সিরাজুল ইসলাম , শ্যামনগর
সাতক্ষীরা সুন্দরবন, বাংলার মানুষদের গর্ব করার মতো এক ঐতিহ্য। প্রকৃতি এমন একটি বনস্বর্গ আমাদের উপহার দিয়েছে যেটা নিয়ে সারা বিশ্বের কাছে গল্প করা যায়। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশীদার এই সুন্দরবন। গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন আমাদের এই সুন্দরবন। কী নেই এখানে? বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল এই বনভূমি। আরও আছে চিত্রা হরিণ, কুমির, বিষাক্ত সাপ, কচ্ছপ আরও কত কী! এছাড়া আছে সুন্দরী, গরান, কেওড়া গাছের মতো বিচিত্র রকমের গাছ। এই ঐতিহ্যবাহী জঙ্গলে আছে পরিবার নিয়ে মানুষের বসবাস। তারা মধু সংগ্রহ করে, কাঠ কেটে, মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে চলে। এসব জীবিকা নির্বাহ করে থাকার সময় এসব মানুষদের কত যে বিপদের সম্মুখীন হতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। মধু সংগ্রহ বা কাঠ কাটতে যাওয়ার সময় বাঘে নিয়ে যাওয়ার ভয়, সাপ কামড়ানোর ভয়, নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার পর কুমিরের ভয় ইত্যাদি সর্বদা তাদের চিন্তার কারণ। তবুও মানুষ থাকে সেখানে। তাদেরকে থাকতে হয়। আর তাদের সাথে থাকে তাদের দেবতারা [১]।
সুন্দরবনে মানুষের আগমন বিষয়ে অনেক ধরনের তত্ত্ব আছে। অনেক পণ্ডিত মনে করেন যে অষ্টম থেকে দশম শতকের মধ্যে সুন্দরবনে মানুষ বসবাস শুরু করে। মধ্যযুগের দিকে বিভিন্ন কারণে সেখান থেকে মানুষের বসবাস উঠে যায়। অনেকে মনে করেন, পর্তুগীজ এবং আরাকানদের আক্রমণের কারণে তাদের জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। আরও বিভিন্ন ধরনের ঘটনা প্রচলিত আছে। যেমন, দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে এক সুফি সাধক এখানে এসে বসবাস শুরু করেন এবং এখানে কৃষি কাজের সূচনা করেন। কোনো কোনো পণ্ডিত ধারণা করেন যে, সুন্দরবনের নদীগুলোতে জীবিকার কাজে কাঠুরে, জেলে এবং কৃষকদের আনাগোনা ছিল। আবার লুটপাট করতেও সেই সতের এবং আঠারো শতকের সময় এই অঞ্চলে ডাকাতদের আনাগোনা ছিল।
প্রথম কবে এখানে মানুষের বসতি শুরু হয়েছিলো এই নিয়ে মতভেদ থাকলেও স্থায়ীভাবে এখানে বসতির শুরু হয় উনিশ শতকের শেষের দিকে। সেসময় ব্রিটিশ কালেক্টর জেনারেল ক্লড রাসেল বনকে দুটি অংশে ভাগ করেন। একটি অংশ বনায়নে এবং কিছু অংশ কৃষিকাজ ও জমি ইজারা দেয়ার জন্য বরাদ্দ করা হয়। তখন থেকেই আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চল, যেমন ওড়িশা, বিহার, ঝারখান্ড, ছত্তিসগড় ইত্যাদি জায়গা থেকে মানুষজন জীবিকা এবং জমি ইজারার টানে মানুষজন এখানে বসবাস শুরু করে। মানুষজন এখানে বসবাস শুরু করার পর আরও জায়গা প্রসারণ করতে গাছ কাটা শুরু করে টিলমেন হেনকেল এর সময়, যিনি যশোর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন [২]।
সুন্দরবন জায়গাটি মানুষের জন্য বিপদসঙ্কুল। সেখানে থাকতে থাকতে মানুষজন বিভিন্ন ধরনের বিপদের সম্মুখীন হয়। আবার বিপদের সাথে থাকতে থাকতে তারা বিপদ থেকে মুক্তির বিভিন্ন উপায়ও আবিষ্কার করে ফেলে। উপায়গুলোর মধ্যে কিছু আধ্যাত্মিক, আবার কিছু ব্যবহারিক, যেমন কুমিরদের নিয়ে এখানকার গ্রামবাসীরা আতঙ্কের মধ্যে থাকে। সেজন্য পরিবারের মেয়েরা কুমির ব্রত পালন করে, যাতে করে তারা কুমির দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে পারে। আবার মধু সংগ্রহের জন্য মৌয়ালরা যখন বনের ভিতরে যায় তারা সাথে করে বাউলিদের (Tiger Charmer) নিয়ে যায়। বাউলিদের সম্পর্কে মনে করা হয় যে তারা বাঘ সামলাতে ওস্তাদ। বিভিন্ন মন্ত্রবলে তারা বাঘকে কাছে আসতে দেয় না বা আসলেও তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বাউলি যারা হয় তাদের আবার বিভিন্ন নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যেমন, শুক্রবার যেহেতু জুম্মাবার, তাই এই দিন তারা জঙ্গলে যেতে পারবে না, কাঁকরা কিংবা শূকরের মাংস খেতে পারবে না, সুদের কারবার করতে পারবে না ইত্যাদি। এগুলো মূলত মুসলমান যারা তাদের জন্য প্রযোজ্য। তবে এই অঞ্চলে বাউলিদের জীবনই সবচেয়ে কঠিন এবং অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ [২, ৩]।
সুন্দরবনের মানুষদের আচার আচরণ, রীতিনীতি, জীবনযাত্রার ধরণ, তাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আর্থ-সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি জানার একটি উপায় হচ্ছে সশরীরে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলা বা সাক্ষাতকার নেয়া। আবার আরেকটি উপায় আছে। সেটা হচ্ছে তাদের পুঁথি পড়া। পুঁথিগুলোতে মূলত সেই অঞ্চলের দেব-দেবীর বর্ণনাই বেশী দেয়া আছে।
মূলত হিন্দু এবং মুসলমান এই দুই ধর্মের মানুষদের বসবাস এই সুন্দরবনে। মুসলমানদের মধ্যে সেখানে আছে শেখ, সাইয়িদ, পাঠান ইত্যাদি। অপর দিকে হিন্দুদের মধ্যে সেখানে দেখা যায় নাপিত, কৈবর্ত, চণ্ডাল, জালিয়া, ধোবা, যোগী ইত্যাদি শ্রেণীর মানুষদের। এদের বেশীরভাগই হিন্দুদের শূদ্র গোত্রের। জীবিকার জন্য তাদেরকে বনের উপর নির্ভর করতে হয় এবং প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। সেই জন্য তারা তাদের বিপদ ও সমস্যা সমাধানের জন্য নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং দেবতাদের উপর নির্ভর করে থাকে। দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আলোচিত দক্ষিণ রয় এবং বনবিবি। বনবিবির উৎপত্তি নিয়ে খুব সুন্দর একটি প্রবন্ধমূলক লেখা পড়া যাবে এখানে।
দক্ষিণ রায়কে মনে করা হয় বাঘের দেবতা হিসেবে। সুন্দরবনের বসবাসরত মানুষ তার পূজা করে থাকে। বিভিন্ন রকমের কাল্পনিক ঘটনা আছে তাকে ঘিরে। এই ঘটনাগুলো মানুষের মুখে মুখে রচিত। দক্ষিণ রয়কে অনেকে শিবের পুত্র বলে মনে করে থাকে। আবার অনেকে মনে করে যে, গণেশ দেবতার মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করার পর সেটা দক্ষিণ দিকে ছুটে গিয়ে পড়ে যায় এবং সেখান থেকেই এই দেবতার সৃষ্টি। মরহুম মুন্সী মোহাম্মদ খাতের এর রচিত “বনবিবির জহুরনামা”-তে আছে যে, দক্ষিণ রায়কে জঙ্গলের অপদেবতা বা শয়তান বলেও অনেকে বিশ্বাস করেন।
অপরদিকে বনবিবি হচ্ছে জঙ্গলের আরেক দেবতা যে সবাইকে রক্ষা করে থাকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বনবিবির উপস্থিতিকে হিন্দু এবং মুসলমান উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকজনই বিশ্বাস করে এবং এর শক্তিকে ঐশ্বরিক শক্তি হিসেবে মনে করে থাকে। কিন্তু দুই ধর্মের মানুষদের বনবিবির জন্য ধর্মীয় আচারপূর্ণ অনুষ্ঠান ভিন্নভাবে হয়ে থাকে।
মুসলিমরা এই দেবতাকে বনবিবি বলে থাকে এবং হিন্দুরা তাকে বনদেবী বলে। হিন্দুরা বনদেবীকে মাতৃদেবতার কাতারে স্থান দিয়ে থাকে। শরত মিত্রের লিখিত প্রবন্ধ “ –তে উঠে এসেছে যে, মুসলমানরা যেকোনো মুসলিম পরিবারের কোনো মেয়েকে বনবিবি হিসেবে তৈরি করে এবং তার কাছে লাল পতাকা দিয়ে রাখে। এখানে একটি কথা উল্লেখযোগ্য, হিন্দু এবং মুসলমানদের এরকম বনবিবি নামক কাল্পনিক দেবতাদের বিশ্বাস করা কিন্তু কোনো সোজা ব্যাপার নয়। এর মধ্যে গভীর কিছু চিন্তাধারা আছে। তাদের নিজেদের স্বার্থেই দুই ধর্মের মানুষ একই দেবতার উপর নির্ভর করে। তাদের মতে, যেখানে বেঁচে থাকাই এক ধরনের যুদ্ধের সমান এবং যেখানে টিকে থাকাই মুখ্য, সেখানে এরকম একজন কাল্পনিক চরিত্রের উপর নির্ভর করে থাকতেই হয় এই বিশ্বাস নিয়ে যে, এই দেবতাই তাদের যেকোনো বিপদ থেকে রক্ষা করবে [৪]।
সুন্দরবন সম্পর্কে আমরা অনেক তথ্য জানলেও সেখানে বসবাসরত মানুষ সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? সেখানকার মানুষের চিন্তাচেতনা ও বিশ্বাস বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গা থেকে ভিন্ন এবং আগ্রহোদ্দীপক। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা হতে পারে অন্যরকম। সবুজের কাছাকাছি বসবাস করা এই মানুষগুলোকে নিয়ে গবেষণার বিরাট সুযোগ আছে। বিপদকে সঙ্গী করে এই মানুষগুলো দিনের পর দিন তাদের জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে সেখানে। প্রকৃতির সবচেয়ে কাছাকাছি বাস করা এই মানুষগুলোর সাথে যান্ত্রিক মানুষের পার্থক্যটুকু কোথায় এবং এই পার্থক্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সেটা নিয়ে গবেষণা হতেই পারে।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত