সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : লবণাক্ততার অভিশাপ কাটিয়ে সবুজ ফসলের জয়গান এখন সাতক্ষীরার জনপদে। তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্যে এখানের যাপিত জীবনে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার ছোবলের পর লবণাক্ততা সাতক্ষীরার জনপদে হয়ে ওঠে এক চরম অভিশাপ। যা কৃষি আবাদ, মৎস্য চাষে বড় বাধার কারণ হয়ে ওঠে।
সে বাধা জয় করতে সমর্থ হয়েছে এখানের বিপদে পড়া বাসিন্দারা। তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্য সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার আটুলিয়া ইউনিয়নের বড় কুপটে কৃষি উৎপাদনে এনে দিয়েছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
যেখানে আগে লবণাক্ততার কারণে ফসল ফলানো সম্ভব হতো না, এখন সেখানে ফসলের সমারোহ। অনলাইন বা অ্যাপসের মাধ্যমে গৃহীত পরামর্শ কৃষি আবাদের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি এমনকি মৎস্য চাষেও এনেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। এখন বড় কুপটের উঠানে উঠানে সবুজ ফসলের জয়গান। রয়েছে দেশী মুরগির খামারও। যা পারিবারিক পুষ্টি নিশ্চিতের পাশাপাশি গ্রামীণ নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলেছে। এখানকার নারীরা এখন ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠানোসহ পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেও রাখছে ভূমিকা।
জানা গেছে, বড় কুপট গ্রামের নারীরা স্মার্ট ফোনে কৃষকের জানালা, প্রতীক কৃষি সেবা, মৎস্য প্রযুক্তি ভান্ডার, হাঁস-মুরগি পালন, ছাগল পালন, স্বাস্থ্য কথা, প্রতীক কল সেন্টার ও এস.এম.এসসহ বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক তথ্য নিয়ে বাড়ির উঠানের লবণাক্ততার মাঝেও আশার পথ খুঁজে পেয়েছেন। কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে পারিবারিক পুষ্টি নিশ্চিত ও আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
আর এ কাজে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয় ও অক্সফামের সহায়তায় বেসরকারি সংস্থা সুশীলন প্রতীক (পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ওনারশিপ উইথ টেকনোলজি ইনফরমেশন অ্যান্ড চেঞ্জ) প্রকল্পের আওতায় তাদেরকে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশিক্ষণ ও স্মার্ট ফোন দিয়ে সহায়তা করছে।
এর মাধ্যমে এখানকার কৃষাণীরা লবণাক্ত জমিতে ফসল উৎপাদন শুধু নয়, ফসল রোগাক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতীক কল সেন্টারে ফোন করে পাচ্ছেন প্রয়োজনীয় পরামর্শ। তাতেও না হলে স্মার্ট ফোনে রোগাক্রান্ত অংশের ছবি তুলে পাঠিয়ে দিচ্ছেন তাদের ফেসবুক পেজে ও প্রতীক কৃষি তথ্য সার্ভিসের ম্যাসেঞ্জারে। এসব সেবা প্রদান ছাড়াও প্রতীক থেকে প্রতি সপ্তাহে তাদের একটি করে কৃষি বিষয়ক এসএমএস ও আবহাওয়ার সতর্ক সংকেত বিষয়ে নিয়মিত আপডেট দেওয়া হয়। পাঠানো হয় ওবিডি।
শুধু কৃষি উৎপাদনে নয়, অ্যাপসের মাধ্যমে তথ্য সেবা পেয়ে বাড়ির হাঁস-মুরগির মড়ক ঠেকিয়ে এখন বড় কুপটের প্রত্যক বাড়িই যেন একেকটি দেশি মুরগির ফার্ম। এর মাধ্যমে ডিম ও মাংসের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাড়তি আয়ও করছেন তারা। একইভাবে বাড়িয়েছেন মৎস্য উৎপাদনও।
বড় কুপটের সুজিত বৈদ্যর স্ত্রী পারুল রানী জানান, আগে লবণাক্ততায় বাড়ির উঠানে কোন ফসলই ফলাতে পারতেন না তিনি। পরে তিনি সুশীলনের প্রতীক প্রকল্প থেকে একটি স্মার্ট ফোন পান। স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে কিভাবে কৃষি তথ্য সেবা পাওয়া যায় সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় তাদের। সেখান থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন মাটির নিচে পলিথিন ব্যবহার করে লবণাক্ততা প্রতিরোধের মাধ্যমে সবজি চাষ ছাড়াও টাওয়ার পদ্ধতি, বস্তা পদ্ধতি ও মাল্টি লেয়ার পদ্ধতিতে সবজি চাষ করছেন তারা। এতে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মেটানোসহ বাড়তি সবজি বাজারে বিক্রি করে আয়ও হচ্ছে তাদের। এখন ছেলে মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে।
তিনি জানান, একবার প্রশিক্ষণ দিয়েই শেষ নয়, তারা নিয়মিত প্রতীক কল সেন্টার থেকে কৃষি তথ্য সেবা পেয়ে থাকেন। ক্ষেতে রোগ বালাই দেখলেই ফোন করেন প্রতীক কল সেন্টারে, ছবি তুলে পাঠিয়ে দেন রোগাক্রান্ত ফসলের।
একই গ্রামের পবিত্র বৈদ্যর স্ত্রী স্বপ্না বৈদ্য জানান, লবণাক্ততা প্রতিরোধে সক্ষম হওয়ায় তার বাড়ির উঠানে এ বছর বিট কপি, পাতা কপি, আলু, ওল কপি, মরিচ, টমেটো, গাজর, ভুট্টা, লাল শাক, পালন শাক, বেগুনসহ অন্যান্য ফসলের বাম্পার ফলন হয়েছে। বাড়ি মুরগি রয়েছে ২৫টি।
তিনি বলেন, ‘মাঝে মধ্যে মুরগির রোগ বালাই হলে প্রতীক কল সেন্টার থেকে পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করলে ভাল হয়ে যায়। এখন আর মুরগি মরে না।’
এ প্রসঙ্গে সুশীলনের প্রতীক প্রকল্পের ফোকাল পার্সন মোস্তফা আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘প্রতীক- মূলত গবেষণাধর্মী একটি প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় ১০০জন নারী গণ গবেষককে প্রশিক্ষণ ও স্মার্ট ফোন দেওয়া হয়েছে। এসব গণগবেষকরা এখন অনলাইন/অফলাইনে বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় নিজেদের ভাগ্য গড়তে নিজেরাই কাজ করছেন। যা সারাদেশের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে।’
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, প্রতীক প্রকল্পের মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে বড় কুপট গ্রাম এখন ফসল মডেল গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এটা একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন বলা যায়।