জন্মভূমি রিপোর্ট : দৈনিক জন্মভূমি’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, খুলনা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক হুমায়ূন কবীর বালু হত্যাকাণ্ডের পর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের হওয়া মামলার পাঁচ আসামির যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড হলেও নেপথ্যের কুশীলবরা পর্দার অন্তরালেই থেকে গেছে। পুলিশের দুর্বল তদন্ত রিপোর্টের কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল-এর বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর আরিফ মাহমুদ লিটন মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেন, দীর্ঘসময় ধরে পুলিশ মামলাটির তদন্ত এবং অধিকতর তদন্ত করেও নির্মম ওই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী ও অর্থ যোগানদাতাদের খুঁজে বের করতে পারে নি। তাদের তদন্ত কাজে দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের ছাপ সম্পূর্ণভাবে ফুটে ওঠেনি।
পিপি এডভোকেট লিটন বলেন, সাংবাদিক নেতা হুমায়ূন কবীর বালু খুনের পর হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের হওয়া পৃথক দু’টি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিরা একই। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলার রায় ঘোষিত হওয়ার আগে অপর একটি আদালতে হত্যা মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন হয়। সেই আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় আসামিরা খালাস পায়। বিস্ফোরক আইনের মামলায় আদালত আসামিদের সাজা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ে সন্তুষ্ট। ন্যায় বিচার নিশ্চিত হয়েছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল-এর বিচারক মোঃ সাইফুজ্জামান হিরো গত ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি মামলার পাঁচ আসামিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। একই সাথে তিনি প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড করেন।
সাজাপ্রাপ্তরা হলো, স্বাধীন ওরফে সৈয়দ ইকবাল হোসেন, নজু ওরফে খোড়া নজু ওরফে নজরুল ইসলাম, রিমন ওরফে আসাদুজ্জামান, জাহিদ ওরফে সবুজ ওরফে জাহিদুর রহমান এবং মাসুম ওরফে জাহাঙ্গীর। চার ঘাতক কারাগারে থাকলেও মাসুম পলাতক রয়েছে। সে রূপসা উপজেলার রহিমনগর গ্রামের জনৈক আবু তাহেরের ছেলে। ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে সাজা উল্লেখ করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। এই পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে গত ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল।
২০০৪ সালের ২৭ জুন, সকাল আনুমানিক ১০ টা। মেয়ে টুম্পা এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখায় হুমায়ূন কবীর বালু তার সন্তানদের নিয়ে মাকে মিষ্টি খাওয়াতে ইকবাল নগরস্থ বাসায় যান। দুপুর ১২ টার পরে তিনি সেখান থেকে জন্মভূমি ভবনের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। (খুলনা মেট্রো খ-১১-০০৫২) নাম্বারের প্রাইভেট কার থেকে তার বড় ছেলে আসিফ কবীর, মেয়ে হোসনে মেহেরুবা টুম্পা, ছোট ছেলে আশিক কবীর এবং ড্রাইভার নাছিম প্রথমে নামেন। এরপর তিনি গাড়ী থেকে নেমে অফিস ও বাসভবনের ক্লবসিবল গেটের সামনে পৌছানো মাত্রই ঘাতকেরা তার পেছন দিক থেকে বোমা চার্জ করে। বোমার আঘাতে তার কোমর, পেটে ও পায়ে গুরুতর জখম হয়। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুর দেড়টার দিকে তার মৃত্যু হয়। মামলার নথি থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানান, ঘটনার পরদিন ২৮ জুন খুলনা সদর থানার উপ-পরিদর্শক মারুফ আহম্মদ ১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১০-১২ জন আসামির বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আইনের ৩, ৪ ও ৬ ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তভার থানা পুলিশের হাত ঘুরে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপর বর্তায়। ২০০৪ সালের ৮ আগস্ট ডিবি’র পরিদর্শক শেখ মহিউদ্দিন চৌধুরী আট জন আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ছয় জনকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতির আবেদন জানান। আদালত চার্জশিট গ্রহণ করে বিচার কাজ শুরু করেন। বিচারের একপর্যায়ে আদালতের এপিপি’র এবং নিহতের ছেলে আসিফ কবীরের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি খুলনা জোনকে নির্দেশ দেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে সিআইডি’র সাত জন কর্মকর্তা তদন্ত করেছেন। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর সিআইডি’র এএসপি মোঃ শাহাদৎ হোসেন আদালতে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। আসামি সাইদুর রহমান, বাবুল, মোঃ সেলিম এবং নাসির খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি উল্লেখ করে তদন্ত কর্মকর্তা তাদেরকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন। আদালত ওই আবেদন মঞ্জুর করেন।
সূত্রমতে, আসামি মোঃ রিপন আহম্মেদ ওরফে সোয়েব, সুমন ওরফে শরিফুজ্জামান, আঃ রশিদ তপন ওরফে দাদা তপন ওরফে আঃ রশিদ মালিথা ওরফে ইমন, বিডিআর আলতাফ ওরফে সিদ্দিক এবং শ্যামল ওরফে দিদার ওরফে দিদারুল ইসলাম বিভিন্ন সময় পুলিশ ও র্যাবের সাথে এনকাউন্টারে মারা গেছে।
সূত্রমতে, ট্রাইব্যুনাল গত ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করেছিলেন। ওই দিন রায় ঘোষণার তারিখ পিছিয়ে ১৬ মার্চ করা হয়। রায় প্রস্তুত না হওয়ায় সেদিন তারিখ পিছিয়ে ২৪ মার্চ পুনরায় দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর করোনা ভাইরাসজনিত উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ২৯ এপ্রিল রায়ের জন্য আদালত দিন ধার্য করেছিলেন। মহামারি করোনার কারণে ওই বছর ২৫ মার্চের পর থেকে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় রায় ঘোষণার কাজ ঝুলে ছিল। পরবর্তিতে ৮ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণার দিন ধার্য হয়। সে দিন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পুনরায় বিচারিক কার্যক্রম শুরুর আবেদন করেন।
সূত্র জানান, ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি আরিফ মাহমুদ লিটন পুনরায় বিচার কাজ শুরুর আবেদনে উল্লেখ করেছিলেন-মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় নি। হত্যাকাণ্ডের অনেক আলামত আদালতে উপস্থাপন হয় নি। এ অবস্থায় রায় ঘোষিত হলে রাষ্ট্রপক্ষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আদালত তার আবেদন মঞ্জুর করে পুনরায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেছিলেন। আদালতের বিভিন্ন কার্যদিবসে চার্জশিটভুক্ত ৫৮ জন সাক্ষীর মধ্যে আট জন সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত