দৈনিক জন্মভূমি’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, খুলনা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক হুমায়ূন কবীর বালু হত্যাকাণ্ডের বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের হওয়া মামলার পুনরায় বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত ৮ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণার নির্ধারিত দিনে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল-এর বিচারক মোঃ সাইফুজ্জামান হিরো ২২ সেপ্টেম্বর থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর জন্য দিন ধার্য করেন। মঙ্গলবার নির্ধারিত দিনে মামলার এজাহারকারী পুলিশ পরিদর্শক মারুফ আহম্মদ সাক্ষ্য দিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর আরিফ মাহামুদ লিটন পুনরায় বিচার কাজ শুরুর আবেদনে উল্লেখ করেছিলেন-মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় নি। হত্যাকাÐের অনেক আলামত আদালতে উপস্থাপন হয় নি। এ অবস্থায় রায় ঘোষিত হলে রাষ্ট্রপক্ষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আদালত তার আবেদন মঞ্জুর করে পুনরায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেন। ট্রাইব্যুনাল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানান, মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ১২ টা থেকে একটা পর্যন্ত মামলার এজাহারকারী ইন্সপেক্টর মারুফ তার সাক্ষ্য প্রদান করেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন-সাংবাদিক হুমায়ূন কবীর বালু তার সম্পাদিত দৈনিক জন্মভূমি ও রাজপথের দাবী পত্রিকায় তৎকালীন সময়ে দক্ষিণাঞ্চলে সক্রিয় চরমপন্থী দলগুলোর রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ে লেখালেখি করতেন। ওই সব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও সেমিনারে বক্তব্য রাখতেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এমএল জনযুদ্ধের সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যার টার্গেট করে। চরমপন্থীরা ওই সময় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের টার্গেট করে খুন করে। এ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমাম এবং সাংবাদিক মানিক সাহাকেও তারা একইভাবে হত্যা করে। অকুস্থল ও আশ-পাশ থেকে বাদাম বিক্রির ঝুড়ির মধ্য থেকে দু’টি তাজা বোমা, বিস্ফোরিত বোমার স্প্লিন্টারের ১৯ প্রকার আলামত জব্দ করার কথা তিনি সাক্ষ্য দেওয়ার সময় উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে আসামি পক্ষের দু’ আইনজীবী তাকে জেরা করেন।
সূত্রমতে, এর আগে ট্রাইব্যুনাল গত ২৫ ফেব্রæয়ারি রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করেছিলেন। ওই দিন রায় ঘোষণার তারিখ পিছিয়ে ১৬ মার্চ করা হয়। রায় প্রস্তুত না হওয়ায় সেদিন তারিখ পিছিয়ে ২৪ মার্চ পুনরায় দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর করোনা ভাইরাসজনিত উদ্ধুত পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ২৯ এপ্রিল রায়ের জন্য আদালত দিন ধার্য করেছিলেন। মহামারি করোনার কারণে গত ২৫ মার্চের পর থেকে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় রায় ঘোষণার কাজ ঝুলে ছিল। পরবর্তীতে ৮ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণার দিন ধার্য হয়।
এই মামলার আসামি স্বাধীন ওরফে সৈয়দ ইকবাল হোসেন, নজু ওরফে খোড়া নজু ওরফে নজরুল ইসলাম, রিমন ওরফে আসাদুজ্জামান এবং জাহিদ ওরফে সবুজ ওরফে শাহিদুর রহমান জামিনে আছে। আরেক আসামি মাসুম ওরফে জাহাঙ্গীর আদালত থেকে জামিনে মুক্তির পর থেকেই পলাতক রয়েছে। এই পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জননিরাপত্তা বিঘœকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল-এর উচ্চমান বেঞ্চ সহকারী মোঃ ছায়েদুল হক শাহিন দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, আদালতের বিভিন্ন কার্যদিবসে চার্জশিটভুক্ত ৫৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ সেপ্টেম্বর মামলার বাদী ও এর আগে তিন জন সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। আগামী ১৩ অক্টোবর আদালত পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেছেন। নিহতের পরিবারের সদস্যসহ স্থানীয় কয়েকজন এবং চিকিৎসকের সাক্ষ্য প্রদানের জন্য প্রসেস ইস্যু করা হয়েছে।
২০০৪ সালের ২৭ জুন, সকাল আনুমানিক ১০ টা। মেয়ে টুম্পা এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখায় হুমায়ূন কবীর বালু তার সন্তানদের নিয়ে মাকে মিষ্টি খাওয়াতে ইকবাল নগরস্থ বাসায় যান। দুপুর ১২ টার পরে তিনি সেখান থেকে জন্মভ‚মি ভবনের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। (খুলনা মেট্রো খ-১১-০০৫২) নাম্বারের প্রাইভেট কার থেকে তার বড় ছেলে আসিফ কবীর, মেয়ে হোসনা মেহেরুবা টুম্পা, ছোট ছেলে আশিক কবীর এবং ড্রাইভার নাছিম প্রথমে নামেন। এরপর তিনি গাড়ি থেকে নেমে অফিস ও বাসভবনের ক্লবসিবল গেটের সামনে পৌঁছানো মাত্রই ঘাতকেরা তার পেছন দিক থেকে বোমা চার্জ করে। বোমার আঘাতে তার কোমর, পেটে ও পায়ে গুরুতর জখম হয়। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুর দেড় টার দিকে তার মৃত্যু হয়। মামলার নথি থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানান, ঘটনার পরদিন ২৮ জুন খুলনা সদর থানার উপ-পরিদর্শক মারুফ আহম্মদ ১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১০-১২ জন আসামির বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আইনের ৩, ৪ ও ৬ ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তভার থানা পুলিশের হাত ঘুরে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপর বর্তায়। ২০০৪ সালের ৮ আগস্ট ডিবি’র পরিদর্শক শেখ মহিউদ্দিন চৌধুরী আট জন আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ছয় জনকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতির আবেদন জানান। আদালত চার্জশিট গ্রহণ করে বিচার কাজ শুরু করেন। বিচারের একপর্যায়ে আদালতের এপিপি’র এবং নিহতের ছেলে আসিফ কবীরের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি খুলনা জোনকে নির্দেশ দেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে সিআইডি’র সাত জন কর্মকর্তা তদন্ত করেছেন। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর সিআইডি’র এএসপি মোঃ শাহাদৎ হোসেন আদালতে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। আসামি সাইদুর রহমান, বাবুল, মোঃ সেলিম এবং নাসির খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি উল্লেখ করে তদন্ত কর্মকর্তা তাদেরকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন। আদালত ওই আবেদন মঞ্জুর করেন।
সূত্রমতে, আসামি মোঃ রিপন আহম্মেদ ওরফে সোয়েব, সুমন ওরফে শরিফুজ্জামান, আঃ রশিদ তপন ওরফে দাদা তপন ওরফে আঃ রশিদ মালিথা ওরফে ইমন, বিডিআর আলতাফ ওরফে সিদ্দিক এবং শ্যামল ওরফে দিদার ওরফে দিদারুল ইসলাম বিভিন্ন সময় পুলিশ ও র্যাবের সাথে এনকাউন্টারে মারা গেছে।
তদন্তকালে গ্রহণ করা সাক্ষীদের জবানবন্দির উদ্ধৃতি দিয়ে অভিযোগপত্রে লেখা হয়েছে, হত্যাকাÐের কিছু দিন আগে থেকেই হুমায়ূন কবীর বালুকে টেলিফোনে হুমকি দেয়া হচ্ছিল। বিষয়টি তিনি এবং তার ভাই এসএম জাহিদ হোসেন তৎকালীন পুলিশ কমিশনারকে জানিয়েছিলেন। আঁততায়ীদের বোমা হামলায় নিহত আরেক খ্যাতিমান সাংবাদিক মানিক সাহার সাথে নির্ভিক কলম সৈনিক বালুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মানিক সাহা হত্যাকাÐে জড়িতদের বিচারের দাবিতে তিনি সোচ্চার ছিলেন। ওই কেস নিয়ে বালু যেন বাড়াবাড়ি না করেন-সে ব্যাপারে অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তি টেলিফোনে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সাংবাদিক আইয়ুব হোসেনকে হুঁশিয়ারি বার্তা শুনিয়েছিলেন। চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি এমএল জনযুদ্ধের সন্ত্রাসীরা তার উপর ক্ষিপ্ত ছিল। ওই দলের আঞ্চলিক নেতা বিডিআর আলতাফ ঘাতক দলের নেতৃত্ব দেয় বলে গোপন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি মহানগর স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে মামলাটি বিচারের জন্য জননিরাপত্তা বিঘœকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে বদলি হয়ে আসে।