
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরা। এ অঞ্চলের শ্যামনগর উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী কালীগঞ্জ উপজেলার আংশিক অংশ নিয়ে সাতক্ষীরা-৪ নির্বাচনি এলাকা। বিএনপির দলীয় কর্মসূচিতে যাদের আগে দেখা যায়নি, ৫ আগস্টের পর থেকে তাদের আনাগোনায় দলীয় কর্মসূচি ও কার্যালয়গুলো এখন জমজমাট।
যারা আগে ঝামেলা এড়াতে দলের কর্মসূচি থেকে দূরে থাকতেন, তারাও এখন সক্রিয়। উপজেলা ও ইউনিয়ন বিএনপির নেতারা এখন নতুন কমিটি গঠনে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এদিকে আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নীরবে মাঠ গোছাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। ইতোমধ্যে তারা সাতক্ষীরা-৪ নির্বাচনি আসনে প্রাথমিক দলীয় প্রার্থীর নামও ঘোষণা করেছে। তবে শ্যামনগরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ১২ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি হলেও এখন পর্যন্ত তাদের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না।
এদিকে একাধিক মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়ে এলাকায় নেই ১৫ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মী। এলাকায় যারা আছেন তারাও রয়েছেন শঙ্কায়, ভুগছেন গ্রেপ্তার আতঙ্কে। যার ফলে সম্প্রতি কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া দলটির নেতারা এখন রয়েছেন আত্মগোপনে। সেই সঙ্গে জাতীয় পার্টির মধ্যেও দেখা যাচ্ছে না তেমন চাঙাভাব। অন্তরালে ১৪ দলের অন্য শরিকরাও।
সব মিলিয়ে সাতক্ষীরা-৪ আসনের রাজনীতির মাঠে এখন বিএনপি আর জামায়াত বেশ সক্রিয়। দল দুটি সংগঠনকে গোছানোর পাশাপাশি জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ভোটের মাঠও গোছাচ্ছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনি আসনে বেশ সক্রিয়। সুযোগ পেলেই জনসংযোগের পাশাপাশি যোগ দিচ্ছেন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে।
স্থানীয় বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন, বিগত সরকারের সময়ে শ্যামনগর বিএনপিকে দমন করতে বিপুলসংখ্যক মামলা করা হয়েছিল। অধিকাংশই ছিল ‘গায়েবি’ মামলা। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছিল তিন হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে। তারা ছিলেন একাধিক মামলার আসামি। গ্রেপ্তার আতঙ্কে নেতারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলেন। গত ৫ আগস্ট আন্দোলনের পর থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। দলীয় কার্যালয়গুলোতে জমে উঠেছে কর্মসূচি। গত ২ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির আংশিক আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। এতে রহমতউল্লাহ পলাশকে আহ্বায়ক ও আবু জাহিদকে সদস্যসচিব করা হয়। এ ছাড়া আবুল হাসান, তাসকিন আহমেদ, মনিরুজ্জামান ও মো. আক্তারুল ইসলামকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়।
এই কমিটি গত ৬ ফেব্রুয়ারি জেলার সাতটি উপজেলা, তিনটি পৌরসভা ও ৭৭টি ইউনিয়নের সব ওয়ার্ড মিলিয়ে ৮০৭টি কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এর পর থেকে নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়। এরই ধারাবাহিকতায় ২৭ জুন থেকে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী সদস্য নবায়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে শ্যামনগর পৌরসভাসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের নবায়ন করা সদস্যদের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শুরু হয়।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, বিএনপির রাজনীতি এখন নতুন কমিটি এবং কেন্দ্রীয় কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এগিয়ে যাচ্ছে। সামনে যেহেতু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তাই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন কমিটি গঠন করা হবে। একই সঙ্গে দলকে আরও সুসংগঠিত করা হচ্ছে।
জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিএনপি সব সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। আমরা ২০১৪ সাল থেকে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য কাজ করে আসছি। বিএনপি যেহেতু জনগণের ওপর নির্ভরশীল একটি রাজনৈতিক দল, সেহেতু নির্বাচন নিয়ে বাড়তি কোনো প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার আছে বলে মনে করি না।’
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর শ্যামনগরে প্রকাশ্যে সংগঠনের কার্যক্রম চালাতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী। এখন রাজনৈতিক পরিবেশ কিছুটা বদলানোয় দলটি তৃণমূলে আবারও সভা-সমাবেশ করছে। নেতারা ধর্মীয় ও সামাজিক নানা আয়োজনে অংশ নিচ্ছেন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সারা দেশের সঙ্গে সাতক্ষীরা-৪ আসনেরও প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। প্রাথমিকভাবে ঘোষিত এই আসনের প্রার্থী হলেন সাবেক এমপি ও সাবেক কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য গাজী নজরুল ইসলাম।
শ্যামনগর উপজেলা জামায়াতের আমির আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দল উপজেলায় সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষের খেদমতে কাজে নিয়োজিত আছে। দলের নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পেয়েছি এখন আমাদের কার্যক্রম আরও বেগবান হবে।’
সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের আমির শহিদুল ইসলাম মুকুল বলেন, এরই মধ্যে সাতক্ষীরার চারটি আসনের প্রাথমিকভাবে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তারা নিজ নিজ এলাকায় মানুষের সেবায় কাজ করছেন।
সাতক্ষীরা-৪ আসনের নির্বাচনি এলাকা শ্যামনগর উপজেলায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কার্যক্রম নেই বললেই চলে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার মতো শ্যামনগরের দলটি একটি সমন্বয় কমিটি ঘোষণা করলেও এখন পর্যন্ত তাদের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না।
ছাত্রনেতা ও এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মেজবাহ কামাল মুন্না বলেন, ‘শ্যামনগরে এনসিপির ১২ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ছাত্রনেতারা বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে এলাকায় কাজ করছেন। যেহেতু নতুন দল গুছিয়ে উঠতে একটু সময় লাগছে। জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী নির্বাচনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আসনভিত্তিক প্রার্থী নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আশা করি দলের রেজিস্ট্রেশন ও প্রতীক একই সঙ্গে দ্রুতই পেয়ে যাব। এরপর নির্বাচনের প্রস্তুতে মাঠে নামব।’ দল নির্বাচনে অংশ নিলে তিনি এই আসনে নির্বাচন করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় শ্যামনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কার্যালয়ও ভাঙচুরের শিকার হয়।
বিগত সময়ের আন্দোলনে দলীয় নেতাদের নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনায় উপজেলা ও জেলায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামিদের মধ্যে বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। এ ছাড়া এসব মামলায় রয়েছে আবার অজ্ঞাত আসামি। এর ফলে সম্প্রতি কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া দলটির নেতারা এখন আত্মগোপনে আছেন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন-তারিখ নিয়ে দড়ি-টানাটানিতে জনমনে আশা-নিরাশার যে দোলাচল; রাস্তাঘাট ও চায়ের দোকানের আড্ডায় গেলেই তা বোঝা যায়। মানুষের একটাই প্রশ্ন অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক হবে তো?
নির্বাচনের উৎসবমুখর পরিবেশ ফিরে আসবে; মানুষ তার পছন্দসই প্রার্থীর পক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে, এমনটাই দাবি স্থানীয় জনগণের। এরই মধ্যে মাঠে, ময়দানে, চায়ের দোকান বা পাড়ার আড্ডা সব জায়গাতেই প্রাধান্য পাচ্ছে নির্বাচনি আলাপ-আলোচনা। জাতীয় নির্বাচন ঘিরে এখানকার মানুষের আগ্রহ বা উদ্দীপনার কোনো কমতি নেই।
নির্বাচন ঘিরে সাধারণ মানুষের এই আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম উপজেলা সদরের উচ্চমধ্যবিত্ত একটি পরিবারে। সেখানে বাড়ির কর্ত্রী রহিমা বেগম বলেন, ‘আমি সব সময় চাই নির্বাচনটা সুষ্ঠু হোক। আমি যাকে চাই, সেটা কোনো প্রতীক হোক বা প্রার্থী হোক, যা-ই হোক, আমি যেন আমার ভোটটা দিতে পারি।’
একই প্রত্যাশা তার পুত্রবধূ রোকাইয়া জান্নাতেরও। এবারের নির্বাচন গত কয়েকটি নির্বাচনের মতো দেখতে চান না তিনি। সব দল ও মতের মানুষ তাদের মতপ্রকাশের সুযোগ পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
অভিন্ন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন শ্যামনগরের একজন ব্যবসায়ী। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিজের এই ভোটাধিকার প্রয়োগকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ব্যবসায়ী মহাসিন আলী। তিনি বলেন, ‘আমার একটা ভোটের কারণে একটা দল জিততেও পারে আবার না দেওয়ার কারণে হারতেও পারে। তাই আমি আমার ভোটটা দিতে চাই নির্বিঘ্নে। এটা আমার অধিকার। আমি চাই আগামী নির্বাচন হোক সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ।’