোদনার কার্ড পেয়েছেন। তিন মাস বনে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে তাঁদের প্রত্যেক পরিবারকে ৫০ কেজি চাল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁদের প্রতিবেশী রবি, দেবেন্দ্র, মনোয়ারা, মমতাজ বেগম, রাশিদা, সিরাজুল ইসলাম, রাশেদ গাইনসহ অনেকের জেলে কার্ড না থাকায় তাঁরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের প্রাক্তন সদস্য ডালিম ঘরামি বলেন, উপকূলের ৪০ থেকে ৫০ হাজার পরিবার সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। মাছের প্রজনন মৌসুমেও কাঁকড়া শিকার বন্ধের মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধরত উপকূলবাসীর সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে।
সুন্দরবনের বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, মাছের খাগড়ার বন প্রাণীর প্রজনন মৌসুমে সে কারণে মাছ কাঁকড়া ধরার অনুমতি নেই তিন মাসের জন্য কিন্তু বনে ঢুকে তাঁরা মাছও কাঁকড়া আহরণের চেষ্টা করছে তাই এবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এই মৌসুমেও মাছ ও কাঁকড়া ধরা বন্ধ রাখা হয়েছে।
শ্যামনগর উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা তুষার মজুমদার বলেন, আপাতত ২৩ হাজার ৫৩৪ জেলে সরকারি প্রণোদনা পাচ্ছেন। যেসব জেলে প্রণোদনা পাচ্ছেন, তাঁদের তালিকা ২০১৭ সালে তৈরি করা হয়েছে। এরপর কয়েক হাজার জেলে এ পেশায় যুক্ত হয়েও সরকারি এই প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত থাকছেন। দু–এক মাসের মধ্যে তালিকা নবায়ন করে প্রকৃত জেলেদের সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার সময়ে সরকারি প্রণোদনার আওতায় আনা হবে। এ ব্যাপারে কথা হয় পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাসানুর রহমানের সাথে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন আমরাও জানি বনজীবীদের কষ্টের কথা কিন্তু করবো কি করার কিছু নেই মাছ কাকড়া বন প্রাণীর বংশবৃদ্ধির জন্য সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারের সিদ্ধান্ত আমাদের যথাযথভাবে পালন করতে হবে সে কারণে উপকূলীয় সুন্দরবনের সাথে সম্পৃক্ত বনজীবীদের কে আহবান করব এই তিন মাস যাতে সুন্দরবনে প্রবেশ না করেন। উপকূলী এলাকার জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে হাসানুর রহমান বলেন আপনারাও সরকারের একটি অংশ আপনাদেরও এই দায়িত্ব কম বেশি আছে তাই আপনারাও এই বন্ধের তিন মাস বনবিভাগকে সকল প্রকার সহযোগিতা করবেন বলে আমি মনে করি।
শ্যামনগরে কষ্টে আছে ৩০ হাজার জেলে পরিবার

Leave a comment