মোঃ ইলিয়াস ফকির : যুগ-যুগ ধরে অশুভ শক্তি নাশিনী, অসুর দলনী, কুপ্রবৃত্তি বিনাশিনী, আদ্যাশক্তি কুন্ডলিনী, মোহ তামস বিদুরিনী, দশভুজা ত্রিনয়নী, জগজ্জননী শ্রীশ্রীদুর্গা মাতা। স্বীয় তেজদীপ্ত মুরতী, চক্রধারিনী, মঙ্গল দায়িনী, ত্রিতাপ হরনী, মহাময়ী মোহিনী রূপে জগৎপুজ্য বাৎসল্যময়ী মা। অগনিত সন্তান তব করুণা মানসে অশ্রু সিক্ত নয়নে ভক্তি চিত্তে প্রনমে যুগল চরণ ৷ দাও মা ভক্তি- দাও মা শক্তি, সকল অপশক্তিকে পরাভূত করে বিশ্ব মানব সন্তানের মনে দাও শান্তির অমীয় ধারা। জাগ্রত কর সকলের ভিতরে ভ্রাতৃত্ব ও মনুষ্যত্ববোধ। শরতের নীল গগনে ভেসে যাওয়া শুভ্র মেঘমালার মত সকল মানব হৃদয়ে ছুয়ে যাক আনন্দ পরশ, সকল মানব চিত্ব কর মনোরম। অগনিত ভক্ত সন্তানদের অকাল আহবানে স্বর্গলোক ছাড়ি, শরৎ শিশিরে বিদৌত পদযুগল নিয়ে এসো ধুলির ধরাধাম এই মাটির মর্তে। কেননা, যুগে-যুগে তোমার ভক্তপ্রাণ সন্তানেরা অশুভ শক্তির চক্রান্তে পড়ে অত্যাচারিত, নিপীড়িত ও নিগৃহিত হয়েছে, তখন সকল নিরাশার মাঝেও তোমার করুনা কামনা করে দুরাচার দমনে শেষ ভরসা হিসেবে অশ্রু সিক্ত নয়নে তব চরনে করে মিনতী। বিনয়ী চিত্তে ব্যক্ত করে মনের দুঃখ কষ্ট বেদনা। একমাত্র তুমিই পার মা, সকল অপশক্তির অবসান ঘটিয়ে মানব মনে শান্তি ফিরিয়ে দিতে। অন্যায় অবিচার দুরিভুত করে ন্যায়নীতি ও সততা প্রতিষ্ঠিত করতে। শাস্ত্র অনুসারে অনেক ভক্তের মনোবাঞ্ছা তুমি পুর্ন করেছো। তবে হ্যা, দেব-দেবী বা কোন সাধু-মহাপুরুষ কর্তৃক এরূপ কিছু পাইতে হলে, বিশ্বাস ভক্তি প্রেম আবেগে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জল ভরা নয়নে করজোড়ে প্রর্থনা জানাতে হবে। সকল আমিত্ব অহংকার ত্যাগ তরে অনুরূপ প্রার্থনা না জানালে কৃপাদৃষ্টি লাভ করা কোন জীবের পক্ষে সম্ভব নয় । কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলেও আমার দৃষ্টিতে, অধিকাংশ পূজা মন্দিরে পূজারীগনের এই অবস্থা একেবারেই অনুপস্থিত। একাধিক পুরানে উল্লেখ আছে, দেবীর তিনবার অকাল বোধন হয়ে ছিল। তার পর থেকে অকাল বোধনই দুর্গাপূজার রীতি হিসেবে গৃহিত হয়। প্রথমতঃ সৃষ্টির আদিলগ্নে, বিশ্ব চরাচরে অকুল জলরাশি ভিন্ন আর কিছু ছিলনা, তখন সেই জলেই অনন্ত নাগের শয্যায় নিদ্রিত ছিলেন ভগবান শ্রীবিষ্ণু। তিনি মহামায়ার মায়া প্রভাবে নিদ্রিত ছিলেন বলে দেবীর এক নাম বিষ্ণুমায়া। এ সময় বিষ্ণুর কর্ণমূল থেকে জন্ম নেয় দুই ভয়ংকর দানব, মধু ও কৈটভ। তারা জন্ম নেবার পর দেবতাদের বিনাশ করতে উদ্যত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে মহামায়ার শ্মরণাপন্ন হন সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং ব্রহ্মা। তাঁর স্তব-স্তুতিতে প্রসন্ন হয়ে আপন মায়া সংবরণ করে বিষ্ণুকে জাগ্রত করলেন। তারপর বিষ্ণু এই দানবদেরকে হত্যা করে সৃষ্টি রক্ষা করেন। ব্রহ্মার আহ্বানই ছিল দেবীর প্রথম অকাল বোধন। দ্বিতীয়তঃ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, চন্দ্রবংশীয় রাজা সুরথ শত্রুগণ কর্তৃক পরাজিত হয়ে এবং সমাধি বশ্য নামক ব্যক্তি আত্মজনের নিপীড়নে গৃহত্যাগী হয়ে গভীর বনে বেতসা নদীর তীরবর্তী মেধস মুনির আশ্রমে আশ্রয় নেন। রাজা সুরথ ও সমাধিবশ্য বিনয়ের সাথে তাদের অবস্থার কথা মুনীবরকে অবগত করলেন। অতঃপর মুনীর উপদেশে (চণ্ডিকা) শ্রীদুর্গাদেবীর পূজা করেন মাটির মুর্তিতে এবং পূজা সমাপনে দেবী প্রতিমা বিসর্জন দিয়েছিলেন বেতসা নদীতে। মাতৃ কৃপায় তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, সর্ব প্রথম মাটির প্রতিমায় এই পূজা হয়েছিল এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর অববাহিকায় সন্যাসী পাহাড়ে বেতসা নদীর তীরে করাল ডাঙ্গায় মেধস মুনীর আশ্রম ছিল। আর এই পাহাড়ে মার্তণ্ডেয় মুনী মার্কণ্ডেয় পুরাণ লিখে ছিলেন। সেজন্য বাংলাদেশ তথা বাংলা ভাষাভাষি মানুষের নিকট অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। তৃতীয়তঃ দশানন রাবনের কবল থেকে আপন সহধর্মীনী সীতাকে উদ্ধার করার জন্য এই অকাল বোধন করেন শ্রীরামচন্দ্র। রাম, লক্ষন এবং বানরসেনাদের বিক্রমে রাক্ষসদের কাবু করা গেলেও কোন ভাবেই রাবনকে বধ করা সম্ভব হচ্ছিলনা। রাবনের পরমারাধ্য মৃত্যুঞ্জয় মহেশ্বর এবং কুলদেবী মহেশ্বরীই রাবনকে অবধ্য রেখেছিল। যে কারণে ব্রহ্মাসহ সকল দেবকুল মহাদেবীর কঠোর আরাধনায় ব্রতী হন। আরাধনায় প্রীত হয়ে মহামায়া শ্রীরামচন্দ্রকে দেখা দিয়ে বলে ছিলেন, শারদীয় ষষ্ঠি তিথির পুন্যলগ্নে বিশ্ববৃক্ষের তলায় দেবীর বোধন করলে দেবী জাগরিতা হয়ে তাদের প্রার্থনা শুনবেন। যথা সময় বোধনান্তে জাগরিতা হয়েছিলেন মহামায়া। স্বয়ং ব্রহ্মা দেবীকে অনুরোধ করেছিলেন রামচন্দ্রকে কৃপা করার জন্য। প্রত্যুত্তরে দেবী জানিয়ে ছিলেন, তিনি সপ্তমীতে রামের ধনুর্বানে প্রবেশ করবেন, অষ্টমীতে হবে রাম রাবনের মহাসংগ্রাম এবং অষ্টমী নবমীর মহাসন্ধিক্ষনে রাবনের দশ মুন্ডু ভুপাতিত হবে। দশমীতে দেবী প্রত্যাবর্তন করবেন শিবলোকে। সীতা উদ্ধারের পর হবে বিজয় উৎসব। উল্লেখ্য, বিধিমতে কেবল বিজয়া দশমীতেই আনন্দ উৎসব করার কথা বলা হয়েছে, গত চার দিনে নয়। দেবীর সমস্ত অকালবোধন বা দুর্গাপূজা যে কোন বিপদ হতে মুক্তি লাভের জন্য অয়োজন করা হয়। স্বয়ং ব্রহ্মা এবং ত্রিতাযুগে রামচন্দ্র অবতার হয়েও বিপদে দেবীর করুণা প্রাপ্তির আশায় স্ববিনয়ে আরাধনা করেছেন। অতএব এ তিনদিন উৎসব করার কোন বিধান নেই। দেবী পুরানেও নির্দেশ রয়েছে, বর্ষে-বর্ষে বিধাতবং স্থাপনঞ্চ বিসর্জনমঃ। অর্থাৎ প্রতি বছর দেবীর স্থাপন ও বিসর্জন শাস্ত্র নির্দিষ্ট বিধান। বিসর্জন দুঃখের হলেও এদিন আনন্দ করার স্পষ্ট বিধান রয়েছে। মনে হতে পারে, দেবীর বিসর্জন মানে মন ও সমাজ জীবনে অন্ধকার নেমে আসা, তা হলে এত বাদ্যি-বাজনা বা শোভা যাত্রার প্রয়োজন কি ? এ ক্ষেত্রে কালিকা পুরানে বলা আছে, শঙ্খতুর্য নিনাদৈশ্চ মৃদঙ্গপটলেস্তথা, ধুলালিকদম বিক্ষেপৈঃ ক্রীড়য়েদ যুগলংজনঃ। অর্থাৎ বিসর্জনে শাখ বাজবে, তুর্যনিনাদ হবে, মৃদঙ্গ বাজবে, কাদা-মাটি ছোড়াছুড়ি করে খেলা করবে, চোখের জল লুকিয়ে সন্তানেরা কোলাকুলি ও মিষ্টি মুখ করবে সন্তানদের বিষণ্ন মুখ দেখলে মা কি শান্তি মনে যাত্রা করতে পারে? দশমীলগ্নে অপরাজিতা পূজার শেষ মন্ত্রে মাকে মিনতী করে বলা হয়, সংবৎসর ব্যতিতে তু পুনরাগমনায় চঃ। মানে মায়ের আবার আসার কথা, তাই মায়ের যাওয়া পুনরাগমনের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ ।
কিন্তু বর্তমান পূজা, বিশেষ করে শহরে গতবছর বেশ কয়েকটি পূজা মণ্ডপের বাস্তবতা দেখে মনে হল, পূজা কেবল পূজাক্ষনে পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ, আর সকলই উৎসব। সমাজে সজ্জন হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মানসে পূজার আয়োজক পূজার কর্তা সেজে ভাব গম্ভীর্য নিয়ে বসে থাকেন, শত-শত দর্শনার্থীরা তাকে প্রনাম করছে, মনে হয় তাঁর কৃপাবলে সুযোগ হয়েছে স্বর্গীয় মায়ের মুরতি দর্শন। সে যে যাই মনে করে করুক না কেন, পূজাতো হচ্ছে। পূজা না হয় উৎসব তো হচ্ছেই। দুঃখের বিষয় হল, যখন কোন পূজা মণ্ডপে যাই, শ্রীশ্রীদুর্গা মায়ের তেজদীপ্ত মাধুর্যময় মুরতী দর্শনে মনের মধ্যে বাৎসল্য প্রেমে মাতৃভক্তির আবেগ নেমে আসে, মায়ের কৃপাগুন শ্মরণে চোখ ছল-ছল হয়ে ওঠে। কিন্তু শ্রবনে সেই সকল প্রেম ভাব মুহুর্তে ম্লান হয়ে যায় । এ যেন দর্শনে বৃষ্টি আর শ্রবনে প্রচণ্ড রোদ। এক সঙ্গে চলছে রোদ বৃষ্টির মহড়া। যখন চোখ জুড়ায় অসুর দমনী কৃপাময়ী মায়ের দর্শনে, তখন শ্রবনে আসে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক কিছু গান বা মিউজিক। যেমন, পাগলু-পাগলু ওমাই পাগলু অথবা ফাগুনি পুর্নিমা রাতে চল পালায়ে যাই ইত্যাদি। আবার এ সকল গানের সাথে ছেলে-মেয়েদের অস্বাভাবিক ও কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি দেখলে মনে হয়, এখন আর পূজা বলতে কিছু নেই, এটা কেবলই উৎসব। কিশোর বয়সে যখন গ্রামে পূজা দেখতে যেতাম, সে সময়ে পূজাক্ষণে ভক্তদের নীরবতা, পূজার বিরতিক্ষনে স্থানীয় শিল্পীদের কণ্ঠে বিভিন্ন লোকসুরে মায়ের ভজনগান, শ্যামাসঙ্গীত ও ভক্তিমূলকগান গাইতো। ভক্তগন মাতৃপ্রেম আবেগে অশ্রুবন্যায় ভেসে একে অপরের সাথে কোলাকুলির মাধ্যমে আত্ময়-আত্ময় ভাব বিনিময় করতেন। অনেকে জীবনের কৃতকর্মের অনুশোচনায় অনুতপ্ত হয়ে মণ্ডপের মেঝেতে গড়াগড়ি যেত। দর্শনার্থীরা দর্শন এবং শ্রবনে প্রেম-ভাবে একাকার হত। এরূপ প্রেম-ভাবে উদ্ভাসিত হতো প্রতিটি পূজামণ্ডপের পরিবেশ। বোধ করি এমন পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমেই হয় মায়ের প্রকৃত পূজা। এজন্য সকল পূজার আয়োজক বা পূজা কমিটির প্রতি বিবেচনার জন্য আমার বিনম্র আহবান, প্রতিটি পূজামণ্ডপে এমন পরিবেশ তৈরী করা যায় কি-না ? পরিশেষে বলতে চাই, ১৪২০ সালে মাযের অকাল বোধন ও মর্তে আগমন এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে। কারণ আর কিছু দিন পরেই আমাদের জাতীয় নির্বাচন। অনেক অপশক্তির আস্ফালনে ধরা কম্পিত, জনগন শংকিত। আমরা ভক্তপ্রাণ সন্তানেরা বিশ্বাস করি, তোমার তেজস্ক্রীয়া দ্বারা সকল অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে, একটি শুভ ও মঙ্গলদায়ক শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করবে আমাদের জাতীয় জীবনে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে, কালিকা পুরাণে ও চণ্ডিকা পুরাণেও এসবের বিশেষ ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যায়। অতএব-শ্রীশ্রীদুর্গা মায়ের চরণে ভক্তি অঞ্জলি রেখে এই প্রার্থনা করি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সকলের মধ্যে যেন শুভ বুদ্ধির উদয় হয়, প্রতিটি প্রাণে যেন সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতি জাগরিত হয়, মায়ের আগমন ও বিসর্জন শুভ হোক, কায়মনে এই প্রত্যাশা করি। ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩।
লেখকঃ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব