সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : সুন্দরবনের দুবলার চরে এখনও অবাধে কেনাবেচা হচ্ছে শিশুশ্রম। শুধু তাই নয়, সেখানে স্কুলপড়ুয়া শিশুদের কাটাতে হচ্ছে একরকম বন্দি জীবন। এভাবে দরিদ্রতাকে পুঁজি করছেন মহাজনরা।
অভিযোগ উঠেছে, শিশুশ্রম কেনাবেচা বন্ধে প্রশাসন থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। এমন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দাবি তুলেছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুশ্রমের আইন না জানা ও আইন না মানার প্রবণতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। দারিদ্র্যের বেড়াজালে আটকে পড়া শিশুদের শৈশব ধ্বংস করে তাদের দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করানো হচ্ছে। নানা পক্ষ নানারকম যুক্তি দেখালেও এটা স্পষ্ট শ্রম আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?
সম্প্রতি দুবলার চরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ১৪ বছরের কিশোর সাব্বির আহম্মেদ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে হাবিবুল্লা নামের এক মহাজনের কাছে। মৌসুমের ছয় মাস পুরো সময়টা তাকে থাকতে হবে দুবলার চরে। সে কোনোভাবেই বের হতে পারবে না দুবলার চর এলাকা থেকে। এই বন্দিজীবন আর শারীরিক নির্যাতনের ভয়ে সাব্বির চেষ্টা করেছিল পালানোর। কিন্তু পারেনি। সাব্বিরের মতো আরেকজন ১৪ বছরের সাগর। ছয় মাসের জন্য মাত্র ৩৫ হাজার টাকায় সাগরকে কিনেছে মিজান নামের এক ব্যক্তি। সংসারের অভাব অনটন মেটাতে দুর্গম চরাঞ্চলে দিন-রাত কাজ করছে এই দুই কিশোর।
এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পুরো দুবলার চরে তাদের মহাজনকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও দেখা মেলে আরও কয়েকজন শিশুর। তাদের মধ্যে শিহাব উদ্দিনের (১৩) কাছে জানতে চাওয়া হলে সে বলে, সাতক্ষীরা জেলার আছাব উদ্দিন বহদ্দার তাকে নিয়ে এসেছেন দুবলার চরে। পাঁচ মাস এখানে শুঁটকি প্রক্রিয়ার কাজ শেষে তাকে ৩৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে। বাবা বেঁচে নেই, তাই সংসারের ঘানি টানতে সে এই চরে এসেছে।
শিশুদের দিয়ে এভাবে কাজ করানো অপরাধ উল্লেখ করে মোংলা মানবাধিকার সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি নুর আলম শেখ এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বলেন, এ বিষয়ে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে এই প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। এক্ষেত্রে সরকারের শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০-এ যে আইন আছে সেটার পরিবর্তন আনতে হবে।
এ বিষয়ে বন বিভাগের দুবলা জেলে পল্লীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, দুবলার চরে অবস্থানকারীদের সঠিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া, শিশু শ্রম বন্ধসহ বনের অভ্যন্তরে যাতে কেউ অপরাধ করে পার না পায় সে কারণেই এ বছর আইডি কার্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। মৌসুমের প্রথম সপ্তাহ থেকেই জেলেদের আইডি কার্ড প্রদান শুরু করা হয়েছে। এই আইডি কার্ডে দুবলা ফিশারমেন গ্রুপের সভাপতি ও সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তার যৌথ স্বাক্ষর থাকবে। আইডি কার্ড না থাকায় বিগত বছরগুলোতে জেলেদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যে যার মতো কাজ ও চলাচল করেছে। কে শিশু আর কে বয়স্ক তাও বোঝা যায়নি। অপরাধ করেও পার পেয়ে গেছে। এখন কার্ডের মাধ্যমে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত এই বন কর্তার বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবে মিল পাওয়া যায়নি দুবলার চরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুঁটকি উৎপাদনকারী দুবলার চরগুলোতে এ বছর জেলেদের থাকা ও শুঁটকি সংরক্ষণের জন্য ৯৮৫টি ঘর, ৫৭টি ডিপো ও ৯৩টি দোকান ঘর স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। গত মৌসুমের চেয়ে এবার কিছুটা কমিয়ে আনা হয়েছে এই সংখ্যা। শুঁটকি উৎপাদনের লাইসেন্সধারী ১৭ জন বহদ্দার বা মহাজনের অধীনে দুবলার আলোরকোল, মাঝের কিল্লা, নারকেলবাড়িয়া ও শ্যালারা চরসহ চারটি চরে ১০ হাজারেরও বেশি জেলে ও শ্রমিক অবস্থান করবেন। তারা পাঁচ মাস ধরে সাগরে মৎস্য আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণে নিয়োজিত থাকবেন এই চরগুলোতে।