সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : সুন্দরবনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল প্রায় ৩১ লক্ষাধিক মানুষ। সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী রেঞ্জ অফিসার খন্দকার মনিরুল ইসলাম জানান, এরমধ্যে প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল প্রায় ৬ লক্ষাধিক বনজীবী।
তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বর্তমানে কেবল মৌসুমী গোলপাতা আহরণ, মধু সংগ্রহ, মৎস্য আহরণ ও ইকোট্যুরিজম চালু রয়েছে।
সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পেশাজীবী তৈরী হয়েছে।
এরা হলেন- বাওয়ালী, মৌয়াল, মালঙ্গী, কাগজী, জোংড়াখুটা ও মৎস্যজীবী অন্যতম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বনজীবীরা দুর্দিন পার করছেন।
কাঠ কেটে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের বাওয়ালী বলা হয়। সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাঠ কাটা হয়।
বাওয়ালীরা দলবদ্ধভাবে কাঠ কাটে। এ সময় তাদের টানা ১৫ দিন থেকে ১ মাস পর্যন্ত বনে থাকতে হয়।
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে মৌয়ালী। বর্তমানে সুন্দরবনে মধুর প্রাপ্যতা বাড়ার কারণে মৌয়ালির সংখ্যাও বেড়েছে। সুন্দরবনে লবন উৎপাদন করেন মালঙ্গী। প্রাচীনকাল থেকে এ অঞ্চলে লবন তৈরীর কারখানা ছিল।
সুন্দরবনের গেওয়া কাঠ কাগজ উপাদনের উৎকৃষ্ট কাঁচামাল। কাগজ উৎপাদনের সঙ্গে যেসব শ্রমিক জড়িত তাদের কাগজী বলা হয়। সুন্দরবনের বিচিত্র সব সম্পদের সঙ্গে বিচিত্র পেশারও উদ্ভব ঘটেছে।
সুন্দরবনে নদী-নালায় জোয়ারের সময় আসে শঙ্খ, ঝিনুক, জোংড়া। ভাটার সময় তা সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন জোংড়াখুটা।
নাব্যতা কমছে নদীর: সম্প্রতি সুন্দরবন পরিভ্রমণের অংশ হিসেবে (১০ অক্টোবর) পশ্চিম বনবিভাগের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট অফিস ঘাট থেকে খোলপেটুয়া নদী দিয়ে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় যাওয়ার পথে মাঝি বলছিলেন, এক সময়ের বিপুল জলরাশির এসব নদীর অনেক গুলোরই নাব্যতা কমে গেছে।
কতদূর যেতেই জেগে ওঠা চরে আমাদের নৌকা আটকে গেলে সত্যতা মেলে মাঝির কথার। উজানের পানির প্রবাহ পূর্বের মতো না থাকায় সুন্দরবনের এরকম বহু নদীই নাব্যতা হারাচ্ছে বলে জানালেন বনবিভাগের কর্মকর্তারাও।
লবনাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় মিঠা পানির অনেক মাছের এখন আর দেখা মেলে না। নৌকায় আমার সঙ্গী হওয়া স্থানীয় সাংবাদিক আকবর কবির ও সুন্দরবনের মৎসজীবী শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ছোটবেটখালী গ্রামের আব্দুল্লাহ মোড়ল জানালেন, পূর্বে যে পরিমাণ মাছ মিলতো সুন্দরবনে, এখন তার সিকি পরিমাণও নেই।
তাই সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা সংগ্রহ করা জেলেরা চরম দুর্দিন পার করছেন। বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী না হওয়ায় এখন তাদের অনেকের দিন কাটে শুয়ে বসে। সুন্দরবনের পূর্বে পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া, বরগুনা জেলার পাথরঘাটা, পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিন চব্বিশ পরগণা জেলা। উত্তরে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, খুলনার কয়রা, দাকোপ, বাগেরহাটের মংলা, মোড়েলগঞ্জ ও শরণখোলা আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
সুন্দরবনের মোট ভূমি ৫ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে ৪ লাখ ১ হাজার ৬শ’ হেক্টর বনভূমি ও ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬শ’ হেক্টর নদী ও খাল। প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের সুন্দরবনের ৪ হাজার ২শ’ ৬৬ বর্গকিলোমিটার ভারতের।
বর্তমানে সুন্দরবন বনবিভাগ ৪টি রেঞ্জে বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে- শরণখোলা (বাগেরহাট), চাঁদপাই (বাগেরহাট), নলিয়ান (খুলনা) ও বুড়িগোয়ালিনী (সাতক্ষীরা) রেঞ্জ। এসব রেঞ্জের অধীন ১৬টি স্টেশন অফিস, ৩৯টি টহল ফাঁড়ি, ৫৫টি কম্পার্টমেন্ট ও ২৩টি অস্থায়ী কূপ রয়েছে।
মেঘনা ও পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথীর ব-দ্বীপাঞ্চলে অবস্থিত সুন্দরবনে মেঘনা, তেতুলিয়া, কাজলা, আগুনমুখি, বামনাবাদ, বলেশ্বর, ভোলা, সন্ধ্যা, মারজাত্তা, শিবসা, মালঞ্চ, হাড়িয়াভাঙ্গা, রায়মঙ্গল ইত্যাদি নদ-নদীর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। আন্ত:সম্পর্কযুক্ত প্রায় সাড়ে ৪শ’ নদী-খাল সুন্দরবনের দুইশ’র মতো দ্বীপ বেষ্টন করে আছে। বনের পশ্চিম সীমার বড় নদী রায়মঙ্গল ও হরিণভাঙ্গা।
এখানকার বেশিরভাগ নদীর উৎপত্তিস্থল গঙ্গা ও পদ্মা। সুন্দরবনের প্রধান নদী পশুর। বড় অন্য নদীগুলো হচ্ছে গড়াই, খোলপেটুয়া, কপোতাক্ষ, মালঞ্চ, যমুনা, আড়পাঙ্গাসিয়া, শিবসা, মরতাজ, বলেশ্বর, কালিন্দী, ভোলা, চালকি, আড়–য়া, চুনার, রায়মঙ্গল, ভদ্রা, সুতারখালী, চুনকুড়ি, হরিণভাঙ্গা, দুধমুখী, কয়রা, হংসরাজ, আন্ধারমানিক, কৃঙ্গা, শেলা, দেবেকি, মাতলা, জামিরা, সপ্তমুখী, পানকুশি, সরলী বিবিধ।
বেড়েছে মধুর পরিমাণ: সুন্দরবনে নানামুখি সংকট বিরাজ করলেও বনের অন্যতম আকর্ষণ সুস্বাদু মধুর প্রাপ্যতা বেড়েছে বলে দাবি মৌয়ালদের। বিশেষ করে ঘূর্নিঝড়, সিডর ও আইলায় সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর গড়ানসহ অন্যান্য বৃক্ষ কাটার সরকারি অনুমোদন পুরোপুরি বন্ধ। এরফলে মধুর প্রাপ্যতা বৃদ্ধির কারণ বলে জানান মৌয়াল ও বনবিভাগের কর্মকর্তারা।
সুন্দরবনের অসংখ্য বনফুল থেকে মৌমাছি মধু তৈরী করে থাকলেও সবচে’ সুস্বাদু মধু হয় গড়ান গাছের ফুল থেকে। এপ্রিল থেকে মে মাস মধু সংগ্রহের উত্তম সময়। এ সময় মৌয়ালরা বনবিভাগ থেকে পারমিট নিয়ে মধু সংগ্রহে বনে যায়।
সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের তথ্য অনুযায়ি ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে কেবল এই অঞ্চলেই মধু আহরিত হয়েছে ৯ হাজার ৬৭৫ মণ। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫ কটি৩৫ হাজার টাকা।
পর্যটন সুবিধা বাড়ানোর দাবি: উদ্ভিদ ও প্রাণি বৈচিত্রের অপূর্ব মিলনক্ষেত্র নয়নাভিরাম সুন্দরবনকে ঘিরে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রবল উৎসাহ সুদীর্ঘ কাল থেকেই। তবে পর্যটকদের অনুপাতে বাড়েনি প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা। ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই সুন্দরবন পরিভ্রমণে আসতে শুরু করেন প্রচুর বিদেশি পর্যটক। সেই ধারাবাহিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে ক্রমান্নয়ে।
তবে সে অনুপাতে পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি বললেই চলে। বনবিভাগের তথ্য অনুসারে- ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সুন্দরবনে পরিভ্রমণে আসেন ৮২ লাখ ৬৬৬ জন পর্যটক। এরমধ্যে ৮হজার ২৩৩ জন বিদেশিও ও বাকিটা দেশে পর্যটক। সে বছর রাজস্ব আহরিত হয়েছে সাত কোটি২৪ হাজার ২১৫ টাকা।
সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্যকে স্বীকৃতি জানিয়ে ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর একে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বলে ঘোষণা করে। ১৯৯৯ সালের ৩১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুন্দরবনের নীলকমল অভয়ারন্যে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ফলক উন্মোচন করেন।
সুন্দরবনের আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকাগুলো হচ্ছে- সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার চুনা নদীর তীরে মুন্সীগঞ্জ, আড়পাঙ্গাসিয়া নদীর তীরে বুড়িগোয়ালিনী, মালঞ্চ নদীর তীরে দোবেকী, পুষ্পকাঠি, সমুদ্রতীরবর্তী মান্দারবাড়ী, খুলনার বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী নীলকমল, শিবসা নদীর তীরবর্তী শেখেরটেক, সুতারখালী নদীর তীরে সুতারখালী।
এছাড়া শিবসা নদীর তীরে নলিয়ান, সুতারখালী নদীর তীরে কালাবগী, বল নদীর তীরে ঝালিয়া, হংসরাজ নদীর তীরে পাটকোষ্টা, শেলা নদীর তীরে চাঁদপাই, পশুর নদীর তীরে ঢাংমারী, করমজল, জোংরা, শেলা নদীর তীরে মৃগামারী, পশুর নদীর তীরে হারবাড়িয়া, ভোলা নদীর তীরে শরণখোলা, বলেশ্বর নদীর তীরে সুপতি, কচিখালী ও সমুদ্র তীরবর্তী কটকা, দুবলার চর অন্যতম।
দুবলার চরে সাগরমেলা: সুন্দরবনের আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র দুবলার চরে কার্ত্তিকের পূর্ণিমা বা তিথির ভিন্নতায় অগ্রাহায়ণ মাসে বসে সাগর মেলা। সাগর স্নান উপলক্ষে বসে রাশ মেলা। একে গঙ্গা স্নানও বলা হয়। একসময় এ তীর্থ যাত্রায় হিন্দু সম্প্রদায়ের নিম্নগোত্র ক্ষত্রীয় ও নম:শূদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ আসলেও এখন এটি সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
ঠিক কবে কখন এ উৎসব চালু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস জানা নেই কারোর। মূলত: সাগর দেবীর মনোবাসনা পূরণে দেবী ভোগ দিতে এখানে আসেন হিন্দু ধর্মের মানুষ। এই তীর্থ উৎসবে যোগ দিতে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষ আশপাশের এলাকা ও দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন। দুবলার চরের তীর্থ মেলায় অনেক সৌখিন সামুদ্রিক জিনিষপত্রের পসরা সাজিয়ে দোকান বসে। বিশেষ আয়োজনে থাকে কীর্ত্তন ও পদাবলী সংগীতানুষ্ঠান।
সংকট মোকাবেলায় কিছু সুপারিশ: কেবল বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা জন্যই নয়- বাংলাদেশের ভৌগলিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য সুন্দরবনের ভূমিকা অপরিহার্য। সুন্দরবনের বহুমাত্রিক এসব গুরুত্ব বিবেচনায় এনে বনের চলমান ও ভবিষ্যত সংকট মোকাবেলায় স্থানীয় গবেষক ও নিসর্গপ্রেমীদের নানা প্রচেষ্টা রয়েছে।
বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে সুদীর্ঘ সময় সাংবাদিকতা ও বিষয়ভিত্তিক তথ্য গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এসএম আতিয়ার রহমান। তিনি বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের উপ-পরিচালক হিসেবে। নিসর্গপ্রেমী আতিয়ার রহমান জানালেন সুন্দরবনের সংকট নিয়ে তাঁর নিজস্ব কিছু সুপারিশের কথা। তাঁর এসব সুপারিশগুলো হচ্ছে-
সুন্দরবনের অভ্যন্তরে সব ধরণের মাছ শিকার বন্ধ করে পুরো সুন্দরবনকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করা।
সুন্দরবনে যেসব নৌকা বা জলযান কাঠ আহরণ বা মধু সংগ্রহে প্রবেশ করবে সেসব নৌকায় রেডিও কলার বা জিপিএস সিস্টেমের আওতায় আনা।
মাছ, কাঠ ও মধু আহরণ ছাড়াও যেসব নৌকা বা ট্রলার বঙ্গোপসাগর কিংবা উপকূলীয় অগভীর সমুদ্রে যাবে তাদেরকেও একই সিস্টেমের আওতায় আনা।
সুন্দরবনের পশুর চ্যানেলের দুই পাশে সোলার লাইটিং বসিয়ে এ চ্যানেলে দিনরাত নেভিগেশন সুবিধা নিরাপদ করা।
দুবলারচর, আলোরকুলের মতোস্থানে সৌরবিদ্যুত চালিত বরফকল স্থাপন করে সাগর থেকে ধরা মাছ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া।
সুন্দরবন বিভাগকে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় নিয়ে আসা। একইসঙ্গে জনবলবৃদ্ধি, ঝুঁকিভাতা, পানিভাতাসহ তাদের চাকরী আকর্ষণীয় করা এবং লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানো।
সুন্দরবনের প্রধান প্রধান মাছের প্রজনন পঞ্জি তৈরী করা।
সুন্দরবন বিভাগের আওতায় পৃথক ফিশারীজ উইং তৈরী করা।
সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার একটি নির্দিষ্ট জনপদকে বিশেষ জোন ঘোষণা করে তাদের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা। যাতে- সেই জনগোষ্ঠীর সুন্দরবনের সম্পদের উপর নির্ভরতা কমে।