
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : মুকুল থেকে গুঁটি ভালো হওয়ায় সাতক্ষীরায় আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ, কালবৈশাখীর ঝড়ের কবলে না পড়ায় অধিক ফলনে চাষিদের ঘরে ঘরে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। বিগত মৌসুমের ক্ষতি চলতি মৌসুমে পুষিয়ে যাবে বলে আশা করছে বাগান মালিক ও চাষিরা।
জেলার বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, গত মৌসুমে প্রতিকুল আবহাওয়ার কারণে আমের ফলন কম হয়েছিল। চলতি মৌসুমে প্রতি গাছে আম আর আম। আমের ভরে গাছের ডাল ভেঙে না পড়ে সেজন্য চাষিরা বাঁশের পিলা দিয়ে রাখতেও দেখা গেছে। ভালো ফলনে চাষিরা খুশিতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এবার সাতক্ষীরায় আমের বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছেন তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছর জেলার চার হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। সেই সঙ্গে ২৫০ কোটি টাকার বেশি আয় হবে।
সূত্র আরো জানায়, মাটি, বাতাস ও আবহাওয়া ভালো হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে জেলায় হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি, মল্লিকা, গোপালভোগ, গোবিন্দভোগ, বোম্বাই ও গোপালখাসসহ অন্যান্য জাতের প্রচুর আম উৎপাদন হয়। চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হয়। চলতি বছর নবমবারের মতো ইংল্যান্ড ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই জেলার আম যাবে।
আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারণে অন্য জেলার চেয়ে সাতক্ষীরায় আম আগে পাকে। এ জন্য দেশের বাজারে সবার আগে এখানকার আম বিক্রি শুরু হয়। গত কয়েক বছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চাষিরা। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন ভালো হয়েছে। তবে দাবদাহের কারণে কিছু গুঁটি ঝরে পড়েছে। এতে উৎপাদনে প্রভাব পড়বে না দাবি করছে কৃষি বিভাগ।
জেলায় চার হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে সরকারি তালিকাভুক্ত পাঁচ হাজার ২৯৯টি আমবাগান ও ১৩ হাজার ১০০ চাষি রয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
শহরের সুলতানপুর থেকে আব্দুর রহিম বলেন, সাতক্ষীরা আম অতুলনীয়। এখানকার হিমসাগর বিখ্যাত। এছাড়াও ল্যাংড়া আম্রপালির চাহিদা বেশি। গত বছর ১৫টি বাগান কিনেছিলাম। চলতি বছর ২০টি লিজ (ইজারা) নিয়েছি। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে আছে। আম দ্রুত বড় হচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় আম খুব বেশি সুস্বাধু হবে না। গত কয়েক বছর দুর্যোগের কারণে মূলধন হারিয়ে ফেলেছি। এবার বাম্পার ফলন হয়েছে, আশা করছি লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারবো।
ফিংড়ি এলাকার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, গত বছর উৎপাদন কম হওয়ায় লোকসান হয়েছিল। এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। বাগান লিজ নিলে তার পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়। বাগান পরিচর্যা, পোকামাকড় মুক্ত করতে ওষুধ প্রয়োগ, ফলনের পর বাজারজাত, শ্রমিকের পেছনে অনেক টাকা ব্যয় হয়। ফলন ভালো হলে আমাদের লাভ হয়। এই মৌসুমে আশা করছি লাভের মুখ দেখবো।
আমের ফলন ভালো হয়েছে বলে বড় বাজারের আড়তদার রহিম বাবু বলেন, চলতি মৌসুমে কাঁচা আম মণ প্রতি ১৫০০-১৬০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা গ্রামের চাষিদের কাছ থেকে কম দামে কাঁচা আম কিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। তারাও ভাল লাভ পাচ্ছে।
গত মৌসুমে পাকা আমের কেজি ৫০ টাকা বিক্রি হয়েছিল উল্লেখ করে মতিয়ার রহমান আরো বলেন, চলতি মৌসুমে আরো বেশি দাম পাবো। আমের সাইজ বড় ও দেখতে সুন্দর হলে ৮০ টাকা পর্যন্ত কেজি বিক্রি হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন গত মৌসুমে দেড়শ থেকে দুইশ কোটি টাকা সাতক্ষীরার আম বিক্রি হয়েছে। আশা করছি চলতি মৌসুমে আরো বেশি টাকার আম বিক্রি হবে। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রতিটি গাছে প্রচুর মুকুল এসেছিল। সেই পরিমাণ গুটি ধরেছে। গুটি থেকে আমের আকার বড় হয়েছে। তুলনামূলক কম ঝরেছে। এজন্য বেশি উৎপাদনের আশা করছি।
উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা সর্ম্পকে তিনি বলেন, নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। ফলন ভালো হয়েছে। উৎপাদনে রেকর্ডের আশা করছি। গড় হিসেবে কেজি প্রতি ৬০ দরে ২৫০ কোটি টাকার বেশি আম বিক্রি হবে। বিষমুক্ত ও নিরাপদ আম উৎপাদন এবং রফতানির জন্য চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে কৃষিবিদ বলেন, সবকিছু ঠিক থাকলে ইউরোপের দেশগুলোতে সাতক্ষীরার আম রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
এদিকে, আম নিরাপদ প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ ও বাজারজাত করার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। সূচি অনুযায়ী, আগামী ১২ মে থেকে গোপালভোগ, গোবিন্দভোগ, বোম্বাই ও গোপালখাসসহ অন্যান্য স্থানীয় আম পাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে চাষিদের। ২৫ মে থেকে হিমসাগর, ১ জুন ল্যাংড়া ও ১৫ জুন থেকে অম্প্রপালি পাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে আম পাড়লে অপরিপক্ক থেকে যাবে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির বলেন, সরকার কৃষির উপর গুরুত্ব দেওয়ায় চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরায় আম উৎপাদনের বিপ্লব ঘটেছে। এই আম সঠিকভাবে বাজারজাতকরনের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনসহ আমরা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। চাষিরা যাতে অপরিপক্ক আম ভেঙে বাজারজাত নাকরে সেলক্ষ্যে আম ভাঙার সঠিক সময়ও নির্ধারন করে দেওয়া হয়েছে। সাতক্ষীরা আম বিদেশে রপ্তানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন গত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে ফলন ভালো, সেহেতু আরো বেশি আম বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।