
সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর: সাতক্ষীরা সদরের ধুলিহর, ব্রহ্মরাজপুর ও ফিংড়ি ইউনিয়নের অন্তত ২৭টি গ্রাম এবং শহরের বিভিন্ন এলাকা ভারী বর্ষণে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে। ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করায় মানুষজন গবাদিপশু ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। এলাকার মানুষ, পশুপাখি এবং কৃষির ওপর এর প্রভাব ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাওয়ায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এ অঞ্চলের মানুষ বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঝাউডাঙ্গা থেকে ধুলিহর, দামারপোতা, জিয়ালা, কাজীরবাসা, তালতলা, চাঁদপুরসহ গ্রামের পর গ্রামে এখন হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি। পানির মধ্যে বসবাস করতে গিয়ে শিশু-বৃদ্ধ সবাই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
স্থানীয় কৃষক হুমায়ূন কবির জানান, দশ কাঠা জমিতে সবজি চাষ করেছিলেন, সব সবজি শেষ। আরেক কৃষক আরশাদ আলী বলেন, সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে আউশ ধান চাষ করেও সব হারিয়েছেন। অনেক জায়গায় আম বাগান পানিতে তলিয়ে থাকায় আম গাছ রক্ষাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এলাকার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাÑসবই জলমগ্ন।
পানি নিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থার অভাবে এসব এলাকা বারবার প্লাবিত হচ্ছে। ধুলিহরের ইউপি সদস্য মো. মিনহাজ মোর্শেদ বলেন, সাতক্ষীরা পৌরসভার অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা এই দুর্ভোগের জন্য দায়ী। স্থানীয়দের দাবি, দ্রুত বেতনা নদী ও সংলগ্ন খালগুলোর পুনঃখনন ছাড়া এ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি নেই।একই দাবি জানিয়েছেন জেলা পানি নিষ্কাশন কমিটি ও নাগরিক কমিটি। প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার বেতনা খনন প্রকল্প চললেও এর অগ্রগতি নিয়ে এলাকাবাসী চরম হতাশ। ফিংড়ী ইউপি চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান ও উপজেলা প্রশাসন নেটপাটা অপসারণে অভিযান চালালেও কিছু অসাধু ব্যক্তি এখনও মাছ ধরার কাজে তা ব্যবহার করছেন।সাতক্ষীরা শহরের বদ্দীপুর থেকে কাজীরবাসা পর্যন্ত জলাবদ্ধতা নিরসনে বিকল্প পানি নিষ্কাশনের কিছু উদ্যোগ নিলেও সাম্প্রতিক বর্ষণে ফের ভেঙে পড়েছে সেই ব্যবস্থাও।স্থানীয় সাংবাদিক মেহেদী হাসান শিমুল জানান, তার নিজ বাড়িসহ গোবিন্দপুরের অধিকাংশ পরিবারই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। স্কুল-কলেজ বন্ধ, মাছের ঘের পানিতে ভেসে গেছে, কৃষকের মুখে বিষাদের ছাপ। এলাকার মাটি, কৃষি ও জীবনযাত্রা সবই এখন পানির নিচে। জলাবদ্ধতা নিরসনে জেলা প্রশাসকের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসি।
এছাড়া ভয়াবহ জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে সাতক্ষীরা পৌরসভার নিম্নাঞ্চলসহ সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ। সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে এসব এলাকার রাস্তা-ঘাটসহ বসতবাড়ি। অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি-ঘর নির্মাণ, ইচ্ছামত ভেড়িবাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, পৌরসভার ভিতর পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকা, প্রাণ সায়ের খাল ভরাটসহ অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখনো পানির মধ্যে রয়েছে। ফলে জলাবদ্ধতার কারণে দিনের পর দিন সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে পৌরসভার নিম্নাঞ্চলসহ বেতনা নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষ।বর্তমানে বৃষ্টি থামলেও পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় সাতক্ষীরা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৭টি ওয়ার্ডের নিম্নাঞ্চলের মানুষ জলাবদ্ধতার কারণে নাকাল হয়ে পড়েছে। বর্ষা মৌসুম আসলেই জেলা শহরের নিম্নাঞ্চলসহ আশেপাশের বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষদের পড়তে হয় চরম দুর্ভোগে। দ্রুত পানি নিষ্কাশনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে এসব এলাকার সহস্রাধিক মানুষ ভিটেহারা হতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে. সাতক্ষীরা শহরের ইটাগাছা, কামালনগর, খড়িবিলা, মধুমালারডাঙ্গি, মুনজিতপুরের রথখোলার বিল, রাজারবাগান, মুন্সিপাড়া, পলাশপোল, কামালনগর, মাঠপাড়া, মাগুরা, পুরাতন সাতক্ষীরার বদ্দিপুর কলোনীসহ আশপাশের এলাকা জলাবদ্ধতার কারণে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া সদর উপজেলার মাগুরা, বিনেরপোতা, গোপিনাথপুর, গোবিন্দপুর, মাছখোলা, ঝাউডাঙ্গা, বলী, লাবসা, ব্রহ্মরাজপুর, ধুলিহর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের অধিকাংশ স্থান এখনো কোমর পানিতে ডুবে আছে।
সাতক্ষীরা শহরের শেখ নুরল হুদা জানান, শহরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত প্রাণসায়ের খাল। এই খালের এক প্রান্তে বেতনা নদী এবং অপর প্রান্তে মরিচ্চপ নদী। কিন্তু এই নদী দু’টি পলিজমে ভরাট হয়ে যাওয়ার প্রানসায়ের খাল দিয়ে আর আগের মত পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। খালটি খনন করা হলেও পরিকল্পনা মাফিক কাজ না করায় সেটি খুব একটা কাজে আসছে না। ফলে গ্রামের পর গ্রাম সৃষ্ট হয়েছে জলাবদ্ধতা। গত ৭ থেকে ৮ বছর ধরে বছরের বর্ষা মৌসুম শুরু থেকে প্রায় ৩ মাস এসব এলাকা পানিতে ডুবে থাকে। এতে মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অনেকের রান্না-খাওয়ার জায়গা নেই। পৌরসভার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিপাতে শহরের নিচু এলাকা প্লাবিত হওয়ায় মানুষের কষ্টের শেষ নেই। পৌর সভার অনেক স্থানে রাস্তার উপর দুই থেকে তিন ফুট পানি। পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় বাড়িঘর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পাড়ায় অনেকে তাদের সহায় সম্বল নিয়ে অন্যত্রে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে।
স্কুলছাত্রী মাইশা তামান্ন বলেন, রাস্তা উপরে হাটু পানি হওয়ায় ভ্যান রিকশা চলাচল করে না। দীর্ঘ দেড় মাস পানিবন্দি হয়ে আছি। স্কুলে যাওয়ার সময় ভিজা কাপড়ে স্কুলে যেতে হয়। এতে করে আমাদের লেখা পড়া মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
পৌর সভার কুলিন পাড়ার নজরুল ইসলাম জানান, গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা শহরের একাডেমি মসজিদ থেকে জেবুনেছা ছাত্রীনিবাস, মুন্সিপাড়া থেকে ফকির ময়ারার বাড়ি ও মুনজিতপুরের চৌধুরী বাড়ি হতে খোলার টালি ,বদ্দীপুর কলোনী, সরদার বাড়ি, মাদ্রাসা পাড়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে ডুবে আছে। এসব রাস্তায় দুই থেকে তিন ফুট পর্যন্ত পানি। এসব এলাকার মানুষের ঘরের ভিতর পানি বাসা ভাড়া নিয়ে অনেকেই অন্যত্রে চলে গেছে।
সদর উপজেলার বড়দল গ্রামের মোকলেছুর রহমান জানান, সদর উপজেলার বেতনা নদীর নাব্যতা না থাকার এখন শহর ও কয়েকটি ইউনিয়নে বর্ষা মৌসুম পানি নিষ্কাশন হয় না। ফলে এসব এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। আমাদের এলাকার শতাধিক পরিবার জলাবদ্ধতার কারণে পানিবন্দি হয়ে আছে। আমন মৌসুমে রোপণ আমন ধান পানিতে ডুবে থাকায় এলাকার কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপর দিকে টানা বৃষ্টিতে মাছের ঘের ভেসে যাওয়ায় মাছ চাষিরা সর্বশান্ত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে জলাবদ্ধ এলাকায় পানি দূষিত হয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে অনেকে। তাছাড়া কবে নাগাদ তারা এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এঅবস্থা চলতে থাকলে অনেক মানুষকে ভিটে ছাড়া হতে হবে। তিনি দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানান।
স্থানীয়দের ধারণা, তিনটি কারণে সাতক্ষীরা পৌরসভার নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিতে চলেছে। বেতনা নদীর নাব্যতা না থাকা, অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, পানি নিষ্কাশনের পথ না রেখে মাছের ঘেরের বেড়িবাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি।
সদর উপজেলার ধুলিহরের মাওঃ আব্দুস সবুর জানান, আমন মৌসুমে ৫ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। কিন্তু পানির মধ্যে থাকায় ধানগাছ পচে নষ্ট হয়ে গেছে। বসত বাড়িতে পানি উঠায় বসবাসে অযোগ্য হয়ে পড়েছে। রাস্তা ঘাটে পানি থাকায় ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া ব্যাহত হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন ও একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের প্রচেষ্টায় বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের পানি নিষ্কাশনে সেচ কাজ অব্যাহত আছে। এটা আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। বেতনা নদীর নব্যতা ফিরে পেলে আমাদের দুঃখ দুর্দশা লাঘব হবে।
সাতক্ষীরা পৌর শহরের পলাশপোল এলাকার মনিরুল ইসলা মিনি বলেন, ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সাতক্ষীরা পৌরসভা কাগজে-কলমে প্রথম শ্রেণি হিসেবে মর্যাদা পেলেও বর্তমানে পরিপূর্ণ নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত পৌরবাসী। প্রথম শ্রেণির পৌরসভার যে সুযোগ সুবিধা হওয়ার কথা এখানে তা নেই, নেই তেমন নাগরিক সুবিধাও। ৩১.১০ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এ পৌরসভা ৯টি ওয়ার্ড ও ৪০টি মহলরা ৫ লক্ষ মানুষ পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
তিনি আরো বলেন, পৌর সভার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। অধিকাংশ পয়ঃনালা রাস্তার কাছে উঁচু এলাকায় হওয়ায় অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার পানি গড়িয়ে যেতে পারে না। অন্যদিকে মোট পয়ঃনালার এক-পঞ্চমাংশ কাঁচা হওয়ায় সেগুলো দ্রুত মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ফলে পানি ঠিকমতো নিষ্কাশিত হয় না। আবার শহরের দেড় কিলোমিটার পয়ঃনালার জন্য একটি করে কালভার্ট থাকায় সেগুলো দিয়ে পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হয় না।
মুনজিতপুর এলাকার বাসিন্দা হাসানুজ্জামান মনা জানান, শহরে জলাবদ্ধতার মূল কারণ অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণ করা। বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার কোল ঘেঁষে বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। আবার একজনের বাড়ি থেকে অন্যজনের বাড়ির প্রাচীর একই থাকছে। পানি নিষ্কাশনের কোনো পথ থাকছে না। পয়ঃনালা নির্মাণ করার জন্য পথ পর্যন্ত দেওয়া হয় না। ফলে অল্প বৃষ্টিতে পানি জমে যায়।
পৌরসভার নাজিরুল ইসলাম জানান, গেল বর্ষার পরে থেকে বাড়ির চারদিকে ৩-৪ ফুট পানি জমে আছে। পরিবারের লোকজন নিয়ে বসবাস করা মুশকিল হয়ে পড়েছে। মাঝে মধ্যে সাপের উপদ্রব দেখা দেয়। এতে ছেলে মেয়েসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, অপরিকল্পিতভাবে বসতবাড়ি নির্মাণ এবং পৌরসভার আশপাশে প্রভাবশালীদের ঘের নির্মাণের কারণে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে এখানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জলাবদ্ধ এলাকার পানি নিষ্কাশনের চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।