
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী উপজেলা তালা ও কলারোয়া নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা-১ আসনে জমে উঠেছে নির্বাচনী উত্তাপ। চার মাস আগে জামায়াত সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করে মাঠ গরম করে, আর বিএনপি প্রার্থী ঘোষণার পর পুরো এলাকায় শুরু হয় প্রচারণার দৌড়ঝাঁপ। মিছিল, উঠানবৈঠক ও পথসভা দিন দিন বাড়ছে। সাধারণ ভোটারদের ধারণা—এবার লড়াইটা হবে জমজমাট।
একসময় বিএনপি ও চারদলীয় জোটের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনে এবার মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রকাশনা সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ মো. হাবিবুল ইসলাম হাবিব এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইজ্জত উল্লাহ।
বড় দুই দলের প্রার্থীর প্রচারণা, প্রতিশ্রুতি আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে ঘিরে ভোটার মহলে চলছে টানটান আলোচনা। স্থানীয়রা বলছেন—রাস্তাঘাট, জলবদ্ধতা, কর্মসংস্থান, মাদক দমন আর শিক্ষার উন্নয়নই এবার তাদের মূল দাবি। সবকিছু মিলিয়ে সাতক্ষীরা–১ আসন আবারও জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসন হয়ে উঠেছে।
বড় দুই দলের প্রার্থীদের নিয়ে মাঠে সবচেয়ে বেশি আলোচনা। এলাকাজুড়ে এখন তাদের প্রচারণা নির্বাচনী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। দুই প্রার্থীই নিজ নিজ রাজনৈতিক পরিচয়, অতীত কাজ এবং এলাকার উন্নয়ন-পরিকল্পনা তুলে ধরে ভোটারদের কাছে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সাতক্ষীরা–১ আসনের রাজনৈতিক ইতিহাসও বেশ ঘনঘটার। তালা, কলারোয়া ও পাটকেলঘাটা অঞ্চল নিয়ে গঠিত এই আসনে রয়েছে ২৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা। এবারের নির্বাচনে ভোটার প্রায় ৪ লাখ ৯৩ হাজার, যা গত নির্বাচনের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
এ আসনটি সবসময়ই হাতবদল হয়েছে বড় বড় দলের মধ্যে—কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো বিএনপি, কখনো জামায়াত, আবার কখনো জাতীয় পার্টি। রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে—১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের সৈয়দ কামাল বখত সাকী, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির সৈয়দ দিদার বখত, ১৯৯১ সালে জামায়াতের আনসার আলী, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপির হাবিবুল ইসলাম হাবিব, ১৯৯৬ সালের জুনে আওয়ামী লীগের সৈয়দ কামাল বখত সাকী।
এ ছাড়া, ১৯৯৯ সালের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের বি. এম. নজরুল ইসলাম, ২০০১ সালে বিএনপির হাবিবুল ইসলাম হাবিব, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ওয়ার্কার্স পার্টির মুস্তফা লুৎফুল্লাহ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের ফিরোজ আহমেদ স্বপন নির্বাচিত হন। বিগত চার দশকের এই ওঠানামা প্রমাণ করে, সাতক্ষীরা–১ সবসময়ই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি আসন।
তবে এবারের চিত্রটা ভিন্ন—আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি মাঠে নেই বললেই চলে। এতে পুরোপুরি বদলে গেছে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা।
আমি কাজের মানুষ। এলাকার মানুষের পক্ষে লড়াই করেছি এবং করব। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তায় দীর্ঘদিন কাজ করেছি। গ্রামে গ্রামে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। বিশ্বাস করি, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমি জয়ী হব।
হাবিবুল ইসলাম হাবিব, বিএনপির প্রার্থী
আসনটিতে এবার নির্বাচনী ট্রেন থেমে আছে দুটি নাম ঘিরে। বড় দুই দলের প্রার্থীদের নিয়েই মাঠে সবচেয়ে বেশি আলোচনা। এলাকাজুড়ে এখন তাদের প্রচারণাই নির্বাচনী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। দুই প্রার্থীই নিজ নিজ রাজনৈতিক পরিচয়, অতীত কাজ এবং এলাকার উন্নয়ন-পরিকল্পনা তুলে ধরে ভোটারদের কাছে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
১৯৬৫ সালে কলারোয়ায় জন্মগ্রহণ করা মো. হাবিবুল ইসলাম হাবিব ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী থাকাকালীন ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হন। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক এবং সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি-মে এবং ২০০১-২০০৮ পর্যন্ত সাতক্ষীরা-১ আসনের এমপি ছিলেন তিনি। ২০০২ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তার বিরুদ্ধে সাজা হয়—যা তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে দাবি করেন।
হাবিবুল ইসলাম হাবিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার হাত ধরেই আমার ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হওয়া। আমি যখন কলারোয়ায় রাজনীতি শুরু করি, তখন এটা ছিল জামায়াত-প্রভাবিত এলাকা। পরে বেগম জিয়া নিজেই আমাকে দায়িত্ব দেন। এরপর এমপি হয়ে অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। সাতক্ষীরা স্থলবন্দর, অনার্স কোর্স, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উন্নয়ন—এসবই আমার দাবির ভিত্তিতে হয়েছে। শিক্ষা খাতে ৩৭টি স্কুল–কলেজ এমপিও করে প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করি।
তিনি আরও বলেন, মিথ্যা মামলায় আমাকে ৭০ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছিল, যা সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত অন্যায়। পাঁচ বছর জেল খেটে মুক্তি পেয়েছি—এই সরকার পতন না হলে আমি হয়তো বাঁচতাম না। সাধারণ মানুষ যেন এমন হয়রানির শিকার না হয়, সেটাই আমার প্রত্যাশা।
নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি কাজের মানুষ। এলাকার মানুষের পক্ষে লড়াই করেছি এবং করব। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তায় দীর্ঘদিন কাজ করেছি। গ্রামে গ্রামে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি—বিশ্বাস করি, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমি জয়ী হব।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, রাস্তা–ঘাট সংস্কার, পাটকেলঘাটাকে পূর্ণাঙ্গ উপজেলা করা, বিদ্যুৎ সংকট সমাধান, বেকার তরুণদের কর্মসংস্থান, জলাবদ্ধতা নিরসন—এসবই আমার অগ্রাধিকার। আর সবচেয়ে বড় বিপদ মাদক। তরুণদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মাদকমুক্ত সমাজ গড়াই হবে আমার লক্ষ্য।
তালা–কলারোয়ায় জলাবদ্ধতা ভয়াবহ। এটি নিরসনে বড় ধরনের প্রকল্পই একমাত্র সমাধান। এ ছাড়া, রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, অবকাঠামোহীন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, হাসপাতালের সীমিত সেবা—এসব উন্নয়ন করাই আমার পরিকল্পনা।
অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইজ্জত উল্লাহ, জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইজ্জত উল্লাহ দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ অতিক্রম করে দলটির শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছেছেন। ১৯৭৫ সালে ইসলামী সাহিত্য পড়ে ইসলামী রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রশিবিরের সদস্য হন।
পরবর্তীতে তিনি জেলা সেক্রেটারি, জেলা আমির, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২০ সাল থেকে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য। ব্যক্তিগতভাবে তিনি কলারোয়া উপজেলার ফয়জুল্লাহপুর গ্রামের বাসিন্দা, পরিবারে এক ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে।
অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইজ্জত উল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৫ আগস্টের পরও একদল সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ-দখলদার সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। মানুষ যাতে নিরাপদে থাকতে পারে—এটাই নির্বাচিত হলে আমার প্রথম লক্ষ্য। শান্তিতে ঘুমাতে পারবে, ব্যবসা করতে পারবে—এটাই চাই।
নির্বাচনী মাঠে দুই প্রার্থীর অতীত, অভিজ্ঞতা ও উন্নয়ন-দর্শন ঘিরে ভোটারদের মধ্যে চলছে তুমুল আলোচনা। এ আসনের লড়াই হবে শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন বনাম দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার একটি বড় পরীক্ষা—এমনটাই মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা।
তিনি আরও বলেন, তালা–কলারোয়ায় জলাবদ্ধতা ভয়াবহ। এটি নিরসনে বড় ধরনের প্রকল্পই একমাত্র সমাধান। এ ছাড়া, রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, অবকাঠামোহীন স্কুল–কলেজ–মাদ্রাসা, হাসপাতালের সীমিত সেবা—এসব উন্নয়ন করাই আমার পরিকল্পনা।
তরুণদের বিষয়ে তিনি বলেন, মাদক বাড়ছে, এটি বড় সংকট। সামাজিক আন্দোলন না গড়লে মাদকমুক্ত তালা–কলারোয়া সম্ভব নয়। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্যও কাজ করব।
হিন্দু নাগরিকদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা ‘সংখ্যালঘু’ শব্দে বিশ্বাসী নই। জন্মসূত্রে সবাই বাংলাদেশের নাগরিক, সবার অধিকার সমান। আমি এবং আমার দল এই নীতিতে বিশ্বাস করি।
নির্বাচনী মাঠে দুই প্রার্থীর অতীত, অভিজ্ঞতা ও উন্নয়ন–দর্শন ঘিরে ভোটারদের মধ্যে চলছে তুমুল আলোচনা। এ আসনের লড়াই হবে শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন বনাম দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার একটি বড় পরীক্ষা—এমনটাই মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা।
কলারোয়া উপজেলার নতুন নারী ভোটার রাফা ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা চাই রাজনৈতিক লড়াই নয়, বরং আধুনিক, শিক্ষিত ও দুর্নীতিমুক্ত নেতৃত্ব দেখতে। আমাদের শিক্ষার মান ভালো হোক, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে সুযোগ বৃদ্ধি হোক। যুব হিসেবে আমরা চাই আমাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত হোক।
তালা উপজেলার স্থানীয় কৃষক ভোটার আব্দুল হাই বলেন, আমাদের মূল চাহিদা হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক করা, যাতে ধান, সবজি ও মাছ নিয়ে বাজারে সহজে পৌঁছাতে পারে। কৃষি খাতে ভর্তুকি বাড়ানো হোক, আমরা যেন ন্যায্যমূল্যে ধান বিক্রি করতে পারি। যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করা হলে আমরা আরও স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করতে পারব।
সবকিছু মিলিয়ে সাতক্ষীরা-১ আসন এখন যেন অপেক্ষার প্রহর গোনা এক রাজনৈতিক থ্রিলার। মাঠে বিএনপি–জামায়াতের টানা শোডাউন, আর নতুন ভোটারদের পরিবর্তনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা—পরিস্থিতিকে করে তুলেছে আরও রহস্যময়।
সড়ক–যোগাযোগ, জলবদ্ধতা, মাদক দমন, কর্মসংস্থান আর শিক্ষার মানোন্নয়ন—এগুলোই ভোটারদের হাতে থাকা মূল ‘ব্যালট ইস্যু’। প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি আর মাঠের বাস্তবতা মিলিয়ে এবার আসনটি হয়ে উঠেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে নজরকাড়া।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত