সিরাজুল ইসলাম (শ্যামনগর), সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা মুন্সিগঞ্জ মহাসড়কটি বেহাল দশা। এই সড়কের আওতায় ১৮ লক্ষ স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রতিদিন হাজার হাজার বহিরাগত সহ সুন্দরবন দেখার পর্যটক যাতায়াত করে। পণ্য পরিবহন হয় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার। এই বছর ভারী বর্ষার কারণে সড়কটিতে বেহাল দোষ মারাত্মক আকার ধারন করেছে। প্রতিদিন সাতক্ষীরা শ্যামনগর মুন্সিগঞ্জ টু ঢাকা গামী প্রায় ৬০ টি পরিবহন চলাচল করে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ সুত্রে জানা যায় সাতক্ষীরা থেকে মুন্সি গঞ্জ পর্যন্ত ৬৭ কি মি রাস্তা ৪ লেনের সড়কের জন্য ৬৩৯ কোটি টাকার একটি প্যাকেজ গত ২৩-২৪ অর্থবছরে একনেক সভায় অনুমোদন পেয়েছে। সর্বশেষ জানা যায় প্রকল্পটি টেন্ডার এর অপেক্ষায় থাকলেও এখনও কোন আলোর মুখ দেখা যাচ্ছে না। সেকারণে সাতক্ষীরা মুন্সিগঞ্জের ১৮ লক্ষ্ মানুষ মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এছাড়া ১২ বছর ধরে শুনে আসছি যশোর টু মুন্সিগঞ্জ রেল লাইনের সকল প্রকার কার্যক্রম চূড়ান্ত কিন্তু তার কোন হদিস নেই। সাতক্ষীরা জেলা চিংড়ি রপ্তানিতে ১৯৮৮ সাল থেকে বাংলাদেশের পরিচিতি রয়েছে। অতিমাত্রায় নষ্ট হওয়া সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ সড়কটি চলাচলের অযোগ্য হতে বসেছে। সড়কের ছাল চামড়া উঠে অসংখ্য গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই সড়কে চলতে গিয়ে যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা ধুলাবালিতে নাজেহাল হয়ে পড়েছেন। আর দ্রুত নতুন সড়ক নির্মাণ না করা হলে ৩ উপজেলার সাথে জেলার সংযোগ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে।
সরেজমিন দেখা গেছে, সাতক্ষীরা থেকে শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত ১৮ ফুট প্রস্থ এ সড়কটির দৈর্ঘ্য ৬২ কিলোমিটার। সাতক্ষীরা জেলা শহর হতে দেবহাটা, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর উপজেলায় যাতায়াতের একমাত্র সড়ক এটি। এমনকি বিশ্বের অন্যতম সুন্দরবন ভ্রমণের একমাত্র সড়ক পথ এটি। কিন্ত বছরের পর বছর ধরে কার্পেটিং নষ্ট হয়ে পাথর উঠে ছোট বড় গর্তের সৃষ্টি হয়ে জনভোগান্তি বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমেই সড়কটি ব্যবহারে অযোগ্য হয়ে পড়ে। সারাবছর ধরে সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে মেরামত করা হলেও তা স্থায়ী হচ্ছে না। কোন কোন স্থানে কার্পেটিং উপর ইটের রাস্তা তৈরি করেছে সওজ। সড়কের দু’পাশে পর্যাপ্ত জায়গা থাকা সত্তে¡ও বর্তমান প্রেক্ষাপটের চাহিদার তুলনায় সড়কটি অত্যন্ত সংকীর্ণ। ফলে প্রতিনিয়ত এ সড়কে প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। এদিকে বিগত ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি দেবহাটার পারুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদে সড়ক উন্নয়ন বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় তৎকালিন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ সফিকুল আহম্মদ জানান, সাতক্ষীরা-কালীগঞ্জ সড়কটিকে বর্তমান ১৮ ফিট প্রস্থের স্থলে ৩৪ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ ফিট প্রস্থের আঞ্চলিক মহাসড়ক ক্যাটাগরিতে উন্নীত করণের কাজ শীঘ্রই শুরু হবে। দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির উন্নয়ন ও সাধারণ মানুষের চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ সাতক্ষীরা-কালীগঞ্জ সড়কের ৬৭ কিলোমিটার উন্নীতকরণের প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ বলছে, ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর একনেক কর্তৃক অনুমোদন পাওয়ার পর দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুমোদনের জন্য প্রেরণ এবং চুক্তির এক বছর পেরিয়ে গেলিও কাজ শুরু করেনি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া আওয়ামী সরকারের পতনের পর পূর্বের চুক্তিকৃত কাজ বাতিল করে নতুনভাবে টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ শুরু করতে বেশ কিছু সময় লেগে যাবে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তর। সেই সাথে সড়কের ছোটখাটো সংস্কারের জন্য বরাদ্দকৃত উপাদান ফুরিয়ে যাওয়ায় এই মুহূর্তে কোন কাজ করতে পারছে না দপ্তরটি। তবে বর্তমানে সড়ক জুড়ে গর্ত সৃষ্টি হয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এতে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। অতিরিক্ত লোড আর নির্মাণ কাজ যথাযথ না হওয়াকে দায়ী করেছেন এ পথের যাত্রীরা।
পথচারী কালিগঞ্জ উপজেলার মেহেদি হাসান জানান, রাস্তা খারাপ হওয়ায় বিগত দিনে কালিগঞ্জ থেকে সাতক্ষীরা যেতে যেখানে সময় লাগতো ১ ঘন্টা, বর্তমান সেখানে ২ ঘন্টার মত সময় লেগে যাচ্ছে। তারপরেও সুস্থভাবে পৌঁছানো দায় হয়ে পড়েছে। রাস্তায় এত পরিমাণ গর্তের সৃষ্টি হয়েছে যে চলাচল করা অসম্ভব। এমন অবস্থা হয়েছে সুস্থ মানুষ সাতক্ষীরা পর্যন্ত যেতে যেতে রুগি হয়ে যাচ্ছে।
দেবহাটা উপজেলার বাসিন্দা সুব্রত কুমার জানান, কর্মের সুবাদে রোজ জেলা শহরে যেতে হয়। কিন্তু কোন জেলার প্রধান সড়ক এত পরিমাণ খারাপ হয় সেটি ভেবে তিনি অবাক হয়েছেন। তিনি আরও বলেন এই সড়কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ বিগত দিনে সাতক্ষীরা-২, ৩ ও ৪ আসনের ৩ জন এমপি চলাচল করলেও কি তাদের চোখে এই সমস্যা কোনদিন পড়েনি। যেখানে দক্ষিণাঞ্চল এলাকা থেকে চিংড়ি, কাঁকড়া রপ্তানি করে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আসে, সেই রাস্তার অবস্থা যদি এমন হয় এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু থাকে না।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী মুজাহিদ বিন ফিরোজ জানান, বিগত দিন যেসব কাজ হয়েছে তার স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ছিল না। যার ফলে আমাদের প্রধান সড়কে বার বার কাজ করেও তা টেকসই করা যায়নি। বিশেষ করে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের সামনের সড়কটি কয়েক দফায় নতুনভাবে নির্মাণ করা হলেও তা কয়েক মাস যেতে না যেতে আগের অবস্থায় ফিরে আসে। আমরা এই সড়কটি উন্নত সড়কের আদলের নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি। আমরা যতদূর জানি নতুন সড়ক নির্মাণের জন্য সাতক্ষীরা শহর থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেটি কিছু দূর আসার পর অজানা কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের কপালে আবারও দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। কোনভাবে যেন কাজটি থেমে না যায়। আমরা বর্তমান প্রধান উপদেষ্টার নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি সড়কটি দ্রুত নির্মাণ করে এই অঞ্চলের মানুষের ভোগান্তি লাঘব হোক।
সাতক্ষীরা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ার পারভেজ জানিয়েছেন, সাতক্ষীরা-সখিপুর-কালীগঞ্জ এবং কালীগঞ্জ-শ্যামনগর-ভেটখালী পর্যন্ত মহাসড়ক যথাযথ মানের উন্নীতকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৬ টি প্যাকেজে ৬২.৩২৫ কিলোমিটার সড়কের জন্য ৮২২৪৪.১২ লক্ষ টাকা ব্যয় ধরা হয়। যা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক আদেশ মোতাবেক ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ৩০ জুন ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে সরকার পতনের পর সব টেন্ডার বাতিল করে নতুনভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে। তবে কবে নাগাত কাজ শুরু হবে এটি বলা যাচ্ছে না।