সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সম্প্রীতি সুন্দরবনে শামুক পাচার কাণ্ড নিয়ে চলছে সারা দেশে তোলপাড় কিন্তু বিষয়টা একদিনের ব্যাপার নয় এটি চলছে যুগ যুগ ধরে কিন্তু বন বিভাগ আমলে নিয়ে এসেছে এখন । দেশের স্থানীয় সহ জাতীয় পত্রিকা ও ইলেকট্রিক মিডিয়া খবর প্রকাশ হলে তারপরে নড়েছে বন বিভাগ। বন বিভাগের এর আগে না জানার ভানে ছিলেন । জনগণ ও সংবাদকর্মীরা অপরাধটি সামনে নিয়ে আসলে সুন্দরবনের শামুক পাচার নিয়ে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন বনবিভাগ ।সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় (ম্যানগ্রোভ) বন সুন্দরবন এখন নতুন ও নীরব এক বিপদের মুখোমুখি। একটি অসাধু চক্র সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত নদী, খাল ও জলাশয় থেকে নির্বিচারে শামুক আহরণ করে পাচার করছে। যা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের নতুন হুমকি।
সুন্দরবনের নদী-খাল থেকে প্রতিদিন প্রকাশ্যে ট্রলার ও নৌকায় ভরে নির্বিচারে শামুক সংগ্রহ করা হচ্ছে। পরে এসব শামুক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার হচ্ছে।
এ ছাড়াও এসব শামুক অসাধু একটি চক্র নদীপথে অবৈধভাবে ভারতে পাচার করছে বলে স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে।
এই শামুকগুলো মূলত চিংড়ি ও কাঁকড়ার খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাছের খাবার হিসেবেও এর চাহিদা বাড়ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চড়া দামে এসব শামুক অবৈধ পথে ভারতে পাচার করছে, যেখানে চিংড়ি চাষের জন্য এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, টাকার লোভ দেখিয়ে এই কাজে জড়ানো হচ্ছে প্রান্তিক জেলেদের। যাদের অধিকাংশই নারী। এভাবে কয়েক শ মণ শামুক একদিনেই সংগ্রহ করা হচ্ছে সুন্দরবন থেকে। আর সে শামুক সড়কপথে ও নদীপথে পাচার করা হচ্ছে। স্থানীয় জেলেরা অসাধু ওই চক্রের কাছে সেগুলো বর্তমানে ৩০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘শামুক হচ্ছে জলাশয়ের স্বাভাবিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী। এটি নদী-খালের তলদেশে থাকা ক্ষতিকর পদার্থ শোষণ করে পানির গুণগত মান ঠিক রাখে। কিন্তু নির্বিচারে শামুক নিধন করলে শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্যই নষ্ট হবে না, বরং জলজ প্রাণীদের খাদ্যচক্রেও বিরূপ প্রভাব পড়বে।’
স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, এই চক্রটি শুধু শামুকই নয়, চিংড়ি আহরণের সময় বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করছে। মাছের ঝাঁক সহজে ধরতে নদী-খালের পানিতে মেশানো হচ্ছে কীটনাশক জাতীয় রাসায়নিক। এতে কয়েক মিনিটের মধ্যে ছোট মাছ, চিংড়ির রেণু, কাঁকড়া, কই, টেংরা থেকে শুরু করে অন্যান্য জলজপ্রাণী অচেতন হয়ে ভেসে উঠে। জেলেরা তখন জাল দিয়ে সহজেই সেগুলো ধরে ফেলেন। কিন্তু এর ফলে নদীর বাস্তুসংস্থান ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পরিবেশবিদদের মতে, এসব রাসায়নিক পদার্থ শুধু মাছ বা রেণুকেই মারে না, পানির ভেতর থাকা অণুজীব, শৈবাল ও জমা পলিকেও ধ্বংস করে দেয়। এতে ধীরে ধীরে নদীর তলদেশ শক্ত ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে, জৈব উৎপাদনশীলতা কমে যায়। এভাবে এক সময় সেই নদী আর জীববৈচিত্র্য ধারণের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়বে সুন্দরবনের পানির নিচের প্রাণীদের খাদ্যচক্র ও বন্যপ্রাণীর উপরও।
সুন্দরবন সংলগ্ন হরিনগরের মথুরাপুর গ্রামের বিজয় রপ্তান, বুড়িগোয়ালিনীর দাঁতিনাখালী এলাকার ফজলু গাজি ও রমজান নগরের ভেটখালী এলাকার কানাই মণ্ডলসহ সুন্দরবন লাগোয়া এলাকার একাধিক জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টাকার লোভ দেখিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা কিছু জেলেকে কাজে লাগাচ্ছেন। যার মধ্যে অধিকাংশই নারী। প্রতিদিন নদী-খাল থেকে শামুক কুড়িয়ে ট্রাকে ভরে পাচার করছে। অথচ আমরা নদী রক্ষায় তিন মাস মাছ শিকার বন্ধ রাখি, কিন্তু শামুক নিধনের কারণে আমাদের সব পরিশ্রম ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, ‘শামুক শুধু জলাশয়ের পানির গুণগত মান বজায় রাখে না, বরং মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর খাদ্য হিসেবেও অপরিহার্য। নির্বিচারে শামুক নিধনের ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এবং জেলেদের জীবিকা উভয়ই হুমকির মুখে পড়ছে।’
শ্যামনগর সরকারি মহাসিন ডিগ্রি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক ড. প্রতাপ কুমার রায় বলেন, ‘শামুক তলদেশের জৈব পদার্থ খেয়ে পানিকে পরিশুদ্ধ রাখে। একইসঙ্গে মাছ, কাঁকড়া ও অনেক জলজ প্রাণীর জন্য এটি প্রধান খাদ্য। কিন্তু নির্বিচারে শামুক নিধন করলে খাদ্যচক্র ভেঙে যাবে, ফলে নদী-খাল উজাড় হয়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নদীর পানিতে বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার করে মাছ ধরার প্রবণতা যেভাবে বাড়ছে - তাতে ছোট মাছ, চিংড়ির রেণু, কাঁকড়া এবং শামুক একসঙ্গে ধ্বংস হচ্ছে। এটি শুধু জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ুতেও প্রভাব ফেলবে। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হলে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি বাড়বে, জলজ উদ্ভিদ ধ্বংস হলে কার্বন শোষণের ক্ষমতাও কমে যাবে। তাই এখনই শামুক নিধনের কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে সুন্দরবন ও উপকূলীয় এলাকার পরিবেশ ভয়াবহ সংকটে পড়বে।’
স্থানীয় বেসরকারি গবেষণা ও পরিবেশবাদী সংগঠনের সহযোগী আঞ্চলিক সমন্বয়কারী রামকৃষ্ণ জোয়ারদার বলেন, ‘সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় শামুক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি পানির দূষণ কমাতে সহায়তা করে এবং মাছ ও কাঁকড়ার জন্য প্রধান খাদ্য। শামুক নিধন চলতে থাকলে শুধু পরিবেশ নয়, স্থানীয় অর্থনীতিও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। তাই এখনই এ অপতৎপরতা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
এ বিষয়ে পশ্চিম সুন্দরবনের রেঞ্জ কর্মকর্তা (সাতক্ষীরা রেঞ্জ) ফজলুল হক বলেন, ‘শামুক নিধন ও পাচার নজরে রয়েছে এবং বন বিভাগের নিয়মিত অভিযান চলছে। মাঝে মাঝে বিপুল শামুক উদ্ধার করে নদীতে অবমুক্ত করা হচ্ছে, পাশাপাশি টহল জোরদার করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘শুধু শামুক নয়, বিভিন্ন অসাধু চক্র মাছ, কাঁকড়া ও অন্যান্য জলজ সম্পদও অবৈধভাবে আহরণ করছে। এসব প্রতিরোধে টহল দল প্রতিদিন নদী খালে নজরদারি করছে। মামলা করা হয়েছে এবং স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে।’
এই বন কর্মকর্তা আরও জানান, সুন্দরবন রক্ষায় জনগণ, বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সমন্বয় অপরিহার্য। তা না হলে অবৈধ কর্মকাণ্ড জীববৈচিত্র্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
পরিবেশ ও জলবায়ুকর্মী এসএম শাহিন বিল্লাহ জানান, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় শামুক নিধন ও পাচার বন্ধ করতে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে বন ও পরিবেশ আইনে দ্রুত মামলা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নদী-খাল ও বন সংলগ্ন এলাকায় স্মার্ট টহল জোরদার, প্রকৃত ব্যবসায়ী ও অর্থদাতাদের শনাক্ত, স্থানীয় জেলেদের সচেতন করা, দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শামুক নিধনে পরিবেশ ও জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে গবেষণা ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং কিছু অংশ ‘শামুক সংরক্ষণ এলাকা’ ঘোষণা করে সম্পূর্ণ নিধন নিষিদ্ধ করা।সুন্দরবনের সংলগ্ন নদী-খাল থেকে নিদারুণভাবে শামুক ও ঝিনুক সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, কিছু ক্ষেত্রে সীমান্তপথে পাচার হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের মতে, দিনে কিংবা গভীর রাতে ট্রলার ও নৌকা ব্যবহার করে নির্বিচারে এ আহরণ চলছে, যা বনভূমি ও নদীর তলদেশীয় পরিবেশের ভারসাম্য বিপন্ন করছে।
অবৈধ আহরণকারীদের অর্থের লোভে পরে প্রান্তিক জেলেদেরও এ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় সূত্রে বলা হয়, কয়েকশো মণ শামুক একদিনে সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং তা সামগ্রিকভাবে সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি সীমান্তপথে পাচার করা হচ্ছে। কিছু ব্যবসায়ী এসব শামুক ১৫ টাকা দরে কিনে ৮০ টাকা দরে বিক্রি করছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
পরিবেশবিদ ও গবেষকরা জানান, শামুক-ঝিনুক নদীর তলদেশের মাটির গুণগত মান বজায় রাখতে, মাটির উর্বরতা রক্ষায় এবং নদীতে বাস করা মাছের খাদ্য চক্র বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অধ্যাপক আশেক এলাহী ও গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দীর মত অনুযায়ী, ব্যাপক হারে এ প্রাণীর নিধন হলে নদী জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ভয় রয়েছে। সুন্দরবনে আনুমানিক ২৬০ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে- তাদের মধ্যে শামুক ও ঝিনুকের গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য।
আইনি দিক থেকেও সমস্যা গুরুতর। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে শামুক ও ঝিনুক কুড়িয়ে নেওয়া বা পরিবহন করা নিষিদ্ধ। এ ধরনের কার্যক্রম পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) ও জলজ সম্পদ সংরক্ষণ আইন, ১৯৫০-এর আওতায় অপরাধ হিসেবে দণ্ডনীয়।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, সাতক্ষীরার রেঞ্জ—পশ্চিম সুন্দরবনের পশুরতলা খাল, কৈখালীর মাদার নদী ও জয়াখালীর খালসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অবৈধভাবে শামুক আহরণ হয়ে থাকে। আগাস্ট মাসের শুরুতে বন বিভাগের এক অভিযানে পার্ক সংলগ্ন মালঞ্চ নদী থেকে শামুক ও ঝিনুক ভর্তি নৌকা জব্দ করে মুন্সিগঞ্জ ফরেস্ট টহল ফাঁড়ির সদস্য ও নৌপুলিশ। পরে কদমতলা স্টেশন থেকে উদ্ধার করা দশ বস্তা শামুক-ঝিনুক নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
শ্যামনগর উপজেলার পরিবেশকর্মী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু নৌকা জব্দ করলেই হবে না; চক্রের মূলহোতাদের সনাক্ত করে তাদের উৎসকে নির্ণয় করতে হবে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরী।’ এ বিষয়ে পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাসানুর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে; শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ ও পাচার নদী সংরক্ষণ আইন ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন—অভিযুক্তদের শনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং স্থানীয়দের সহযোগিতা কামনা করা হচ্ছে।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত