মোঃ বেলায়েত হোসেন : বাংলাদেশের সীমান্তের তিন পাশে স্থল এবং এক পাশে জল। ৩২ টি সীমান্তবর্তী জেলার মধ্যে ৩০টি ভারতের সাথে এবং ৩ টি মিয়ানমারের সাথে। অন্যদিকে একমাত্র জেলা রাঙ্গামাটির সাথে ভারত ও মিয়ানমার দু-দেশে রয়েছে সীমান্ত সংযোগ। স্থল সীমান্তের মধ্যে ভারতের সাথে ৪১৫৬ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের সাথে ২৭১ কিলোমিটার (সূত্রঃ ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর)। যার ৯৪ শতাংশ (৯৪%) ভারতের সাথে এবং বাকী ৬ শতাংশ মিয়ানমারের সাথে।
নীলাকাশে সাদা মেঘের ভেলা, তার নিচে সবুজ শ্যামল পাহাড়। একাকার আকাশ, মেঘ আর পাহাড়। কে কার সাথে মিশেছে তা যেন ঘোলক ধাঁধা।আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমন্ত সেই পাহাড়ের বুক চিঁড়ে চলে গেছে পাহাড়ী ঝিরি আর ঝর্ণা। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য তিন জেলা। এত সৌন্দর্য থাকার পরও নিরবিচ্ছিন্ন সড়কের অভাবে পর্যটন থেকে শুরু করে শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সকল মৌলিক এবং নাগরিক সুবিধা পেতে বেগ পেতে হয় এ অঞ্চলের মানুষের। পার্বত্যাঞ্চলের খাগড়াছড়ির সাথে ভারতের, বান্দরবানের সাথে মিয়ানমারের এবং রাঙ্গামাটির সাথে উভয় দেশের সীমান্ত সংযোগ। ভূ-রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ তিনটি জেলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ইস্যুতে সমুদ্র বিজয় এবং ভারতের সাথে ছিটমহল বিনিময় অনন্য অর্জন।
সীমান্তবর্তী কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানের সংঘাত ও অস্থিতিশীল দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এখনো চলছে। অরুনাচলের নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) ঘিরে ভারত চীনের দূরত্ব, সংঘাত নতুন নয়। বিশ্বের আরও অনেক দেশ রয়েছে যাদের অরক্ষিত সীমানা নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে বিরোধ, সংঘাত, যুদ্ধ শেষ হচ্ছে না। সুরক্ষিত সীমানা, সীমান্ত সড়ক একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তাকে যেমন অক্ষুন্ন রাখে, ঠিক তেমনি প্রান্তিক মানুষের জীবন যাত্রা উন্নয়নের জন্যও মাইলফলক। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্রগ্রাম শান্তি চুক্তির মাধ্যমে প্রথম এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান ও ভাগ্য উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করেন। দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখতে দেশের তিন পার্বত্য জেলা হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সড়ক খাগড়াছড়ির রামগড়ের ফেনী নদীরকূল হয়ে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির সাজেক- বড়কল- বিলাইছড়ি হয়ে বান্দরবানের রুমা- থানচি- আলীকদম- নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুনধুম টেকনাফে শেষ হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমান্ত সড়ক ও সংযোগ সড়কসহ প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য ১০৩৬ কিলোমিটার। একনেক(ECNEC) কর্তৃক প্রথম পর্যায়ে অনুমোদিত ৩১৭ কিলোমিটারের মধ্যে ১৭৩ কিলোমিটার সড়ক বর্তমানে যান চলাচলের উপযোগী। ১৪৪ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণ কাজ ২০২৪ এর মধ্যে সম্পন্ন হবে। বাকী ৭১৯ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ হবে আগামী ১০ বছরের মধ্যে। (তথ্য সূত্রঃ আইএসপিআর)
জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ অনুসারে পিছিয়ে থাকা তিন পার্বত্য জেলার খাগড়াছড়িতে শিক্ষার হার ৪৪.০৭%, রাঙ্গামাটি ৪৩.৬০%, বান্দরবানে ৬৩.৬৪%। এতে বুঝা যাচ্ছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারনে দুর্গম এলাকায় ছেলে -মেয়েরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তুলনামূলক কম বসতির এলাকা হওয়ায় একটি স্কুল অন্যটি থেকে বেশ দূরে। অনেকে ১০-১৫ কি.মি. কিংবা আরও বেশি দূরত্বের পাহাড়ি পথ হেঁটে করে অদম্য শক্তি নিয়ে স্কুলে যায়। দুরত্ব আর দারিদ্র্যের পীড়নে অভিভাবকদের কপালে ভাঁজ আর স্কুলে ঝরে পড়ার হার সমান্তরালে এগিয়ে যায়। অদম্য শক্তির পরাজয় ঘটে। প্রাথমিকের গন্ডি কোন মতে পার হতে পারলেও মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ শিক্ষা তাদের কাছে দূর আকাশের তারার মতো। সীমান্ত সড়ক এবং সংযোগ সড়কের মাধ্যমে এ অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় পরিবর্তন আসায় শিক্ষার হার দ্রুত বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। খুব দ্রুত গাড়ি যোগে স্কুলে পৌঁছাতে পারবে। যা ২০৪১ সালের উন্নত ও সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক হবে।
প্রকল্পটির বাস্তবায়ন এখন স্বপ্ন নয়, সত্যি। সীমান্ত এবং সংযোগ সড়ক পাহাড়ের অন্ধকার ঘুছিয়ে দিচ্ছে। নাগরিক সুবিধা পেতে শুরু করেছে এ লোকালয়ের মানুষ। ১৫-২০ কি.মি. কিংবা তারও বেশি পাহাড়ি ঝিরি পথ হেঁটে পাহাড়,ছড়া অতিক্রম করে চিকিৎসা সেবা নেওয়া সম্ভব হতো না। এতে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতো অনেক রোগী। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতিতে তারা এখন দ্রুত মোটরসাইকেল কিংবা অন্যান্য গাড়ী যোগে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে।
সাজেক বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। এর অবস্থান রাঙ্গামাটিতে হলেও যেতে হয় খাগড়াছড়ি হয়ে। এর দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। প্রতিটি ঋতুতেই এর আলাদা সৌন্দর্য পর্যটকদের বিমোহিত করে। সকালে দরজা খুলে বের হতেই যদি মেঘের ভেলা আসে স্বাগত জানাতে কিংবা মেঘ থেকে বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য খুব কাছ থেকে দেখা যায় কিংবা ভরা পূর্ণিমায় তারার মেলায় জোছনার আয়োজন কিংবা সাতসকালে সুর্যের আলোক প্রভা শিশিরে ভিজে থাকা ঘাসে পড়ে রঙধনুর সাত রঙে চোখ রাঙ্গায় তাহলে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছু নেই। শহুরের ইট -পাথরের দেওয়ালে আবদ্ধ থেকে বুঝা যায় না বাংলাদেশে এত সুন্দর পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। এখানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী লুসাই পরিবারের বসবাস। আমাদের দেশের লোকজন অবকাশ যাপনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যায়। অনুরূপভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোকজনও আমাদের দেশে আসে, তবে দুর্গম এবং ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় নিরুৎসাহিত হয়। সীমান্ত সড়কটি এ ধরনের সমস্যা সমাধানে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। রামগড় হয়ে সীমান্ত সড়ক ধরে সাজেক যাওয়া যাবে অনায়াসে। ঢাকা থেকে সাজেকের দূরত্ব প্রায় ৩৩৮ কি.মি। সীমান্ত সড়ক হয়ে সাজেক যেতে প্রায় ৪০-৫০ কি.মি. পথ কমে যাবে। ফেনী নদীর কূল ধরে এ পথে যেতে যেতে দেখা যাবে কোথাও সুবিশাল পাহাড়, আবার কোথাও ঝিরি, আবার কোথাওবা ঝর্ণা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যিই যে সীমান্ত সড়ক রাস্তাটি পুরোটাই একটি পর্যটন এলাকা। মেরিন ড্রাইভকে হার মানাবে। পাহাড়ের বুক ছিড়ে আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু যে সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে তার সৌন্দর্য নিজের অজান্তেই মনকে পুলকিত করে। ইট-পাথরের কোলাহলে বেড়ে উঠা শ্রান্ত, জীবন্মৃত যখন এমন মন মাতানো সৌন্দর্য দেখে ; ফিরে পায় মোহিত প্রাণ। মনে হয় এ যেন অন্য এক বাংলাদেশ; নৈসর্গিক স্বপ্নপুরীতে মানবের শুভযাত্রা। এ সড়ক ধরে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে। নতুন নতুন পর্যটন স্পর্ট আবিষ্কার হচ্ছে। পার্বত্য তিন জেলায় পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এ অঞ্চলে পর্যটন বিকাশের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নিজেকে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে পারে এবং এর মাধ্যমে সরকারের প্রচুর রাজস্ব আয় সম্ভব। দরকার শুধু সদিচ্ছা এবং কার্যকরী পদক্ষেপ।
এ সড়ক পার্বত্য জেলাগুলোর সীমান্তে নানা ধরনের অপরাধ যেমন- মাদক, চোরাচালান, অস্ত্র, মানব পাচার ছাড়াও আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কার্যক্রমসহ সকল অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিতে অনন্য ভূমিকা রাখবে। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সন্ত্রাসী কার্যক্রম পাহাড়ে বসবাসকারী সাধারণ নাগরিকদের জন্য আতংকের। দুর্গম এবং সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে সাধারণত আঞ্চলিক সংগঠনের সশস্ত্র লোকদের অবস্থান। এখনো তারা চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে। এমনকি রাষ্ট্র বিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রমেও তারা সম্পৃক্ত। অন্তঃ কোন্দল, আধিপত্যকে কেন্দ্র করে মাঝে মাঝে হতাহতের খবর শোনা যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগান্তকারী উন্নতিতে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহলের কারণে তাদের কার্যক্রম দিনে দিনে কমে যাবে বলে আশা করা যায়। চোরাচালান হ্রাস পেলে আমদানী – রপ্তানিতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে যা জিডিপি’তে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। মিয়ানমারের সাথে সীমান্ত সড়ক বাংলাদেশের বিষ ফোঁড়া নামক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ব্যবসা- বাণিজ্যের প্রসারে উন্মেষ ঘটবে।
পাহাড়ের মাটি সমতলের চেয়ে ব্যতিক্রমি। উর্বরতার কারনে পাহাড়ে নানা ধরনের প্রচুর ফল, শাক-সবজিসহ অন্যান্য কৃষি পণ্য উৎপাদিত হয়। যোগাযোগ ব্যবস্হার অভাবে এসব পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হতো জুম চাষীরা কিংবা পণ্য পঁচে যেতো। সীমান্ত এলাকার কৃষিপণ্য দেশের মূল ভূখণ্ডে পরিবহনের মাধ্যমে এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে। পার্বত্যাঞ্চলে বিভিন্ন উপজাতিদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক তৈরি, খাদ্যশষ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের নিমিত্তে বিভিন্ন শিল্প কারখানা স্থাপন এবং দ্রুত পণ্য পরিবহনের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার বড় নিয়ামক হিসেবে সীমান্ত সড়ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে এবং তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। এ সড়ক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করবে।
লেখকঃ সহকারী তথ্য অফিসার রামগড়,খাগড়াছড়ি