জন্মভূমি ডেস্ক : সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। গবাদি পশু, পরিবারের নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে স্বাভাবিক জনজীবন।
এছাড়া ভয়াবহ বন্যায় খামারিরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পানির তোড়ে পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, সুনামগঞ্জ পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বুধবার সন্ধ্যায় বিপৎসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার, ছাতকে ১৪৩ সেন্টিমিটার এবং পুরাতন সুরমা নদীর পানি দিরাই পয়েন্টে ২৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বুধবার সকাল থেকে বৃষ্টি ছিল; যে কারণে পানি বেড়েছে। তবে বিকাল থেকে নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। নদী তীরবর্তী জনপদ থেকে পানি সরলেও হাওর জনপদে পানি বাড়ছে।’
আজ বৃহস্পতিবার (২০ জুন) পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শনে আসবেন বলে জানান নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় বন্যার্তদের সংখ্যা ৬ লাখ ৬০ হাজার ৩৪৭ জন। ৭৮টি ইউনিয়ন ও চারটি পৌরসভার প্রায় ১ হাজার ১৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গত তিনদিন ধরে পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে লোকালয়, রাস্তাঘাটসহ সরকারি-বেসরকারি একাধিক প্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করেছে।
বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় জেলায় এরই মধ্যে ৫৪১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৮ হাজার ৪২৯ জন বন্যার্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের বেশিরভাগ সড়ক পানিতে নিমজ্জিত থাকায় সড়ক পথ বন্ধ রয়েছে। বন্যার্তদের চিকিৎসার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নের গঠন করা হয়েছে মেডিকেল টিম।
বন্য কবলিতদের সহায়তায় সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন থেকে একটি কট্রোল রুম খোলা হয়েছে। ওই কট্রোল রুমের দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার আনিসুর রহমান ইমন বলেন, ‘মঙ্গলবার ৯৫ মেট্রিকটন জিআরের চাল, নগদ দুই লাখ টাকা, ৬০০ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং ৫০০ প্যাকেট রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হয়েছে।’
বুধবার সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ পৌরসভার কালিপুর গ্রামের পূর্ব দক্ষিণ মাথায় অবস্থিত কৃষক মতি মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দেখার হাওরের থৈ-থৈ জলে অর্ধেক ডুবে আছে। বাড়ির পেছনে তিনটি ছোট নৌকা বাঁধা।
মতি মিয়ার স্ত্রী ৬২ বছর বয়সী আফরোজা খাতুন বলছিলেন, ‘কিভাবে চলতাম, আর কিভাবে খাইতাম। ঘরো হাঁটু পানি; খাওয়ার এক ফোটা পানি নাই। চহির (খাট) উপরে চহি তুইলা বইয়া আছি। পাঁচটি গরু পাশের বাড়ির ছাদে রাখছি।
‘কেউ আমরারে দেখতে আইছে না। কিচ্ছু দিছে না। আরেক বাড়ি থেকে রান্না কইরা আইনা খাইছি।’
আফরোজার ছেলে আব্দুন নূর বলেন, ‘ছেলে মেয়ে ও বাবাকে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠাই দিছি। আমি আর মা রইয়া গেছি।’
‘আমরার ঘরো পানি ঢুকতাছেই। রান্না-বাড়া, খাওয়া-দাওয়া সব বন্দ। বড় কষ্টর মধ্যে আছি।’
কুতুবপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সুরমা নদীর পানি উপচে গ্রামে ঢুকে সড়ক তলিয়ে গেছে। চলাচলের রাস্তায় প্রায় তিন ফুট পানি। হাঁটু পানি ভেঙে মূল সড়কে ওঠার চেষ্টা করছিলেন মো. রুবেল নামের গ্রামের এক ব্যক্তি।
তিনি বলেন, ‘অবস্থা খুব খারাপ। গেরামের বেশিরভাগ বাড়িতে পানি। রাস্তাঘাট সব তলই গেছে। আমরা বিপদে আছি।’
একই গ্রামের ৬০ বছর বয়সী রুহুল আমিন বলেন, ‘পানির লাগি থাকতে পাররাম না। আমরা কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না। অনেক মানুষ বাড়ি তইয়া আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘মানুষ যেমন তেমন; গরু-বাছুর লইয়া আমরা বিপদে আছি। গরুর খাওনের পানিতে খড় নষ্ট হই গেছে। এখন রাখার জাগা নাই।’
এদিকে পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের প্রায় তিন হাজার পুকুরের ছয়শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামসুল করিম। তিনি বলেন, ১৭ জুন রাত থেকেই পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে খামারিদের পুকুর ডুবে মাছ ভেসে গেছে। পানি কমলে মাছের পাশাপাশি তাদের অবকাঠামোরও ক্ষতি হবে।
সুনামগঞ্জ শহরের খামারি রফিক মিয়া বলেন, ‘আমি ব্যাংক থেকে ঋণ এনে মাছ চাষ করেছিলাম। আমার সাড়ে তিন লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। এখন চোখে অন্ধকার দেখছি।’
বুড়িস্থলের খামারি রহমত আলী বলেন, ‘আমার প্রায় ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমিও ঋণ তুলে মাছ চাষ করেছিলাম। এর মধ্যে এককালীন টাকা দিয়ে পুকুর ভাড়া নিয়াছিলাম। এখন আমার পথে বসা ছাড়া উপায় নাই।’
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রসহ বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে। তবে পানি কিছুটা কমায় মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে।’