সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : সাতক্ষীরা সদর উপজেলার অন্যতম বাণিজ্যিক মোকাম কদমতলা বাজার। পাশেই মজুমদারের খাল। আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্তও সে পথে পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করত। আর এখন সেটি পতিত জমি। কোথাও আবার চিহ্নটুকুও বিলীন হয়ে গেছে। শুধু মজুমদারের খালই নয়, হারিয়ে গেছে উপকূলীয় জেলাটির ১৪০ খাল। বাড়তি পানি বেরিয়ে যেতে না পারায় জলাবদ্ধতার কবলে সাড়ে ১২ হাজার হেক্টর কৃষিজমি। আর এতে ব্যাহত হচ্ছে ফসল উৎপাদন।
জেলা প্রশাসন বলছে, ছোট-বড় মিলিয়ে সাতক্ষীরায় খালের সংখ্যা ৪২৯। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে খাল রয়েছে মোট ২৮৯টি। বাকিগুলোর আর কোনো অস্তিত্ব নেই। আবার যেগুলো আছে সেগুলোরও অর্ধেকেরই বেশি অস্তিত্ব সংকটে।
সাতক্ষীরা কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা বলছেন, জলাবদ্ধতা সাতক্ষীরার কৃষিতে মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা কৃষি গবেষাণায়ও প্রভাব ফেলছে। জলাবদ্ধতার কারণে উপকূলীয় এলাকায় কৃষি গবেষণা কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। কৃষিজমি জলাবদ্ধতার কবল থেকে রক্ষা করতে এসব খাল উদ্ধারের জন্য বারবার তাগিদ দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সাতক্ষীরার বিনেরপোতা কার্যালয়ের প্রধান কর্মকর্তা ড. শিমুল মণ্ডল এই প্রতিবেদক কে জানান, উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার লবণসহিঞ্চু বা অন্যান্য পরিবেশে টিকে থাকতে পারে—এমন ফসল উদ্ভাবনে তারা গবেষণা করেন। তবে জলাবদ্ধতার কারণে সে কাজ ব্যাহত হচ্ছে। তাই জলাবদ্ধ পানিতে টিকে থাকতে পারে এমন ফসল উদ্ভাবনের কাজ করা হচ্ছে এখন। তবে উপকূলীয় এলাকায় দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জলাবদ্ধতাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে।
কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, সদর উপজেলার ফয়জুল্লাপুর, চেলারবিল ও ঘুটেরডাঙ্গীর অধিকাংশ বিলের শাখা খালগুলো বিলীন হয়ে গেছে। ফলে জলাবদ্ধতার কারণে শুষ্ক মৌসুমেও সেখানকার তিন ফসলি জমি তলিয়ে রয়েছে। এসব জমিতে কয়েক বছর আগেও ধান, পাট, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন হতো।
ফয়জুল্লাহপুর গ্রামের কৃষক আতিয়ার হোসেন, নিমাই মণ্ডল ও শহীদুল ইসলাম জানান, যেসব জমিতে ফসল ফলত, তাতে এখন শুধু কচুরিপানা ও আগাছা ভাসছে। বছরের প্রায় পুরোটা সময় সব জমি পানিতে ডুবে থাকে এখন। বিভিন্ন সময় পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনের লোকজন খাল ইজারা বা বন্দোবস্ত দেয়ার কারণেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে বলে তাদের অভিযোগ।
একই উপজেলার ডাইয়ের বিলেও স্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। বিলের কয়েক হাজার হেক্টর জমি তলিয়ে রয়েছে পানিতে। সেখানে ফসল ফলাতে পারছেন না কৃষক। কোনো কোনো কৃষক নিরুপায় হয়ে মাছচাষীদের কাছে জমি ইজারা দিয়েছেন।
নদী বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা আশেক-ই এলাহী এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ছোট-বড় মিলিয়ে জেলায় চার শতাধিক খাল ছিল। এগুলো বিভিন্ন নদ-নদীর সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় শহর ও আশপাশের পানি নিষ্কাশন হতো। বিশেষ করে কিছু খাল বিভিন্ন বিলের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়ায় জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো না। স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঠিক তদারকি না থাকায় এসব খালের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় শ্রেণী পরিবর্তন করে অধিকাংশ খাল লিজ বা দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। সাতক্ষীরার কৃষিকে জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্ত করতে হলে খালের বন্দোবস্ত বাতিল করতে হবে। সেগুলো উদ্ধার করে তা উন্মুক্ত করে দিতে হবে।’
সাতক্ষীরা পাউবো ডিভিশন-১ ও ২-এর তথ্যানুযায়ী, জেলায় বর্তমানে ২৮৯টি খাল রয়েছে। এর মধ্যে ডিভিশন-১-এর অধীনে ১৮০টি ও ডিভিশন-২-এর অধীনে রয়েছে ১০৯টি খাল।
এ বিষয়ে পাউবো ডিভিশন-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী ৪২৯টি খাল রয়েছে জেলায়। কিন্তু আমাদের হিসাবে ২৮৯টি খাল পাওয়া যাচ্ছে। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে বাকি ১৪০টি খাল উদ্ধারে চেষ্টা করা হবে। তাছাড়া ডিভিশন-১-এর অধীনে থাকা ১৮০টি খালের মধ্যে ৩০টির পুনঃখননকাজ চলছে। প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।’
ডিভিশন-২-এর অধীনে থাকা খালগুলোর মধ্যে ৫৯টি পুনঃখনন করা হচ্ছে। খননকাজও শেষের দিকে বলে জানান সংস্থাটির ওই অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ মনিরুল ইসলাম।
পরিবেশবিদরা বলছেন, স্থানীয় প্রশাসন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কারণেই মূলত সাতক্ষীরার অধিকাংশ খাল মৃত। তিন-চার দশক আগেও এসব খালকে কেন্দ্র করে সাতক্ষীরার ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল। জেলা শহর ও জনবসতি এলাকার পানি নিষ্কাশনের অন্যতম ব্যবস্থাও ছিল এসব খাল। আশির দশকের পর থেকে খালগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হতে থাকে। খালগুলো উদ্ধার করা না গেলে উপকূলীয় এ অঞ্চলের কৃষিতে বিপর্যয় অনিবার্য।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘জেলার পাঁচটি উপজেলায় ১২ হাজার ৬৮৫ হেক্টর জমি জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদরে ৩ হাজার ৭৩০ হেক্টর, কলারোয়ায় ১ হাজার ৩৬০, তালায় ৭ হাজার ৬৫, আশাশুনিতে ৪৫০ ও শ্যামনগর উপজেলায় ৮০ হেক্টর। বছরের প্রায় পুরো সময়ে জলাবদ্ধ থাকে এসব জমি।’
জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে সাইফুল ইসলাম জানান, পানি নিষ্কাশনের জন্য বিলের মধ্যে যেসব সরকারি খাল ছিল তা বিভিন্ন সময় বন্দোবস্ত বা ইজারা দেয়ার কারণেই মূলত জলাবদ্ধতার সৃষ্টি। এরই মধ্যে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামীতে এসব খাল ইজারা না দেয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘জেলায় ৪২৯টি খাল রয়েছে। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব খাল উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। তবে শুধু প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্ভব নয়, জেলার সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে অবৈধ দখল বা খালে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। তাছাড়া হারিয়ে যাওয়া খাল উদ্ধারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকেও বলা হয়েছ,
সাতক্ষীরায় পানি নিরসনের ১৪০ খান বিলুপ্তির পথে

Leave a comment