শেখ আব্দুল হামিদ : ঈদের আমেজ শেষ না হতেই বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের মানুষ চিকিৎসা সেবা নিতে আবারও ভারতমুখী হয়ে উঠেছেন। সীমান্ত এলাকায় প্রতিনিয়ত রোগীদের ভিড় বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতি, দালালদের দৌরাত্ম, অসাধু কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, দলবাজি, কর্তব্যে অবহেলা, ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের কারিশমা আর ডাক্তারদের বাণিজ্যিক মনোভাবে তৃণমূলের স্বাস্থ্য সেবা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। মফস্বলের সরকারী হাসপাতালে দুপুরের পর অধিকাংশ ডাক্তাররা থাকেনা। নিস্ব: অসহায় মানুষগুলো সরকারের সাপ্লাইকৃত উন্নতমানের ওষুধ পায়না। আর মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা প্রতিদিন ছুটছে ভারতে। চিকিৎসার নামে চলছে শুভংকরের ফাঁকি। প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চলছে কসাইবৃত্ত। বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে সিরিয়ালের নামে চলছে ক্ষমতা ও লেনদেন বাণিজ্য। ভূয়া ডাক্তারের কবলে পড়ছে অসহায় রোগী। সব মিলিয়ে খুলনা অঞ্চলের মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পেতে সারা বছর থাকেন ভারতমূখী।
সূত্রমতে, খুলনা আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগীদের ভিড় অবর্ণনীয়। সিট নেই আবার তদবীর আর টাকা হলেই সিট মিলে যায় মুহুর্তেই। যে অপারেশন বাইরের ক্লিনিকে এই হাসপাতালের ডাক্তাররাই করছেন, সেই রোগী আবু নাসেরে আসলে নানা অজুহাতে প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠানো হয়। এটি নিত্যা দিনের ঘটনা। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৃথক ভবন নির্মাণ এবং ১০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি পড়ে থাকলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পূর্ণাঙ্গভাবে একযুগেও চালু হয়নি ক্যান্সার ইন্সটিটিউট। খুলনার কোনো সরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ইনসেপ্টিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) নেই। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে নানামুখী সংকট, অনিয়ম, দুর্নীতি ও নৈরাজ্য চলছে। আবার বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারগুলোয় চলছে সীমাহীন বাণিজ্য। বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনিস্টিক সেন্টারের ডাক্তাররা দু’হাতে কামাচ্ছেন সাধারণ মানুষের রক্ত চুষে কমিশনের টাকা। গোটা খুলনাঞ্চল জুড়ে চলছে মার্কেটিং ম্যানেজার ও প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম। ছলে বলে কলে কৌশলে তারা রোগীদের ম্যানেজ করে সরকারী হাসপাতালের বদলে পাঠাচ্ছে প্রাইভেট ক্লিনিকে।
রোগীদের অভিযোগ, মফস্বলের অনেক সরকারী ডাক্তারও তাদের কমিশন বাণিজ্যের কারণে পাঠিয়ে দিচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল নামধারী কসাইখানাগুলোতে। আর বিবেকবর্জিত অনেক ডাক্তারই চেম্বারে বসে নানা কৌশলে নিরীহ অসহায় রোগীদের নানা টেস্টের নামে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছেন।
এক অনুসন্ধানে জানা যায়, সাধারণত প্রশাব পায়খানা, রক্ত, কফের মত পরীক্ষার জন্য রোগীর কাছ থেকে আদায় করা ফি ২০-৩০ শতাংশ কমিশন নেন চিকিৎসকরা। অন্যান্য পরীক্ষা ও প্রযুক্তিভেদে ৩০-৫০ শতাংশ কমিশন তদের দিতে হয়। হাসপাতালে রোগী পাঠানোর ক্ষেত্রে ১০-২০ শতাংশ, থেরাপির ক্ষেত্রে ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দেয়া হয়। কমিশনের টাকা কেউ নেন মাসে, কেউ সপ্তাহে আর কেউ দিনে। এছাড়া কেউ নেন নগদ আবার কেউ নেন চেকে বা নিজের ব্যাংক একাউন্টে। এছাড়া ঔষুধ লেখার জন্য আগে থেকেই ঔষুধ কোম্পানীর কাছ থেকে কমিশনের নামে নানা রকম সুযোগ সুবিধা নেয়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময় বিদেশী বা চোরাইপথে আসা দামীয় ওষুধ থেকেও কমিশন পেয়ে থাকেন প্যাকেজের আওতায় চিকিৎসা করা বেশিরভাগ চিকিৎসক।
একজন মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ বলেন, খুব কম সংখ্যক ডাক্তার পাওয়া যায় যাদের আমরা প্রভাবিত করতে পারিনা বা কমিশন নেন না। এছাড়া আজকাল ডাক্তাররা ভারতের অনুমোদন বিহীন ফুড সাপ্লিমেন্ট প্রেসক্রিপশনে লিখছেন। ফুড সাপ্লিমেন্ট এখন ওষুধের দোকানে হরহামেশা বিক্রি হচ্ছে। ফুড সাপ্লিমেন্ট সাপ্লাইয়ের চক্রটি ডাক্তারদের মোটা অংকের কমিশন দিচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিম্নবিত্তের এই বৃহৎ জনগোষ্ঠি মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবার পরিবর্তে বিভিন্নভাবে প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সহায় সম্বল হারিয়ে ভুল চিকিৎসায় অনেকে পথে বসছে। বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসা সেবায় অপরাধ দমনে র্যাব ও পুলিশের কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালিত হয়েছে। খুলনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালিত হয়। এতে নামী দামী বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের গোমর ফাঁক হয়ে যায়। ক্লিনিক খুলে ভূয়া ডাক্তার অপারেশন করছেন। তাদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে অনেকেই সর্বশান্ত হয়েছেন। আবার প্রশাসনের হাতে অনেকে ধরাও পড়েছেন। তবে সরকারী হাসপাতাল গুলো রয়ে যায় অদৃশ্য কারণে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
খুলনার কৃতি সন্তান ডা: বিধান চন্দ্র ঘোষ দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, কমিশন বাণিজ্যের জন্য কেবল চিকিৎসকদের দায়ী করলে চলবে না। সংশ্লিষ্ট সবাই এর জন্য দায়ী। তবে সংশ্লিষ্ট সব সেক্টর থেকে যার যার মত করে এ কমিশন বাণিজ্য বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে। আর সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষ করে ডাক্তারদের নৈতিকতা চর্চার বিষয়ে বিএমডিসি, ঔষুধ কোম্পানীর ক্ষেত্রে ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, হাসপাতাল বা ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই কমিশন বাণিজ্য ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, যারা এদেশের স্বাস্থ্য সেবায় সন্তুষ্ট নয় তারাই যায় অন্য দেশে।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত