
এবার ফাঁকা মাঠে ছাড় পাবে না জোটের প্রার্থী
মোজাফ্ফর রহমান, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা ৪টি সংসদীয় আসনের মধ্যে সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনটি আওয়ামী লীগের ভোট ব্যংক হিসেবে পরিচিতি স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে। মাঝে মধ্যে জামায়াত ও বিএনপি নির্বাচিত হলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে জিততে হয়েছিল তাদের। পরপর দুটি সংসদ নির্বাচনে জোটগত কারনে ওয়ার্কাস পার্টির প্রার্থীকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল আওয়ামীলীগ কে। বিএনপি ও জামায়াত নির্বাচনে না আসায় অনেকটা ফাঁকা মাঠে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক ওয়ার্কাসপার্টি গত দুটি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয় পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের ভাষ্য, জোটের জন্য ছেড়ে দেওয়া এ আসনে দলের নির্দেশেই অনিচ্ছা সত্বেও তারা শরিক দলের প্রার্থীর মুস্তফা লুৎফুল্লা‘র পক্ষে কাজ করেছিলেন। কিন্তু এতদিন ধরে যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন তারাই এবার প্রার্থী হওয়ার বাধা নিষেধ উঠে যাওয়ার সুযোগ নিয়েছেন। এবার এ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী করা হয়েছে ফিরোজ আহমেদ স্বপনকে। কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তিনি। এ ছাড়া ‘বিদ্রোহী’ বা স্বতন্ত্র হয়েছেন আওয়ামীলীগের আরও তিন নেতা। রোববার দুপুর পর্যন্ত মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে তারা তিন জনই টিকে আছেন।
“স্বতন্ত্র ৩ প্রার্থী যা বলছেন”
স্বতন্ত্র প্রার্থী ও দলীয় নেতারা বলছেন, সাতক্ষীরার তালা ও কলারোয়া উপজেলার ২৪ টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা-০১ সংসদীয় আসন। দুটি উপজেলাতেই আওয়ামী লীগের সাবেক ও বর্তমান দুই প্রভাবশালী নেতা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। দলটির নৌকা প্রতিক নিয়ে এবং স্বতন্ত্র হয়ে ১৯ টি ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী তৃনমূল নেতারা। এই সংসদীয় আসনে ওয়ার্কাস পার্টির কোন সাংগঠনিক অবস্থাও তেমন নেই। দুই জোটের কারনে নৌকা প্রতিক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ওয়ার্কাস পার্টির নেতা মুস্তফা লুৎফুল্লা আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের চরমভাবে অবমূল্যায়ন করেছেন। মুস্তফা লুৎফুল্লা নৌকা প্রতিক নিয়ে দুইবার সংসদ সদস্য হয়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার মনোনীত নৌকা প্রতিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষতিগ্রস্থ্য করেছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতাকারী নাশকতাকারীদের সেল্টার দিয়ে তালা উপজেলা খলিষখালী ও মাগুরা ইউনিয়নে ওয়ার্কাস পার্টির প্রার্থী দিয়ে একটি জোর করে তার দলের হাতুড়ী প্রতিকের প্রার্থীকে নৌকা প্রতিকের প্রার্থীর বিরুদ্ধে মাত্র ১০ ভোট বেশি করে চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। এসমব কারনে সংসদ সদস্যেও বিরুদ্ধে তৃনমূল আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা চরমক্ষুব্ধ। বিগত দুটি সংসদ নির্বাচনে যারা ভোটের মাঠে থেকে জয় নিশ্চিত করেছে তাদের অবমূল্যায়ন করেছে ওয়ার্কাস পার্টি। শুধু তাই নয়, ১০ বছর ধরে এই আসটি ওয়ার্কাস পার্টির দখলে থাকলেও এলাকার তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। এ নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে যেমন ক্ষোভ রয়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগের নেতাদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ভোটের মাঠে মুস্তফা লুৎফুল্লা‘র কোন ইমেজ নেই।
তালা ও কলারোয়া উপজেলার ২৪ টি ইউনিয়ন নিয়ে সাতক্ষীরার ১ আসন গঠিত। আসনটিতে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে ওয়ার্কাস পার্টির সাতক্ষীরা জেলা কমিটির সভাপতি মুস্তফা লুৎফুল্লা ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য হন।
এ আসনে স্থানীয় নেতাকর্মীদের ভাষ্য, মহাজোটের শরীক ১৪ দলের স্বার্থে গত দুটি সংসদ নির্বাচনে অনিচ্ছা সত্বেও তাদের ওয়ার্কাসপার্টির প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নিবাচনে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা সরদার মুজিব স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। তার পক্ষে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু ওয়ার্কাস পার্টির প্রার্থী নিজের পরাজয় নিশ্চিত ভেবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করেন। তাতে ব্যর্থও হন। পরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রায়ত মুনসুর আহমেদ ও সাধারন সম্পাদক নজরুল ইসলামের নির্দেশে দলীয় নেতাকর্মীরা ওয়ার্কাসপার্টির নেতা মুস্তফা লুৎফুল্লা‘র পক্ষে মাঠে নামেন।
এবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ভিভিন্ন সভা সমাবেশে ওয়ার্কাস পার্টির বিরুদ্ধে ভোটের মাঠে থাকার অঙ্গিকার করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর ছড়াছড়ি সাতক্ষীরা-১ আসনে।
“প্রার্থীরা যা বলছেন”
একাদশ সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও নানা নাটকীয়তা তাকে পরাজিত হতে হওয়া সরদার মুজিব এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তিনি সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের কেন্দ্রিয় কমিটির যুগ্মসাধারন সম্পাদক। সরদার মুজিব বলেন, গত দুটি নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা দলীয় মনোনয়ন চেয়েও পাননি। এবারো এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের অন্তত ১২ জন দলীয় মনোনয়ন চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগের কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফিরোজ আহমেদ স্বপন দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে দলটির নেতারা ধরেই নিয়েছেন, এবারো মহাজোটের শরিকদেরই কজ¦ায় থাকবে আসনটি। সে ভাবনা থেকে তাঁর মতো অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত প্রবীণ নেতা সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়র শেখ মুজিবর রহমান বলেন,আমি ছাত্রজীবন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে আছি। দশম সংসদ নির্বাচনে এক বার বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। জনপ্রিয়তা না থাকলে এটা সম্ভব হতো না। সে সময় সংসদীয় আসনে বহু উন্নয়ন করেছিলেন দাবী তার। এর পর দীর্ঘ সময়ে আর তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। তৃনমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ও ভোটাররা ওয়ার্কাস পার্টির নেতা শরীক দলের সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুল্লা এর কর্মকান্ডে সন্তষ্ট নন। গত ১০বছরে ভাল কোন কাজ এলাকায় করেনি তিনি। আওয়ামী লীগকে গ্রুপিং করে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। সেই সুযোগটা কাজে লাগাতেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি দাবী ইঞ্জিনিয়র শেখ মুজিবুর রহমানের। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী মেখ নুরুল ইসলাম। তিনি দীর্ঘদিন ধরে তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। শহীদ পরিবারের সন্তান হয়ে ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে টানা ৪৭ বছর ধরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে থেকে পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সাতক্ষীরা-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ১০/১৫ দিন দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনী মাঠেও ছিলেন। হঠাৎ ১৪ দলের শরীক ওয়ার্কাস পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দেয়ায় শেখ নুরুল ইসলাম নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে দাড়াতে বাধ্য হন। দলক্ষমতায় টানা ১৫ বছর থাকলেও সুবিধা বঞ্চিত এই নেতা এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
“শরিকরা যা বলছেন”
মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ দিদার বখ্ত এবারও জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পেয়ে প্রার্থী হয়েছেন। এবার তিনি সাতক্ষীরা-১ আসনে অনেক শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। বর্তমান সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুল্লা’র বিতর্কিত কর্মকান্ডে ফলে সাধারন ভোটারদের মধ্যে তিনি অনেকটা আস্তার ও ভরসার স্থান করে নিয়েছেন। নির্বাচনী এলাকায় সৎ ও ক্লিন্ন ইমেজ রয়েছেন তার। তিনি বলেন, এত দিন যারা আসনটিতে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরা নিজেদের উন্নয়নে মনোযোগী থাকায় সাতক্ষীরা ১ তালা-কলারোয়া উপজেলা মানুষ উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সৈয়দ দিদার বখ্ত আরও বলেন, তিনি মন্ত্রী থাকার সময়ে তালা ও কলারোয়া উপজেলায় ব্যাপক উন্নয়ন করে ছিলেন। এর পর দীর্ঘ সময়ে জনপ্রতিনিধি না হয়েও আমি এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, সেতুসহ নানা উন্নয়নে অবদান রাখার চেষ্টা করেছি।
মহাজোটের শরিক জাসদ দলীয় প্রতীক ‘মশাল’ নয়, এবার ‘নৌকা’ প্রতীকে ভোট করার আবেদন করেছে ইসির কাছে। এবার এ আসনে জাসদের কেন্ত্রীয় নেতা ও সাতক্ষীরা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুস সুলতান মাঠে নামায় ওয়ার্কাস পার্টির বর্তমান সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুল্লাহ অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।
১৪ দলের শরীক ওয়ার্কাস পাটির নেতা বর্তমান সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুল্লা বলেন, সাতক্ষীরা -১ আসনে উন্নয়ন হয়নি বলে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা সত্য নয়। সারা দেশের মতো তালা ও কলারোয়া উপজেলায় যথাসাধ্য উন্নয়ন করেছি।