
সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর: সাতক্ষীরা শহরের মুনজিতপুর এলাকার গৃহবধূ রহিমা খাতুন সকালে পৌরসভার পানির কল খুলে বিশুদ্ধ পানির বদলে পান দুর্গন্ধযুক্ত পানি। সেই পানি দিয়ে রান্না করা যায় না, গোসল করলেও চুল আর ত্বক নষ্ট হয়। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে প্রতিদিন টাকা দিয়ে জারের পানি কিনে পান করেন তারা।
রহিমার মতো এই শহরের অসংখ্য নারী-পুরুষ এখন সুপেয় পানির জন্য টাকা গুনছেন। শহরের অনেক পরিবারই এখন বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হওয়া জারের পানি বা দোকানের বোতলজাত পানির ওপর নির্ভরশীল। অথচ পানি তাদের মৌলিক অধিকার। পৌরসভার পানি তো আসেই না ঠিকমতো। আর যেটুকু আসে সেটা খাওয়া তো দূরের কথা, মুখে দিতেই ভয় লাগে। পানি কিনে খেতে হচ্ছে, যা গরিব মানুষের জন্য কষ্টকর। তবে এই সংকটের মধ্যেও কেউ কেউ খুঁজে নিচ্ছেন বাঁচার নতুন উপায়। অনেকেই ঘরের ছাদে জমানো বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা ফুটিয়ে বা ছেঁকে রান্না, গোসল এমনকি পান করার ব্যবস্থাও করেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শহরে ব্যক্তিগত বা পাড়াভিত্তিক রেইনওয়াটার হারভেস্টিং বা বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখাই হতে পারে সুপেয় পানির একটি টেকসই সমাধান। এজন্য দরকার শুধু একটু সচেতনতা, আগ্রহ আর ছোট পরিসরের একটি ব্যবস্থা।
সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর, কামালনগর, কাটিয়া, মুন্সিপাড়া, রসুলপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় প্রতিটি বাসায় দিনে একাধিক জার পানি কিনে খেতে হয়। একেকটি পানির জার বিক্রি হয় ২০ থেকে ৩০ টাকায়। পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে মাসে খরচ পড়ে প্রায় ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা!
অনেকেই আর্সেনিকের এই বিষাক্ততার লক্ষণগুলোকে সাধারণ রোগ মনে করে গুরুত্ব দেন না। অথচ এটি একটি জনস্বাস্থ্য সংকট। সুপেয় পানি নিশ্চিত না করা গেলে ভবিষ্যতে সাতক্ষীরায় পানিবাহিত দীর্ঘমেয়াদি রোগের হার আরও বেড়ে যেতে পারে।
সাতক্ষীরা পৌরসভার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা বছরের পর বছর ধরে অব্যবস্থাপনার শিকার। পুরোনো ও জীর্ণ পাইপলাইনের কারণে অনেক এলাকায় পানি পৌঁছায়ই না, আর যেখানে পৌঁছায়, সেখানেও পানির রং ঘোলা, দুর্গন্ধযুক্ত ও লবণাক্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পানিতে আয়রনের মাত্রা এত বেশি থাকে যে তা রান্নার স্বাদ নষ্ট করে দেয়। পৌরসভার পানি পরিশোধন ব্যবস্থাও প্রায় অনুন্নত। নেই আধুনিক যন্ত্রপাতি, আয়রন বা লবণ দূর করার ব্যবস্থা। পানি সরবরাহও সীমিত। কোথাও দিনে একঘণ্টা, কোথাও একেবারেই আসে না। বিদ্যুৎ না থাকলে বা পাম্পে সমস্যা হলে দিন পেরোলেও পানি আসে না।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে, যা ভূগর্ভস্থ পানির উৎসেও প্রভাব ফেলছে। অপরিকল্পিত পানি উত্তোলন ও অনিয়মিত বর্ষণের ফলে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। এতে সাধারণ নলকূপ বা পৌরসভার পুরোনো সরবরাহ ব্যবস্থা দিয়ে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
পৌরসভার সুলতানপুর এলাকার বাসিন্দা ওমর আলী বলেন, আমাদের এলাকায় সকালে পানির কল খুললে গড়গড় শব্দ হয়, পানি আসে না। আবার কখনো কখনো অল্প পানি এলেও সেটা ঘোলা থাকে। মাঝে মাঝে পানিতে একটা দুর্গন্ধ বের হয়।
জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরা শহরের কিছু এলাকার টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। দীর্ঘমেয়াদে এই পানি পান করলে মানুষের শরীরে নানা ধরনের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আসাদুজ্জামান বলেন, আর্সেনিকযুক্ত পানি শরীরের জন্য নীরব বিষের মতো কাজ করে। সাতক্ষীরার কিছু এলাকায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, দীর্ঘদিন আর্সেনিক মিশ্রিত পানি পান করার কারণে অনেক রোগী চর্মরোগ, জ্বরজ্বর ভাব, পাকস্থলীর সমস্যা, ওজন হ্রাস, এমনকি স্নায়ু দুর্বলতা নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর্সেনিক শরীরে জমে থেকে ধীরে ধীরে কিডনি, লিভার এবং স্নায়ুতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হচ্ছে, এটি ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়ায়। বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী নারী এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রভাব আরও মারাত্মক হতে পারে।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে পানিজনিত রোগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়েছে। এদের অধিকাংশ বৃদ্ধ ও শিশু, যারা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এছাড়া আর্সেনিকজনিত কারণে চর্ম রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে।
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আ.ন.ম গাউছার রেজা বলেন, সাতক্ষীরা শহরের সুপেয় পানির সংকট এখন আর শুধু অবকাঠামো বা পৌর পরিষেবার সীমাবদ্ধতার কারণে নয়, এটি স্পষ্টতই জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বাস্তব প্রতিক্রিয়া। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে, যা ভূগর্ভস্থ পানির উৎসেও প্রভাব ফেলছে। অপরিকল্পিত পানি উত্তোলন ও অনিয়মিত বর্ষণের ফলে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। এতে সাধারণ নলকূপ বা পৌরসভার পুরোনো সরবরাহ ব্যবস্থা দিয়ে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সাতক্ষীরার মতো জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ শহরগুলোতে পানি ব্যবস্থাপনায় এখনই জলবায়ু সহনশীল ও বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে ।
জেলা নাগরিক কমিটির নেতা আলী নূর খান বাবুল বলেন, পৌরসভার পানি সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা, পর্যাপ্ত পরিশোধনের অভাব ও ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা আজ নাগরিক দুর্ভোগের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংকট সমাধানে স্থানীয় সরকারকে দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে।
সাতক্ষীরা পৌর এলাকায় পানি সংকট বিষয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা বারসিক সাতক্ষীরা অফিসের প্রোগ্রাম অফিসার গাজী মাহিদা মিজান মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, আমরা সাতক্ষীরা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের ১৭টি নি¤œবিত্ত এলাকায় নিয়মিত কাজ করছি। প্রায় প্রতিটি কর্ম এলাকায় গিয়ে আমরা একই চিত্র দেখতে পাই, মানুষ বিশুদ্ধ পানির সংকটে আছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারই খাবার পানি কিনে খায়। সাতক্ষীরা পৌরসভার পানি সরবরাহ বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মাসুদ রানা বলেন, শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় পৌরসভার অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পৌরসভার পানির পাম্প, মোটর ও লাইনগুলো অনেক পুরোনো। কোথাও কোথাও ৪০ বছর আগে স্থাপিত। তাছাড়া শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও আগের তুলনায় অনেক নিচে নেমে গেছে, যা আমাদের পানি উত্তোলনে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
তিনি আরও বলেন, সাতক্ষীরায় আগে দুটি পানির প্ল্যান্ট ছিল। পানির চাহিদা বাড়ায় ২০১৭ সালে শহরের কুখরালি এলাকায় একটি আধুনিক ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসানো হয়েছে। নতুন করে আরও একটি প্ল্যান্ট বসানোর চেষ্টা চলছে। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ এখনো পাইনি। বরাদ্দ পাওয়া গেলে দ্রুত কাজ শুরু করা হবে। এছাড়া পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে, এবং আরও কিছু এলাকাভিত্তিক গভীর নলকূপ বসানোর পরিকল্পনাও হাতে আছে। তবে প্রতিনিয়ত শহরের আয়তন বৃদ্ধির কারণে পানির চাহিদা বাড়ছে। ফলে পৌরসভার পক্ষে চাহিদা অনুযায়ী পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সাতক্ষীরা পৌরসভার সাবেক সহকারী প্রকৌশলী সেলিম সরোয়ার বলেন, সাতক্ষীরা শহরের পানি সংকট নিরসনে আধুনিক ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন, পৌরসভার পানি লাইনগুলো আধুনিকায়ন, টিউবওয়েলের পানি পরীক্ষার জন্য নিয়মিত উদ্যোগ, ছাদে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের সরকারি ও সামাজিক উদ্যোগ, কমিউনিটি ট্যাংক বা বিকল্প পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু এবং স্কুল ও ওয়ার্ড পর্যায়ে পানি সচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।