
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : দেশে মোট রফতানিজাত বাগদা চিংড়ির সিংহভাগ উৎপাদন হয় উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায়। চলতি মৌসুমে সরকারিভাবে উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮ হাজার টন। যার বাজারমূল্য ধরা হয়েছে ২ হাজার ৮৪০ কোটি টাকার ওপরে। এরই মধ্যে উৎপাদন লক্ষ্যের ৮০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা মৎস্য অধিদপ্তর।
যদিও গত মৌসুমে জেলায় বাগদা চিংড়ি উৎপাদনের লক্ষ্য ছিল ২৫ হাজার টন, অর্জিত হয়েছিল ২৪ হাজার ৬০০ টনের মতো। এ হিসাবে চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ৩ হাজার টন। তবে এখন পর্যন্ত জেলার লবণ পানির ঘেরগুলোয় যে পরিমাণ বাগদা চিংড়ি দেখা যাচ্ছে, তাতে ২৮ হাজার টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছে মৎস্য বিভাগ।
শ্যামনগর উপজেলা চিংড়ি চাষী পদ্মপুকুর ইউনিয়নের এনামুল ইসলাম বলেন আমার ২৪০ বিঘার চিংড়ি ঘেরে গত মৌসুমীর চেয়ে এবার ৪০ মন বাগদা চিংড়ি বেশি হয়েছে গত মৌসুমের তুলনায় এবার ২৩ লাখ টাকা লাভ বেশি হয়েছে। বর্তমান আগামী বছরের জন্য চিংড়ি চাষ করবো বলে ঘের শুকানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। শ্যামনগর উপজেলার বংশীপুর চিংড়ি ব্যবসায়ী মোড়ল ফিসের স্বত্ব অধিকারী মোঃ আবু ঈসা বলেন গত মৌসুমীর চেয়ে চলতি মৌসুমে আমরা বাগদা চিংড়ি বেশি ক্রয় করেছি। তিনি আরো জানান কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা চিংড়িতে ভেজাল দেওয়ায় বাংলাদেশের চিংড়ির মান বহির বিশ্বে হারিয়ে ফেলেছি সরকারিভাবে এই অবৈধ পন্থায় চিংড়ি বাজার জাতের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে এ ব্যাপারে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা তুষার মজুমদার বলেন চিংড়িতে পুস নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করছি এবং সকলের অবগতির জন্য জানাচ্ছি চিংড়িতে ভেজালের খবর পেলে তাৎক্ষণিক শ্যামনগর উপজেলা মৎস্য অফিসে জানাবেন তিনি আরো বলেন চিংড়ি আমাদের দেশের অর্থনীতির বড় চাকা এটা কে কোনভাবেই বহির বিশ্বে বদনাম করা যাবে না।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিএম সেলিম এই প্রতিবেদককে বলেন, ২০২৪-২৫ মৌসুমে জেলার ছয়টি উপজেলায় ৬০ হাজার লবণ পানির ঘেরে বাগদা চিংড়ি চাষ হচ্ছে। চলতি মৌসুমে সরকারিভাবে রফতানিজাত বাগদা চিংড়ি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮ হাজার টন। কেজিপ্রতি ৯০০ টাকা হিসাবে যার দাম ২ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার অন্তত ৮০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘এখন পর্যন্ত লবণ পানির চিংড়ি ঘেরগুলোয় যে পরিমাণ বাগদা চিংড়ি রয়েছে, তাতে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। গত মৌসুমে জেলায় বাগদা চিংড়ি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫ হাজার টন, অর্জিত হয়েছিল ২৪ হাজার ৬০০ টনের মতো। এ হিসাবে চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ৩ হাজার টন।’
জেলার অধিকাংশ চিংড়িচাষীর অভিযোগ, চিংড়ি রেণুর মান নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রতারিত হচ্ছেন তারা। মানহীন ও জীবাণু বহন করা রেণু পোনা ঘেরে ছেড়ে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষীরা।
আশাশুনি উপজেলার সরাপপুর গ্রামের চিংড়িচাষী রাজ্যেশ্বর দাশ জানান, একটানা প্রায় আড়াই দশক বাগদা চিংড়ি উৎপাদন করেন তিনি। ২০২৪-২৫ মৌসুমেও অন্তত দুই হাজার বিঘা লবণ পানির ঘেরে বাগদা চিংড়ি চাষ করেছেন। তবে চলতি মৌসুমে শুরু থেকে তার ঘেরে ভাইরাস বা অন্য সংক্রামকে প্রচুর চিংড়ি মারা গেছে। মৌসুমের মাঝামাঝি ঘেরে চিংড়ি উৎপাদন বেশ ভালো।
রাজ্যেশ্বর দাশ আরো জানান, মানহীন চিংড়ি রেণু ঘেরে অবমুক্ত করার ফলে চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এসব পোনা ঘেরে ছাড়ার পর বয়স ৩৫-৪০ দিন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারা যাচ্ছে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘেরে চিংড়ি মরার কারণে দিশেহারা চাষীরা। পরবর্তী সময়ে এর কোনো প্রতিকারও পাওয়া যায় না। এভাবেই একেকটি চিংড়ি ঘেরে মোট রেণুর অন্তত ৬৫-৭০ শতাংশ মারা যায়। তার পরও চাষীরা টিকে থাকার লড়াইয়ে উৎপাদন করে চলেছেন। তবে চিংড়ির সঙ্গে সাদা মাছ চাষ করার ফলে কিছুটা লাভবান হচ্ছেন তারা।
চিংড়ির মানহীন রেণুর বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জি এম সেলিম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সরকারিভাবে সাতক্ষীরায় পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। প্রযুক্তিগতভাবে আরো কিছুদিন সময় লাগবে এটি চালু করার জন্য। তখন চাষী চাইলেই চিংড়ির রেণু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পারবেন।’
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ইটাগাছা গ্রামের মাছ চাষী আবু বকর সিদ্দিকী জানান, দেবহাটা উপজেলার শ্যামনগর এলাকায় বাগদা চিংড়ি চাষ করেন তিনি। চলতি মৌসুমেও প্রায় ১০০ বিঘা ঘেরে বাগদা ও গলদা চিংড়ি চাষ করেছেন। গত মৌসুমে একই পরিমাণ ঘেরে চিংড়ি চাষ করে উৎপাদন ও অন্যান্য খরচ তুলেও প্রায় ৬-৭ লাখ টাকা লাভ হয় তার। চলতি মৌসুমেও এ পর্যন্ত ৮০ শতাংশ চিংড়ি বিক্রি করেছেন। বাজারে প্রতি কেজি বাগদা চিংড়ির দাম পাওয়া যাচ্ছে ৯০০-৯২০ টাকা পর্যন্ত। তবে কক্সবাজার থেকে যেসব রেণু সাতক্ষীরায় আসে, তার মান যাচাই করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে উচ্চমূল্যে রেণু কিনে ঘেরে ছাড়ার কিছু দিন যেতে না যেতেই চিংড়ি মরতে শুরু করে। এ জেলায় হাজার হাজার চাষী বাগদা চিংড়ি উৎপাদন করেন। অথচ এখানে সরকারিভাবে কোনো পিসিআর ল্যাব নেই রেণুর মান পরীক্ষা করার জন্য।
সাতক্ষীরা মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুর রব জানান, রফতানির পাশাপাশি দেশীয় বাজারেও বাগদা চিংড়ির চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। বর্তমানে ২৫-৩০ গ্রেডের বাগদা চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৯০০-৯৫০ টাকা কেজি দরে। তবে মাঝেমধ্যে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সাতক্ষীরার চিংড়ির সুনাম নষ্ট হচ্ছে। তিনি রফতানিজাত চিংড়ির আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখতে সংশ্লিষ্টদের আরো উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান।
দেশে মোট রফতানিজাত চিংড়ির একটি বড় অংশ উৎপাদন হয় উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায়। মানসম্মত রেণুর অভাব ও ভাইরাসসহ নানা সংকটের মধ্যেও এখানে প্রতি বছরই উৎপাদন বাড়ছে। সরকারি হিসাবে গত তিন বছরে (২০২২-২৪) এ জেলায় ৭৭ হাজার ৫০১ টন রফতানিজাত বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে। প্রতি কেজি ৮৫০ টাকা হিসাবে এর রফতানি মূল্য দাঁড়ায় ৬ হাজার ৫৮৭ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। তবে প্রকৃত রফতানি মূল্য আরো বেশি বলে জানান চিংড়ি ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে ২০২৪ মৌসুমে ২৬ হাজার ৪৮৫ টন, ২০২৩ মৌসুমে ২৬ হাজার ২১৪ টন এবং ২০২২ মৌসুমে ২৪ হাজার ৮০২ টন রফতানিজাত বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে। এ হিসাবে দুই বছরের ব্যবধানে উৎপাদন বেড়েছে ১ হাজার ৬৮৩ টন।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, সত্তর-আশির দশকের দিকে সাতক্ষীরায় লবণ পানির চিংড়ি চাষ শুরু হয়। বাগদা, গলদা, হরিণা, চাকা ও চেম্বিসহ বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি চাষ হয় এখানে। উৎপাদিত চিংড়ির ৯০ শতাংশ বিভিন্ন দেশে রফতানি এবং বাকি ১০ শতাংশ দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ হয়।
কভিড-পরবর্তী এ জেলায় বাগদা চিংড়ির উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমন রফতানি আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে জেলার চিংড়িচাষীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণসহ সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে বলে জানান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিএম সেলিম। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও জেলায় রফতানিজাত বাগদা চিংড়ির উৎপাদন বেড়েছে। উৎপাদন আরো বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে চিংড়িচাষীদের উন্নত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।’
জেলার দেবহাটা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের হাজী আবুবকর সিদ্দিক ৪০-৪৫ বছর ধরে চিংড়ি চাষের সঙ্গে জড়িত। চলতি মৌসুমে তিনি ১৫০ বিঘার ঘেরে বাগদা চিংড়ি চাষ করেছেন। গত মৌসুমে একই পরিমাণ জমিতে দুই টনের বেশি রফতানিজাত বাগদা চিংড়ি উৎপাদন করেন। এ থেকে প্রায় ৯ লাখ টাকা লাভ হয় তার। তবে মানসম্মত রেণু পেলে উৎপাদন আরো বেশি হতো বলে জানান তিনি।
চিংড়িচাষী আবুবকর সিদ্দিক বলেন, ‘কক্সবাজার থেকে যে চিংড়ি রেণু সাতক্ষীরায় সরবরাহ করা হয় তার ঘেরে অবমুক্ত করার পর ৭০ শতাংশই মারা যায়। তাছাড়া ওইসব চিংড়ি রেণুতে জীবাণু রয়েছে কিনা তা জানার উপায় নেই। সরকারিভাবে পিসিআর ল্যাব না থাকায় পরীক্ষাও করা যায় না। ফলে পোনা উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো যেভাবে রেণু পোনা সরবরাহ করে সেভাবেই কিনতে হয়।’
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুর রব এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে বাগদা চিংড়ির চাহিদা অনেক। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও প্রতি কেজি ৯০০-১২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে চিংড়ি উৎপাদনের পাশাপাশি রফতানিতে সরকারের নজর বাড়ানো দরকার।’
তিনি বলেন, ‘কিছু অসাধু ব্যক্তির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চিংড়ি শিল্পের বদনাম হচ্ছে। রফতানিজাত চিংড়ির ওজন বৃদ্ধি করার জন্য কেউ কেউ অপদ্রব্য পুশ করেন, এটা কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে।’ অন্যথায় আগামীতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী চিংড়ি শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এ ব্যবসায়ী।
অপরিকল্পিত ঘের নির্মাণের কারণে চিংড়ি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিএম সেলিম। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘একটি চিংড়ি ঘেরে যে পরিমাণ পানি থাকার প্রয়োজন, তা রাখতে পারেন না চাষীরা। তাছাড়া এখানকার চিংড়ি ঘেরগুলো বছরের পর বছর জীবাণুযুক্ত কাদা বহন করে চলেছে। ওই নোংরা পরিবেশে চিংড়ি টিকে থাকতে পারে না। ফলে এক থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা হলেই রোগাক্রান্ত হয়ে যায়। এজন্য জেলার চিংড়িচাষীদের ঘেরে সবসময় কমপক্ষে সাড়ে চার-পাঁচ ফুট পানি রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে একবার হলেও ঘেরের তলার কাদা পরিষ্কার করতে বলা হয়।’

