
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে ২০১৮ সালে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়েছিলো। কিন্তু এখন সেখানে আবারও অপরাধের কালো ছায়া ভর করেছে। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর থেকে এই উপকূলীয় অঞ্চলে বনদস্যুদের উত্থান তীব্রতর হয়েছে। ফিরে এসেছে পুরনো ভূত—যারা অপহরণ, মুক্তিপণ আর নির্যাতনের নামে উপকূলকে আতঙ্কিত করছে। যে বন ছিলো বনজীবীদের জীবিকা, তা এখন হয়ে উঠেছে শত্রু। পুরনো আত্মসমর্পণকারীদের সঙ্গে নতুন গোষ্ঠী মিলে কমপক্ষে ২০টি দস্যু বাহিনী এখানে প্রভাব বিস্তার করছে। বিশেষ করে পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে (যেমন: মরা ভোলা, আলী বান্দা, ধঞ্চে বাড়িয়া, টিয়ার চর) তাদের দৌরাত্ম্য চরম। জেলে, বনজীবী ও ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে কাঁপছেন। সেই সঙ্গে উপকূলের অর্থনীতি বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে।
গত এক মাসে সুন্দরবনে শতাধিক জেলে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে দস্যু বাহিনী। আক্রান্তরা দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে দ্রুত যৌথ অভিযান পরিচালনার দাবি জানিয়েছেন। তবে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তার ভাষ্য, বনদস্যুদের সঙ্গে ফাইট করতে তেমন প্রস্তুতি তাদের নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত এক বছরে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাওয়া তিন শতাধিক জেলে অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর শতাধিক জেলেকে জিম্মি করে বনদস্যুরা। এর মধ্যে অনেকেই গোপনে মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করে ফিরে এসেছেন। এখনও বিভিন্ন বাহিনীর হাতে জেলেরা জিম্মি বলে জানিয়েছেন মৎস্য ব্যবসায়ীরা। পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের মরা ভোলা, আলী বান্দা, ধঞ্চে বাড়িয়া, তেঁতুল বাড়িয়া, টিয়ার চর, আন্ধারমানিক, পশুর, শিবশাসহ বিভিন্ন এলাকায় জলদস্যুদের বিচরণ বেশি।
বন বিভাগ, জেলে ও ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, দস্যুরা বিভিন্ন নামে দল গঠন করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আগের আত্মসমর্পণকারী বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ব্যক্তি এবং বিভিন্ন মামলার দণ্ডিতদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে দলগুলো। এসব বাহিনীদের মধ্যে জাহাঙ্গীর বাহিনী, মনজুর বাহিনী, দাদা ভাই বাহিনী অস্ত্র ও সদস্য সংখ্যায় বেশি ও ভয়ঙ্কর। এই তিন বাহিনীর সদস্যরা আগে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবন জীবনে ফিরে গিয়েছিলো। এছাড়া করিম-শরিফ বাহিনী, আসাদুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী, রবি বাহিনী, দুলাভাই বাহিনী, রাঙ্গা বাহিনী, সুমন বাহিনী, আনোয়ারুল বাহিনী, হান্নান বাহিনী,আলিম বাহিনী ,আলম বাহিনীও আলিফ বাহিনীর নাম উল্লেখযোগ্য।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বন সংলগ্ন এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি দস্যুদের মধ্যস্থতাকারী ও সোর্স হিসেবে কাজ করছেন। তারা অপহৃত হয়ে জিম্মি থাকা জেলেদের পরিবার ও তাদের মহাজনদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে চাঁদার টাকা আদায় করে দস্যু বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়। বিভিন্ন দস্যু বাহিনী নিজ নিজ সঙ্কেত বসানো টোকেন দিচ্ছে জেলেদের। জলদস্যুর এই টোকেন নৌকায় থাকলে নিরাপদে মাছ ধরা যায় বনে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শরণখোলার একাধিক মাছ ব্যবসায়ী জানান, দস্যুদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা নিরাপদ নয়। বনের পাশে জেলে মৎস্য আড়তের আশেপাশে দস্যুদের প্রতিনিধি বা সোর্স ঘোরাফেরা করে। তথ্য ফাঁসের বিষয়ে জানতে পারলে পরে বনে গেলে জেলেদের ওপরে নির্যাতন চালানো হবে, বেড়ে যাবে চাঁদার অংক। এই ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে জেলে বা মহাজন কেউই মুখ খুলছেন না।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্য বনে জেলেদের পাঠালে নৌকা প্রতি ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। অপহরণের ঘটনায় মুক্তিপণ হিসেবে দিতে হয় ৫০ থেকে এক লাখ টাকা। এ কারণে অনেক জেলে এখন বনে মাছ ধরতে যেতে চান না।
কোস্টগার্ড মংলা পশ্চিম জোনের স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আবরার হাসান বলেন, গত বছরের পাঁচ আগস্টের পর থেকে সুন্দরবনের দস্যুদের উৎপাত শুরু হয়েছে। এরপর থেকে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি বিশেষ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। দস্যু দমনে অভিযান এবং তাদের অবস্থান সনাক্তকরণে গোয়েন্দা বিভাগ কাজ করছে। গত তিন অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় ২৭টি অভিযান পরিচালনা করেছে কোস্টগার্ড। এসব অভিযানে ৪৪ জন বনদস্যু এবং তাদের সহযোগীদের আটক করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে দেশি-বিদেশি ৪০টি আগ্নেয়াস্ত্র ৪৩ টি বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম। এছাড়া ১৭০ রাউন্ড তাজা কার্তুজ, ৩৬৯টি ফাঁকা কার্তুজ, দুটি ককটেল এবং ৪৭৯ টি স্প্লেন্ডার উদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি বনদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা ৪৮ জেলেকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়েছে।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ বাগেরহাটের বিভাগীয় কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী এই প্রতিবেদককে বলেন, ডাকাতের সঙ্গে ফাইট করতে ওইভাবে আমাদের প্রস্তুতি তেমন নাই। কিন্তু আমরা স্টাফদের বলেছি ফায়ার আর্মস বাড়ানোর জন্য, পর্যাপ্ত স্টাফ নিয়ে যাওয়ার জন্য। দস্যুদলের তথ্য ও তালিকা আমরা অন্য বাহিনীকেও দিয়েছি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ‘সুন্দরবন রক্ষায় আমরা’ সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী নুর আলম শেখ বলেন, পাঁচ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সুন্দরবনে বনদস্যুদের অপতৎপরতা বেড়েছে। সুন্দরবন আগের ভয়াবহ সেই অবস্থায় ফিরেছে। বনজীবীরা বনে যেতে ভয় পাচ্ছেন, ব্যবসায়ীরাও আতঙ্কে। এমন পরিস্থিতিতে উপকূলের অর্থনীতি হুমকির মুখের পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, দস্যু দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা উচিত। এরা যে শুধু যে বনজীবী ও ব্যবসায়ীদের কাছে আতঙ্ক তা’ই নয়, জীববৈচিত্রের জন্য হুমকি। দস্যুতার পাশাপাশি তারা বাঘ, হরিণ শিকার করে মাংস, চামড়া ও কঙ্কাল পাচার করে। বনের মূল্যবান কাঠও পাচার করে তারা। নজরদারির অভাবে সুন্দরবনে আবারও বেড়েছে বনদস্যুদের তৎপরতা। বনের ২০টি পয়েন্টে বেপরোয়া ২০টি বাহিনী। জেলে ও বাওয়ালিদের জিম্মি করে এই বাহিনীর সদস্যরা লাখ লাখ টাকা আদায় করছে। মুক্তিপণ ছাড়া মিলছে না কারও মুক্তি। চলে নির্যাতনও। আতঙ্কিত বনজীবীদের অনেকেই ভয়ে পেশা বদলাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে জনবল ও অস্ত্র সংকটের কথা বলছে বন বিভাগ।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সাল থেকে কয়েক ধাপে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ সদস্য ৪৬২টি অস্ত্র, ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিল। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনকে বনদস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর দীর্ঘদিন সুন্দরবন দস্যুমুক্ত ছিল। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বনদস্যুরা। মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পাওয়া জেলেদের কাছ থেকে জানা যায়, ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে সাতক্ষীরা রেঞ্জের ভারত সীমান্তবর্তী মারডাঙ্গা ও হরিণটানা খাল থেকে ছয়জনকে অপহরণ করে জলদস্যুরা। পরে ২০ হাজার টাকা করে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান তাঁরা।
ভুক্তভোগী শ্যামনগরের টেংরাখালী গ্রামের আতাউর রহমান বলেন, ‘আমাদের ছয়জনকে অপহরণ করে মুন্না বাহিনীর দস্যুরা। এরপর আমাদের মুক্তির জন্য ৫০ হাজার টাকা করে দাবি করে। অপারগতা দেখালে বেধড়ক পেটায়। আমার আঙুল ভেঙে গেছে। সারা দিনে একবার অল্প একটু খাবার জুটত। অবশেষে ২০ হাজার টাকা দিয়ে ফিরে এসেছি। এখন আমি সুন্দরবনে যেতে পারছি না, আবার ডাক্তার দেখাতেও পারছি না।’
আরেক অপহৃত রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘অপহরণের দুই দিন পর আমার মহাজনের মাধ্যমে বাড়িতে সিম পাঠিয়ে দেয় দস্যুরা। বাড়িতে তো এক কানাকড়িও ছিল না। বিভিন্ন জায়গা থেকে সুদ করে টাকা গুছিয়ে আমার স্ত্রী ২০ হাজার টাকা বিহয়েছেন সুন্দরবনসংলগ্নকাশের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। এরপর আমি মুক্তি পাই।’ দস্যুদের মধ্যে ভারতের চারজন ও তাঁদের এলাকার দুজন ডাকাত রয়েছে বলে দাবি রাশেদুলের।
স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে জানা যায়, গত এক বছরে শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও আশাশুনি উপজেলার তিন শতাধিক জেলে অপহৃত হয়েছেন। সর্বশেষ শিকার টেংরাখালী ও ভেটখালী এলাকার বাসিন্দারা। এর আগে দুবলারচরের বাহির সমুদ্রের ৮ নম্বর বয়া এলাকা থেকে ১৫ জেলেকে মুক্তিপণের দাবিতে জিম্মি করে জলদস্যুরা। এর মধ্যে ৯ জনেরই বাড়ি আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরে। ১৭ দিন পর জনপ্রতি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা মুক্তিপণ নিয়ে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ এলাকায় চোখ বাঁধা অবস্থায় ছাড়া পান তাঁরা। সূত্র জানিয়েছে, সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের আন্ধারমানিক, আড়পাঙ্গাসিয়া, শিবসা, মান্ধারখালী, হাতীবান্ধা, ফিরিঙ্গিয়া, ইলশে মারি ,তালপট্টি ,লটাবেকি, কাশিঘাটা, চুনকুড়ি, চালতেবাড়িয়া , মালঞ্চ নদী , পুষ্প কাটি ,কালেশ্বর , ডিংগি মারি,হরিণটানাসহ কমপক্ষে ২০টি পয়েন্টে শরীফী, মজনু, রবিউল, সাগর, মুন্না, দুলাভাই, মঞ্জুর আলম বাহিনী আলমবাহিনীসহ কমপক্ষে ২০টি বাহিনী চষে বেড়াচ্ছে।
পর্যটক গাইড গোলাম মোস্তফা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার অভাবে বছরখানেক ধরে সুন্দরবনে দস্যুদের তৎপরতা বেড়েছে। পর্যটকেরা ডাকাত-আতঙ্কে রয়েছেন।
শ্যামনগরের টেংরাখালী এলাকার বাসিন্দা কমলা দাশ বলেন, ‘আমরা যারা কাঁকড়া ধরতে যাই, তারা রাত হলে ভয়ে থাকি। একদিকে বাঘের ভয়, নদীতে কুমিরের ভয়, অন্যদিকে ডাকাতের ভয়। কোনভাবে আমরা থাকব। তাই বাঁচতে নৌকায় থাকি। সাত দিনের পাস দিলে চলে আসি। এত সাবধানেও মাঝে মাঝে ডাকাতদের কবলে পড়তে হচ্ছে। তাই এখন বনে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছি।’
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে জানান, জেলা ও উপজেলা আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সভায় বনদস্যুদের তৎপরতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সভায় উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সাতক্ষীরার সদ্য যোগদানকারী পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে পুলিশ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা ডাকাতদের বিষয়ে তথ্য দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছি। অনেক ডাকাত সম্পর্কে তথ্য পেয়েছি। কয়েকজনকে আটক করেছি। ডাকাতদের মুক্তিপণ পরিশোধ করতে হয় যেহেতু মানি ট্রান্সফার বিকাশের মাধ্যমে, তাই উপকূলীয় এলাকার বিকাশ এজেন্টদের নিয়ে সভা করেছি। সব মিলিয়ে আমরা সুন্দরবনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করার জন্য অপরাধমূলক কার্যকলাপ বন্ধের বিষয়ে কাজ করছি।’তিনি আরো বলেন আপনারা নিশ্চিত থাকেন আমি যতদিন এই সাতক্ষীরার এসপি আছি জলদস্যুর খবর পেলেই মুহূর্তের ভিতর সেখানে পৌঁছে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব বড় দর্শকদের ব্যাপারে কোন ছাড় দেওয়া হবে না।
সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা ফজলুর রহমান বলেন, ‘বন বিভাগের জনবল ও অস্ত্র সংকট রয়েছে। সীমিত সামর্থ্য নিয়ে আমরা আমাদের এরিয়ায় ৪০০ খালসহ বিশাল এলাকাকে সুরক্ষিত রাখতে কাজ করছি। কিন্তু যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁরা আমাদের কাছে কোনো তথ্য দেন না। সীমান্ত নদী রায়মঙ্গলসহ অন্যান্য খাল ও নদীতে রিভারাইন বিজিবির নির্ধারিত দায়িত্ব রয়েছে। কোস্ট গার্ডেরও রয়েছে নির্দিষ্ট ম্যান্ডেট। সুতরাং সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে বন বিভাগ, কোস্ট গার্ড ও বিজিবিকে যৌথ অভিযান পরিচালনা করতে হবে, তাহলে এর সুফল আসবে।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, দস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তাদের টেকসই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, সামাজিক মর্যাদা দেওয়া জরুরি। নচেৎ আগের মতো সুন্দরবন জলদস্যুদের রাজত্বে পরিণত হবে।
সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণার ছয় বছর পর আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে বনদস্যুরা। নতুন করে অন্তত ২০টি দস্যু বাহিনীর তৎপরতায় অশান্ত হয়ে উঠেছে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন।
পুরোনো আত্মসমর্পণকারী দস্যু এবং নতুনভাবে সংগঠিত দল মিলেই এই বাহিনীগুলোর গঠন। জেলেদের অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়সহ নানা অপরাধে আবারও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে এসব দস্যুবাহিনী।
জেলে ও বনজীবীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর উপকূলজুড়ে বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি। বিশেষ করে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে দস্যুদের আধিপত্য সবচেয়ে বেশি।
২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ধাপে ধাপে ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ সদস্য বিপুল অস্ত্রসহ র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করে। দীর্ঘ ছয় বছর শান্তিপূর্ণ থাকার পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে পরিস্থিতি আবার বদলাতে শুরু করে। ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে দস্যুরা।
আত্মসমর্পণকারী দস্যুদের অভিযোগ, সরকার পরিবর্তনের পর তারা কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হন। অনেকেই ব্যবসা শুরু করেও চাঁদাবাজির শিকার হন। ‘সাবেক দস্যু’ পরিচয়ের কারণে সামাজিকভাবে হেয় হন। বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত অপরাধেও তাদের জড়ানো হয়। হতাশা ও ক্ষোভ থেকেই অনেকেই আবার অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন বলে দাবি করেন জাহাঙ্গীর বাহিনীর প্রধান জাহাঙ্গীর শেখ, দাদা ভাই বাহিনীর জয়নাল আবেদীন ও মানজুর বাহিনীর মানজুর সরদার।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সক্রিয় বাহিনীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, জাহাঙ্গীর বাহিনী, মানজুর বাহিনী, দাদা ভাই বাহিনী, করিম শরীফ বাহিনী, আসাবুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী, রবি বাহিনী, দুলাই ভাই বাহিনী, রাঙা বাহিনী, সুমন বাহিনী, আনারুল বাহিনী, হান্নান বাহিনী, আলিফ আলম বাহিনী, আলিম বাহিনী, বাহিনীসহ আরও ছোট-বড় মিলিয়ে ২০টির বেশি বাহিনী।
প্রতিটি বাহিনীতে ১৫-৪০ সদস্য রয়েছে এবং তাদের হাতে দেশি-বিদেশি বিপুল আগ্নেয়াস্ত্র। বনের মরাভোলা, আলীবান্দা, ধনচেবাড়িয়া, দুধমুখী, শ্যালা, নারকেলবাড়িয়া, তেঁতুলবাড়িয়া, টিয়ারচর, পশুর, আন্দারমানিক, শিবসা– এসব এলাকায় রয়েছে তাদের আস্তানা।
গত এক বছরে তিন শতাধিক জেলে অপহরণের শিকার হয়েছেন। কেবল সেপ্টেম্বরের পর এক মাসে শতাধিক জেলে জিম্মি হন। নৌকাপ্রতি ২০-৩০ হাজার টাকা এবং অপহৃত জেলেকে মুক্ত করতে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ দিতে হচ্ছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বনসংলগ্ন এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি এখনো দস্যুদের গডফাদার হিসেবে সক্রিয়। জিম্মি জেলেদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিপণের টাকা সংগ্রহ করেন তারা। দস্যুদের দেওয়া টোকেন নৌকায় রাখলে নিরাপদে মাছ ধরার সুযোগ দেওয়া হয়।
জেলে ও ব্যবসায়ীরা জানান, দস্যুদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলা নিরাপদ নয়। কারণ আড়ত ও জেলে পল্লির আশপাশে দস্যুদের সোর্সরা সক্রিয় থাকে। তথ্য ফাঁস হলে বনে গেলে নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়ে। অনেকেই এখন আর বনে যেতে সাহস পান না।
সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম এবং ‘সুন্দরবন রক্ষায় আমরা’ সংগঠনের সমন্বয়কারী নূর আলম শেখ কালবেলাকে বলেন, সুন্দরবনের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দস্যুরা শুধু মানুষ নয়, বন জীববৈচিত্র্যের জন্যও বড় হুমকি। তারা বাঘ ও হরিণ শিকার করে তার মাংস, চামড়া, কঙ্কাল পাচার করছে। বন কাঠও কেটে পাচার হচ্ছে। দস্যু ও গডফাদারদের দমন ছাড়া সুন্দরবন রক্ষা সম্ভব নয়।
মোংলা কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের স্টাফ অফিসার লে. কমান্ডার আবরার হাসান কালবেলাকে বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে দস্যুদের তৎপরতা বেড়ে গেলেও কোস্টগার্ড নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে।
গত এক বছরে ২৭টি সফল অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছে ৪৪ দস্যু। উদ্ধার করা হয়েছে ৪০টি আগ্নেয়াস্ত্র, ১৭০ রাউন্ড তাজা গুলি, শতাধিক দেশীয় অস্ত্রসহ নানা সরঞ্জাম। এ ছাড়া জিম্মি থাকা ৪৮ জেলেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগীয় বনকর্মকর্তা এ জেড এম হাসানুর রহমান এই প্রতিবেদককে জানান, বনরক্ষীদের টহল জোরদার করা হয়েছে। দস্যুদের অবস্থান শনাক্তে কাজ চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিত অভিযান শিগগিরই জোরদার হবে।
ভুক্তভোগীদের দাবি, অবিলম্বে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে দ্রুত ও কঠোর অভিযান প্রয়োজন।
র্যাব কোস্টগার্ডের অব্যাহত অভিযান সত্ত্বেও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে এখন আবারও দস্যুতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে এই মুহুর্তে কমপক্ষে ২০টি দস্যু বাহিনী বনজীবীদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। প্রতি গোনে ডাকাতরা জেলে বাওয়ালীদের কাছ থেকে কোটি টাকার চাদা আদায় করছে। বঙ্গোপসাগরের ফিসিং ট্রলার আটক করে জেলেদের জিম্মি তাদের নিত্যদিনের ঘটনা। এমন পরিস্থিতিতে পেশা বদলাচ্ছেন বনজীবীরা। এর ফলে বন বিভাগের রাজস্ব আদায় কমেছে অর্ধেকের নিচে। যদিও কোস্টগার্ড ইতোমধ্যে গত এক বছরে প্রায় ৪৮ জন বনদস্যুকে আটক করেছে। উদ্ধার করা হয়েছে ডাকাত দলের হাতে জিম্মি অর্ধশত জেলেকে। এসময় কোস্টগার্ড বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারূদ উদ্ধার করে। সূত্রমতে, বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ২০১৮ সালের নভেম্বরে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। ৫ আগষ্টের পর সাতক্ষীরা জেলা কারাগার থেকে পালানো দাগি আসামি এবং ৭ বছর আগে আত্মসমর্পণ করা বনদস্যুরা সুন্দরবনে গিয়ে শুরু করেছে নতুন করে দস্যুতা। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সময় লুট হয়ে যাওয়া আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ, মিয়ানমার এবং ভারতের সীমান্ত থেকে বিভিন্ন আধুনিক অস্ত্র ও দেশীয় তৈরী অস্ত্র সংগ্রহ করে ডাকাত বাহিনীগুলো এখন সুন্দরবনের অঘোষিত সম্রাট সেজেছে।
সুন্দরবন বিশে^র বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার। এ বন শুধু প্রকৃতির জন্য নয়, হাজারো জেলের জীবিকার ভরসাস্থল। কিন্তু আজ সেই সুন্দরবনই জলদস্যু ও বনদস্যুদের তৎপরতা বাড়ায় জেলেদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে সুন্দরবনে জেলে অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদা আদায়সহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনা বাড়ছে। সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি সুন্দরবন। সেই বনে আবারও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে বনদস্যু দল। অপহরণ, ডাকাতিসহ নানা অপরাধের অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে সুন্দরবন।
বনজীবী সমিতির নেতা আব্দুল গফুর বলেন, প্রশাসনের কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। যদি সত্যিকারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ভূমিকা নিতো তাহলে সুন্দরবনে ডাকাতে সয়লাব হতো না। বর্তমানে সক্রিয় ৭টি বাহিনীর মধ্যে রয়েছে শরীফ বাহিনী, মামা-ভাগ্নে বাহিনী, আছাবুর বাহিনী, মজনু বাহিনী, জাহাঙ্গীর বাহিনী, আনারুল বাহিনী ও রাঙ্গা বাহিনীর নাম উঠে আসছে। তাদের বিরুদ্ধে অপহরণ, জিম্মি করে নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায়- এমন বেশ কয়েকটি অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী জেলেরা। জানা গেছে, আত্মসমর্পণ করা বনদস্যু আলিম বাহিনীর প্রধান আব্দুল আলিম, মিলন, জিয়া, জনাব ও নুরু বর্তমানে ভারতে বসে চাঁদা দাবি করছে। গত কয়েক বছর ধরে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত থাকলেও বর্তমানে দু-একটি বাহিনী নতুন নামে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
৫ আগস্টের পর থেকে গত এক বছরে কোস্ট গার্ডের অভিযানে ৩৭টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৪৩টি দেশীয় অস্ত্র, বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ ও ককটেল উদ্ধার হয়েছে। মুক্ত করা হয়েছে জিম্মি থাকা অর্ধশত জেলেকে। আটক করা হয়েছে ৪৮ জন ডাকাত ও তাদের সহযোগীদের। আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের কেউ কেউ আবার জড়িয়ে পড়ছে আগের অপরাধে।
বনবিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, সুন্দরবনের বনদস্যুরা কয়েক দফায় আত্মসমর্পণ করে আলোর পথে ফিরেছিল। ২০১৬ সালে সুন্দরবনের সাতটি বনদস্যু দল একসঙ্গে আত্মসমর্পণ করে। সে সময় ৩২ জন বনদস্যু অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার অঙ্গীকার করে। এরপর ২০১৮ সালের পহেলা নভেম্বর ৯টি বনদস্যু বাহিনীর ৫৭ জন বনদস্যু আত্মসমর্পণ করে। পরে আরেক দফায় ২০১৯ সালের পহেলা নভেম্বর আরো ২৫ জন বনদস্যু আত্মসমর্পণ করে। প্রায় শতাধিকের বেশি বনদস্যু আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে, যার কারণে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ার পথে অগ্রসর হয়।
সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও বগেরহাট জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক লায়ন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘বনদস্যুরা সাধারণত বনজীবী কিংবা জেলে বাওয়ালিদের ছদ্মবেশে সুন্দরবনের প্রবেশ করে দস্যুতায় জড়িয়ে পড়ে। এসব বনদস্যুদের ডাটাবেজ তৈরি করে তাদেরকে ডিজিটালাইজড করতে হবে, যাতে সহজেই তাদেরকে চিহ্নিত করা যায়। তাদেরকে বিকল্প কর্মসংস্থানের সাথে যুক্ত করতে হবে। সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এটি শুধু একটি নিরাপত্তার ইস্যু নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সংকটের দিকেও ইঙ্গিত করছে। যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তবে এই প্রাকৃতিক সম্পদ ও এর উপর নির্ভরশীল মানুষের ভবিষ্যৎ আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।’

