সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : সুন্দরবনকে ১৮৭৫ সালে সংরক্ষিত বন ঘোষণার পর থেকেই নির্ধারিত রাজস্ব পরিশোধের বিনিময়ে পাশ-পারমিট প্রথার মাধমেই শুরু হয় এই ম্যানগ্রোভ বনের বনজদ্রব্য আহরণ, মাছ ও হরিণ, পাখি শিকার। ওই সময়ে সুন্দরবন সন্নিহিত এলাকার মানুষজনকে বাঁচাকে রয়েল বেঙ্গল টাইগার হত্যা করাও কোন অপরাধ ছিলনা। এমনকি ইংরেজ শাষকরা বাঘের আক্রমন থেকে লোকজনকে বাঁচাতে ভারত থেকে শিকারি মুন্ডা সম্প্রদায়ের লোকজনকে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় এনে বসতি স্থাপন করায়। বর্তমান সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার সুন্দরবন সংলগ্ন ২৩টি উপজেলার অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবীকার অবলম্বন ছিল সুন্দরবন। পাকিস্তান সৃষ্টির কিছু পরে বাঘ শিকার নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশ স্বধীনের পর নিষিদ্ধ করা হয় হরিণ ও পাখি শিকারও। এরপর ১৯৮৯ সালে নিষিদ্ধ করা হয় সুন্দরীসহ বিভিন্ন গাছ কাটা। ওই সময়ের পর থেকে সুন্দরবনের গাছ কেটে বাজারজাত করে জীবননিবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় ১০ হাজার কাঠুরিয়া-বাওয়ালী বিকল্প কর্মসংস্থান বেছে নেয়। বর্তমানে সুন্দরবন থেকে রাজস্ব পরিশোধের বিনিময়ে পাশ-পারমিট নিয়ে শুধুমাত্র মাছ, কাঁকড়া, মধু, মোম, গোলপাতা ও মালিয়া ছন আহরিত হয়ে থাকে। সুন্দরবন সংলগ্ন পাঁচটি জেলার দুই লক্ষাধিক দরিদ্র জেলে মৌয়াল বাওয়ালিরা ১২ হাজার নিবন্ধিত নৌকা-ট্রলার নিয়ে মাছ, কাঁকড়া, মধু, মোম, গোলপাতা ও মালিয়া ছন আহরণ করে। সুন্দরবন বিভাগ এতথ্য নিশ্চিত করেছে।
বাগেরহাটের পূর্ব সন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলাসহ আলোরকোল, মাঝের কিল্লা, নারকেলবাড়িয়া ও শ্যালারা চরে অস্থায়ি শুঁটকি জেলেপল্লীতে প্রতিবছর ১ নভেম্বর থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত চলে সর্ববৃহৎ সামুদ্রিক মাছ আহরণ করে শুঁটকি উৎপাদন। এই মাছ আহরণ ও শুঁটকির সাথে জড়িত রয়েছে দেড় লাখ জেলে-বহরদার। শুঁটকি প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত জেলেদের রয়েছে বন বিভাগের দেয়া আইডি কার্ড। চলতি মৌসুমে জেলেদের থাকা ও শুঁটকি সংরক্ষণের জন্য ৯৮৫টি ঘর, ৫৭টি ডিপো। গত মৌসুমে ৭৫ হাজার ৪৪২ কুইন্টার আহরিত শুঁটকি। অন্যদিকে একই সময়ে সুন্দরবনের ৪৫০টি নদী খাল থেকে জেলেরা নিবন্ধিত নৌকা-ট্রলার দিয়ে ৭৫০ মেট্রিক টন ইলিশ ও ১৭ হাজার ১৫১ কুইন্টার অন্যান মাছ ও কাঁকড়া আহরন করে।
সুন্দবনের মাঝের কিল্লার অস্থায়ী শুঁটকি পল্লীর জেলে মো. জাহিদ বহাদ্দার ও আলোরকোল শুঁটকি পল্লীর জেলে ফরিদ আহমেদ জানান, চরগুলোতে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। হাজার হাজার জেলের জন্য নিরাপদ খাবার পানি সংকট ও সরকারিভাবে চিকিৎসাসেবার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পানিবাহিত নানা রোগ ও বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে যথাযথ চিকিৎসার অভাবে প্রতিবছর বহু জেলের মৃত্যু হয়। এছাড়া, সাগরতীরের এই চরগুলোতে পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় প্রতিবছর ঝড়-জলোচ্ছাসেও অনেকের মৃত্যু হয় অনেকের। এজন্য তারা শুঁটকি পল্লীর পর্যাপ্ত খাবার পানি সরবরাহ ও অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানান তারা।
অন্যদিকে সুন্দরবনের নদীখালে মাছ ও কাঁকড়া আহরনকারি বাগেরহাটের শরণখোলার ইসমাইল মহানাজ ও মোংলার অভিজিৎ সরকার জানান, সুন্দরবনের জলভাগে এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া য্য়না। একশ্রেনীর জেলে নামধারী দূর্বৃত্ত অধিক মুনাভার লোভে ভাটার সময় জাল পেতে নদীখালে বিষ দেয়ার কারনে মাছ মরে যাচ্ছে। এতে করে সুন্দরবনের মৎস্য ভান্ডার বিনাশ হচ্ছে। এখন আর আগের মতো মাছ ও কাঁকড়া পাচ্ছিনা। কখনো কখনো আমাদের পাশ-পারমিটের রাজস্বের টাকাও উঠছেনা। আমাদের খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। আনেকে এখন সুন্দরবনের মাছ আহরণ না করে বিকল্প কর্ম করে খাচ্ছে। তারা সুন্দরবনে বিষ সন্ত্রাসীর দ্রুত আটক করে কঠোর শাস্তির দাবি জানান।
বিশ্বখ্যাত সুন্দরবনের মধু বাগেরহাটের জিআই পন্য। সুন্দরবনে মার্চ থেকে শুরু হয়েছে তিন মাসব্যাপী শুরু হয় মধু আহরণ মৌসুম। গত আহরণ মৌসুম শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ থেকে ৩৬৫টি পাশ-পারমিট নিয়ে ২ হাজার ৪৫০জন মৌয়াল ৯৫৩ দশমিক ৫০ কুইন্টাল মধু ও ২৮৬ দশমিক ১০ কুইন্টাল মোম আহরণ করে।
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের মৌয়াল নুরুল ইসলাম ও খুড়িয়াখালী গ্রামের মৌয়াল আউয়াল খান জানান, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারনে এখন সুন্দরবনে গাছে সঠিক সময়ে ফুল আসছেনা। সুন্দরবনের সবচেয়ে উৎকৃষ্টমানের যে মধু সেটা আসে খলিসা এবং গরাণ ফুল থেকে। পশ্চিম সুন্দরবন অঞ্চলের সঠিক সময়ে খলিসা এবং গরাণ গাছে আগাম ফুল চলে আসে। কিন্তু এই সময়ে আমাদের পূর্ব সুন্দরবনে এই সময় খলিসা ও গরাণ গাছে ফুল আসেনা। পুরো এপ্রিল মাস খলিসা ও গরাণ ফুলের মধু সংগ্রহ হয়। মে মাসজুড়ে থাকে সুন্দরী, কেঁওড়া ও ছইলা ফুল থাকে। এর পর জুন মাসে শুরু হয় গেওয়া ফুল ফোটে।
তবে, জুন মাস থেকে সুন্দরবনের সব ধরণের জলজ ও মধুসহ বনজ সম্পদ আহরনে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ায় গেওয়া ফুলের মধু সংগ্রহ সম্ভব হয়না। আমরা আহরণ মৌসুমে ১৪ দিনের পাশ-পারমিট নিয়ে একেক দলে ১০ থেকে ১২ জন করে মৌয়াল সুন্দরবনে গেলেও কাঙ্খিত মধু পাইনা। গতবছর তাদের দলের প্রত্যেক সদস্য মোমসহ মধু ৩০ কেজি পেয়েছিলেন। পাস সংগ্রহ, সরকারি রাজস্ব এবং খাওয়া খরচ মিলিয়ে মৌসুমে তাদের প্রতিজনের খরচ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। প্রতিকেজি মধু বিক্রি হয়েছে প্রকার ভেদে গড়ে ১ হাজার টাকায়। তাদের দলের কেউ ১৫ বছর কেউ ২০ বছর ধরে মধু আহরণ করছেন। এখন মধু আহরণ নৌকা মেরামত, ১৪ দিনের খাবার ও মহাজনের কাছ থেকে দাদনে টাকার পরিশোধ করে মৌয়ালদের কিছুই থাকছেনা। সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ কম হওয়ায় বংশ পরাম্পরা মৌয়াল পরিবারগুলোর অধিকাংশই এখন পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে বলে জানান তারা।
সুন্দরবনে প্রাকৃতিক অর্থকরী সম্পদ গোলপাতা। নামে গোল হলেও এ পাতা গোলাকার নয়, লম্বা সবুজ বর্ণের এ পাতা নারকেলগাছের পাতার মতোই। প্রতিবছর নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মালিয়া ছন ও জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে সুন্দরবন থেকে গোলপাতা আহরণ করে বাওয়ালিরা। আগের তুলনায় বর্তমানে গোলপাতার ব্যবহার কমলেও জীবিকার তাগিদে পুরানো পেশা টিকিয়ে রেখেছেন বাওয়ালিরা। গত মৌসুমে সুন্দরবনের চারটি গোলপাতা কুপ থেকে দুই হাজার কুইন্টাল গোলপাতা ও ৫৫০ কুইন্টাল মালিয়া ছন আহরিত হয়।
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ডাকরা এলাকার বাওয়ালী এনাম হোসেন জানান, কম দাম, শক্ত ও অধিক টেকসই হওয়ার কারণে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় ঘরের ছাউনির কাজে মালিয়া ছন ও গোলপাতা ব্যবহৃত হত। মালিয়া ছন ও গোলপাতার ছাউনির ঘর থাকে গরমের সময় ঠান্ডা, আর শীতের সময় গরমভাব অনুভূত হয়। মালিয়া ছন ও গোলপাতা দিয়ে ভালো ভাবে ঘরের ছাউনি দিলে চার পাঁচ বছর পার হয়ে যায়। এখন টিনের দাম কম হওয়ায় দিন দিন মালিয়া ছন ও গোলপাতার ব্যবহার কমেছে।
আহরণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো মালিয়া ছন ও গোলপাতায় ভালো ব্যবসা নেই জানিয়ে শরণখোলা উপজেলার চাল রায়েন্দা গ্রামের বাওয়ালি সোহরাপ খলিফা বলেন, লোকালয়ে আনার পর এখন এক কাউন (১৬৮০টিতে এক কাউন) ভালো গোলপাতা দুই হাজার টাকাও বিক্রি করা যায়না। মালিয়া ছনেরতো ভালো বাজার দন নেই। এসব কারনে বাওয়ালিরা দিনদিন সুন্দরবন থেকে মালিয়া ছন ও গোলপাতা আহরণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
বাগেরহাটের পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এ জেডএম হাসানুর রহমানজানান, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেয়া হলেও রনানা সংকটে বাওয়ালী ও মৌয়ালদের মধ্যে আগ্রহ একটু কম থাকায় চলতি মৌসুমে মালিয়া ছন, গোলপাতা ও মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নাও হতে পারে। এদিকে এলা জুন থেকে তিন মাসের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবন এ প্রবেশ এতে মারাত্মক বিপাকে পড়তে যাচ্ছে বনজীবী রা প্রায় লক্ষ দিক মানুষের জীবন জীবিকার পথ সুন্দরবন কেউবা এই সুন্দরবনে কাকড়া আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে কেউবা আবার সাদামা চিংড়ি মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু ১লা জম থেকে তিন মাসের জন্য সুন্দরবনে সব ধরনের প্রবেশ অধিকার নিষিদ্ধ থাকবে, এ ব্যাপারে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জার ৩০ বিএলসির বিপরীতে প্রায় ২০ হাজার বনজীবীর রুটি রোজগার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সে কারণে বনজীবীরা মারাত্মক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছে,