
জন্মভূমি ডেস্ক : বাংলাদেশ সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে দামি চিনি উৎপাদন করে। কারণ রাষ্ট্রীয়-মালিকানাধীন চিনিকলগুলোতে পণ্যটির উৎপাদন খরচ প্রতি কেজিতে ৩০০ টাকা, যা বিশ্বের বৃহত্তম দুই চিনি উৎপাদনকারী দেশ ব্রাজিল ও ভারতের খরচের সাতগুণ। ভারত ও ব্রাজিলে প্রতি কেজি কাঁচা চিনির উৎপাদন খরচ যথাক্রমে ৪৫ ও ৪০ টাকারও কম।
দশকের পর দশক ধরে লোকসান দিয়ে আসা দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোকেও সম্ভবত পাটকলগুলোর মতোই বেসরকারি খাতের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশনা সেদিকেই ইঙ্গিত করে।
কয়েক দশক ধরে অসংখ্যবার পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সরকার এখন গুরুত্ব দিয়ে চিনি ব্যবসা থেকে সরে যাওয়ার কথা ভাবছে। এ ব্যবসায় এখন মূলত বেসরকারি আমদানিকারক ও পরিশোধনকারীদের আধিপত্য। গত ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লোকসান করা পাটকলগুলোকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের স্বেচ্ছা অবসর মাধ্যমে বেসরকারি খাতে পরিচালনার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে চিনিকলগুলোর জন্যও একই কৌশল গ্রহণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর করা সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, তিনি প্রায় ২৬ হাজার পাটকল শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক পদ্ধতির মাধ্যমে অবসরে পাঠানোর পর লোকসানে থাকা পাটকলগুলোকে বেসরকারি খাতে ছাড়ার সফল ব্যবস্থাপনা তুলে ধরেন। বাংলাদেশ সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে দামি চিনি উৎপাদন করে। কারণ রাষ্ট্রীয়-মালিকানাধীন চিনিকলগুলোতে পণ্যটির উৎপাদন খরচ প্রতি কেজিতে ৩০০ টাকা, যা বিশ্বের বৃহত্তম দুই চিনি উৎপাদনকারী দেশ ব্রাজিল ও ভারতের খরচের সাতগুণ।
সরকারি চিনিকলগুলো দেশের চিনির মোট চাহিদার মাত্র ১ শতাংশ পূরণ করে দেশের বার্ষিক চিনির চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। সরকারি চিনিকলগুলোর তাদের ব্যাংকঋণের বোঝা ৯ হাজার ২৯১ কোটি টাকা এবং পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। মিলগুলোকে শ্রমিকদের মজুরি ও কৃষকদের আখের বিল পরিশোধের জন্য প্রতি বছর সরকারি সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয়। এ খাতে একমাত্র মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। তা-ও চিনি থেকে নয়, প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা করে ডিস্টিলারি ইউনিটে তৈরি মদ থেকে। মূলত বিদেশিদের কাছে এই মদ বিক্রিতে উচ্চ শুল্কের কারণেই লাভে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
লোকসানের কারণে ২০২২ সালে ২৫টি রাষ্ট্রীয়-মালিকানাধীন পাটকল বন্ধ করে দেয় সরকার। এর মধ্যে ১৬টি পাটকল বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়া হয়েছে। ইজারা দেওয়া পাটকলগুলোর মধ্যে পাঁচটি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন শুরু করেছে। এছাড়াও বর্তমানে বেশ কয়েকটি পাটকলের বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া চলছে।
ব্যাপক লোকসানের কারণে ২০২০ সালে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের বিএসএফআইসি অধীন ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে দুটি চিনিকল শ্যামপুর ও জিল বাংলা—স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত। এছাড়াও বিএসএফআইসির আওতাধীন চিনিকলগুলোর খুচরা যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রেনউইক, যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোংও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবা দায়িত্ব হলে চালু থাকা চিনিকল ও সংশ্লিষ্ট মিলগুলোসহ এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৮ হাজার ৬৮১ জন শ্রমিক ও কর্মকর্তার পরিণতিও রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর মতোই হবে।
বিএসএফআইসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৯টি চিনিকল চালু রয়েছে। এর মধ্যে গত অর্থবছরে ৮টি কলের মোট লোকসানের পরিমাণ কয়েকশো কোটি টাকা। কেবল কেরু অ্যান্ড কোম্পানির পুঞ্জীভূত মুনাফার পরিমাণ ১৯৩.৫ কোটি টাকা।
এ অবস্থায় আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়কে সুদ মওকুফের অনুরোধ জানিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। বর্তমানে এ সুদের পরিমাণ চিনিকলগুলোর ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের দ্বিগুণে গিয়ে ঠেকেছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক, অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারের উচিত এ ধরনের ধুঁকতে থাকা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকা।
তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারিকরণ একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে, যা ব্যাংক ও রাষ্ট্র উভয়ের জন্যই লাভজনক হবে।
তবে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিএসএফআইসি ধুঁকতে থাকা চিনিকলগুলো নতুন উদ্যোমে শুরুর ও এগুলোতে উৎপাদন বাড়ার বিষয়ে আশাবাদী।
চিনিকলগুলোর ভবিষ্যতের বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের যে সভায় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন, তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।
আগামী বছর থেকে চিনিকলগুলো ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছি। সেজন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। গত বছরের চেয়ে এবার ১০ হাজার টন বেশি আখ উৎপাদন হয়েছে। আগামী বছর উৎপাদন আরও বাড়াতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতেই বেসরকারি খাতের সহযোগিতায় ৩০-৪০ বছরের পুরনো যন্ত্রপাতি পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাই লোকসানে থাকা চিনিকলগুলোকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেওয়ার কোনো পরিস্থিতি নেই।
বিএসএফআইসির চেয়্যারম্যান শেখ শোয়েবুল আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সভায় লোকসানে থাকা চিনিকলগুলোর বিষয়ে কী নির্দেশনা দিয়েছেন, তা আমার জানা নেই। শিল্প সচিবের নির্দেশে টেকসই করা সম্ভব, এমন চিনিকলগুলো চালু রাখার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এজন্য ইতিমধ্যে আখ উৎপাদন বাড়াতেও বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শিল্প মন্ত্রণালয় যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন ও অন্যান্য উদ্যোগের মাধ্যমে জরাজীর্ণ মিলগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা চালিয়েছে। গত বছর, জাপান, থাইল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ইউএই থেকে তিনটি কোম্পানির একটি কনসোর্টিয়াম তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছিল। ওইসব উদ্যোগের কোনোটিই তেমন এগোয়নি।
বিএসএফআইসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো ২১ হাজার ৩১৩ টন চিনি উৎপাদন করেছে। ছয়টি মিল বন্ধ হওয়ার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে চিনির উৎপাদনও ছিল বেশি, ৮২ হাজার টন।
মোটা অঙ্কের ঋণের বোঝা এবং বর্ষা মৌসুমে আখ মাড়াই করার সময় চিনিকলগুলো মাত্র তিন-চার মাস চালু থাকলেও সারা বছরই কর্মচারীদের রাখতে হয়। এতে বছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লোকসান গুনতে হয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, চিনিকলগুলোতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকের সংখ্যা ঋণের সুদসহ লোকসান হিসাবে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ ৩০০ টাকারও বেশি।
অন্যদিকে ভারতে প্রতি টনে কাঁচা চিনির উৎপাদন খরচ ৪০৭ ডলার, ব্রাজিলে ৩৫১ ডলার অর্থাৎ কেজিপ্রতি যথাক্রমে ৪৫ ও ৪০ টাকারও কম। ব্রাজিলের চিনির বাজার গবেষণা সাইট স্যাপের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক চিনি উৎপাদনের ৪০ শতাংশ আসে এ দুই দেশ থেকে।
চড়া উৎপাদন খরচের ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত মিলে উৎপাদিত চিনি বেসরকারি পরিশোধনাগারের চিনির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে না। বাজারের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি মিলগুলোতে উৎপাদিত চিনির খুচরা মূল্য প্রতি কেজি ১৬৫ টাকা অর্থাৎ উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম, কিন্তু বেসরকারি চিনিকলের চিনির চেয়ে অনেক বেশি।

