সকাল-সন্ধ্যা খাটছেন, তবুও তিন বেলা খাবার জুটছে না
মামুন খান : চলতি অগ্রহায়নের শুরু হতেই খুলনার কয়েকটি উপজেলায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। হাটে জন বিক্রির জন্য সমবেত হওয়া ক্ষেতমজুরদের পাশাপাশি স্থানীয় বেকার যুবক, এমনকি বৃদ্ধরা ধান কর্তনের পাশাপাশি আটি বেঁধে মাথায় করে বহনসহ মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কিন্তু গত মৌসুমের তুলনায় তাদের মজুরি কমে গেছে। চলতি আমন মৌসুমের শুরু থেকে তারা চরমভাবে তারা শ্রম শোষণের শিকার হয়েছেন। এখন মজুরি সামান্য বাড়লেও তাতে অর্থকষ্ট লাঘব হচ্ছে না। তারা খেয়ে না খেয়ে সংসারের চাঁকা সচল রাখছেন।
কয়রা উপজেলার আমাদী ইউনিয়নের খেওনা গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম (৪৭) স্বামী-স্ত্রী, দুই কন্যাসহ বৃদ্ধ পিতাকে নিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসারে একমাত্র উপার্যনক্ষম ব্যক্তি। পেশায় ক্ষেতমজুর, ফসলের জমিতে কাজ না জুটলে তিনি বিভিন্ন স্থানে দিনমজুরির কাজ করেন। সকাল ৬ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত রূপসা উপজেলার একজন কৃষকের বাড়ীতে থেকে কাজ করে তিনি ছয় দিনে ৩৫শ’ টাকা মজুরি পাচ্ছেন। দৈনিক ৫শ’ ৯০ টাকার সামান্য কম মজুরির বিনিময়ে তিনি সংসারের সকল সদস্যের তিন বেলা খাবারসহ অত্যাবশ্যক অন্য চাহিদাগুলো পূরণে অক্ষম হয়ে উঠেছেন। সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনই তাদের জন্য ডাল-ভাতের ব্যবস্থা। তাও তিন বেলা নিয়মিত জোটেনা। বৃদ্ধ পিতার জন্য ওষুধ কিনতে তাকে ধার-দেনা করতে হয়।
ক্ষেতমজুর জাহাঙ্গীর বলছিলেন, গত বোরো মৌসুমেও ছয় দিনের মজুরি ৪৮শ’ টাকা ছিল। চলতি আমন মৌসুমে ১৩শ’ টাকা মজুরি কমে গেছে। অগ্রহায়নের শুরুতে আরও কম ছিল। এভাবে দিন চলেনা, কিন্তু উপায় কি?
জাহাঙ্গীরের মতোই অন্য ক্ষেতমজুরদেও একই অবস্থা। তিনি ডুমুরিয়া উপজেলার কৈয়ার হাটে উঠেছিলেন। সেখান থেকে জমির মালিক তাকে দও কশা-কশি করে কাজে এনেছেন। ১৮ বছর থেকে ৫৫-৬০ বছর বয়সী মানুষও কাজের জন্য হাটে উঠছেন। বয়ষ্করা অনেকেই সারাদিন হাটে বসে থেকে কাজ না পেয়ে বাড়ী ফিরছেন। যাদের হাড় ভাঙ্গা কাজের সমর্থ চেহারা ও শারীরিক গঠনে প্রকাশ পায় হাটে তাদেও চাহিদাই বেশি। মজুরির সময় কম হলেও কাজের বেলায় জমির মালিকদের শতভাগ ইচ্ছে পূরণ করতে হয়। এ ব্যাপারে অনেকেই কটু কথা শোনেন, আবার কাউকে কাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়। ক্ষেতমজুরদের মধ্যকার কয়েকটি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ডুমুরিয়ার হাট, ফুলতলার হাট, পাইকগাছার গড়ইখালি বাজার, দাকোপের চালনা ও বাজুয়া বাজার, বটিয়াঘাটার জলমার হাট ও বারোয়াড়িয়া বাজার, ফকিরহাটের ফয়লা বাজার, যশোরের নোয়াপাড়া বাজারসহ কয়েকটি স্থানের হাট-বাজারে কাজের সন্ধানে ভোরেই ক্ষেতমজুরেরা সমবেত হন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানান, হাট গুলো সপ্তাহে দুই দিন বসে। তখন কাজের সন্ধানে মজুরের জন বিক্রির জন্য হাটে ওঠেন। এখন হাটে তাদের ছয় দিনের মজুরি তিন হাজার থেকে ৩ হাজার ৫শ’ টাকা। মৌসুমের শুরুতে ছিল ২৫শ’-২৬শ’ টাকা। বিভিন্ন স্থানের জমির মালিক কৃষক ও ক্ষেতমজুরেরা এসব কথা বলেছেন।
বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতি’র খুলনা জেলা সাধারণ সম্পাদক অশোক সরকার দৈনিক জন্মভূমিকে বলেছেন, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় পাঁচ থেকে সাত হাজার ক্ষেতমজুর আছেন। অন্য উপজেলার প্রত্যেকটিতে গড়ে তাদের সংখ্যা এক থেকে দেড় হাজার। তাদের যেমন নিয়মিত কাজের নিশ্চয়তা নেই, তেমনি জমির মালিকেরা মারাত্মকভাবে শ্রম শোষণ করছেন। অভাব-অনাটনের সাথে লড়াই করে তারা প্রাণে বেঁচে আছেন। শ্রম শোষণ নিরসনে তিনি শ্রম পরিচালকের দায়িত্বশীল হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
ক্ষেতমজুর নেতা অশোক বলেন, অধিকাংশ সময় তাদের প্রতিদিনের মজুরি ৩শ’ টাকায় থমকে থাকে। ফসলের রোপন এবং কর্তনের ভরা মৌসুমে তাদের মজুরি বাড়ে, তবে ওই বর্ধিত মজুরির স্থায়িত্ব দুই সপ্তাহের বেশি হয় না। বিদ্যমান বাস্তবতায় তিনি ক্ষেতমজুরদের জন্য পল্লী রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন।
খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, জেলার নয় উপজেলাসহ মেট্রো অঞ্চলের দুই থানা এলাকায় ৯২ হাজার ৭শ’ ১৯ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। নভেম্বর থেকে রূপসা, তেরখাদা, দিঘলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে ধান কাটা শুরু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ২১ হাজার ৩শ’ ২৫ হেক্টর জমির ফসল কর্তন শেষ হয়েছে। কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় পরিপূর্ণভাবে ধান কাটা শুরু হতে দেরি হয়। কৃষকের শতভাগ ফসল ঘরে তুলতে আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লাগবে।
তিনি দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, হাইব্রিড জাতে ৪ দশমিক ২ টন, উফশি জাতে ৩ দশমিক ২ টন এবং স্থানীয় জাতে এক দশমিক ৪ টন প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে। এ হিসাব ধানে নয় চাল উৎপাদনে। এই ফলন আশানুরূপের থেকে বেশি বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।