
সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। আমরা প্রশ্ন রাখতে চাই, অগ্নিঝুঁকি নিরসনে অতীতে এতবার সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি কেন? অভিজ্ঞতা বলে, আবারও তদন্ত হবে, সুপারিশ উপস্থাপন করা হবে এবং এক পর্যায়ে সবই চলে যাবে হিমঘরে! আমরা জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাবে ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ।
এই রূঢ় বাস্তবতায় সুন্দরবনের মতো অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। প্রাণপ্রকৃতির ওপর অভিঘাত সৃষ্টি করে অদূরদর্শী কর্মকা- বন্ধে দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থে সুন্দরবন ঘিরে সরকারের গভীর মনোযোগ আবশ্যক। সুন্দরবনের ঝুঁকি নিরসনের সর্বাত্মক চেষ্টা কালবিলম্ব না করে জোরদার করা জরুরি।
সুন্দরবন যত ঝুঁকির মুখে পড়বে, আমাদের বহুমাত্রিক সংকট ততই প্রকট হবে । এই বন যেহেতু বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, সেহেতু এর সুরক্ষাদানে ব্যর্থতায় আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে
বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। জলজ, প্রাণিজ ও বনজ সম্পদের প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ সুন্দরবন। এটি বিশ্বের অন্যতম লবণাক্ত বনাঞ্চল (ম্যানগ্রোভ বন)। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা সুন্দরবনকে বৈচিত্র্যময় করেছে উজানের জলপ্রবাহ, লবণাক্ত সামুদ্রিক স্রোতধারা ও কাদার চর। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি সেসব প্রাকৃতিক সম্পদ অবদান রাখে দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে।
সুন্দরবন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এ বনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ৩৫ লাখ মানুষ নির্ভরশীল। সরকার প্রতিবছর এ বন থেকে মোট বনজ রাজস্বের ৪১ শতাংশ আহরণ করে এবং উপকূলীয় এলাকার মানুষের জ্বালানি কাঠ সরবরাহ করে। সুন্দরবন গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় বদ্বীপ অঞ্চল
আমরা প্রশ্ন রাখতে চাই, অগ্নিঝুঁকি নিরসনে অতীতে এতবার সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি কেন? অভিজ্ঞতা বলে, আবারও তদন্ত হবে, সুপারিশ উপস্থাপন করা হবে এবং এক পর্যায়ে সবই চলে যাবে হিমঘরে! আমরা জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাবে ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ।
এই রূঢ় বাস্তবতায় সুন্দরবনের মতো অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। প্রাণপ্রকৃতির ওপর অভিঘাত সৃষ্টি করে অদূরদর্শী কর্মকা- বন্ধে দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থে সুন্দরবন ঘিরে সরকারের গভীর মনোযোগ আবশ্যক। সুন্দরবনের ঝুঁকি নিরসনের সর্বাত্মক চেষ্টা কালবিলম্ব না করে জোরদার করা জরুরি।
সুন্দরবন যত ঝুঁকির মুখে পড়বে, আমাদের বহুমাত্রিক সংকট ততই প্রকট হবে । এই বন যেহেতু বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, সেহেতু এর সুরক্ষাদানে ব্যর্থতায় আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে
বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। জলজ, প্রাণিজ ও বনজ সম্পদের প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ সুন্দরবন। এটি বিশ্বের অন্যতম লবণাক্ত বনাঞ্চল (ম্যানগ্রোভ বন)। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা সুন্দরবনকে বৈচিত্র্যময় করেছে উজানের জলপ্রবাহ, লবণাক্ত সামুদ্রিক স্রোতধারা ও কাদার চর। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি সেসব প্রাকৃতিক সম্পদ অবদান রাখে দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে।
‘সুন্দরবন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এ বনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ৩৫ লাখ মানুষ নির্ভরশীল। সরকার প্রতিবছর এ বন থেকে মোট বনজ রাজস্বের ৪১ শতাংশ আহরণ করে এবং উপকূলীয় এলাকার মানুষের জ্বালানি কাঠ সরবরাহ করে। সুন্দরবন গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় বদ্বীপ অঞ্চলে
ফলে, বদ্বীপ অঞ্চলের গঠন প্রক্রিয়া প্রভাব বিস্তার করে সুন্দরবনের ওপর। দিনে দুবার জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত হয় এ বনের নদী-খালগুলো। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে জোয়ারের চেয়ে চলমান সময়ে ভাটার স্থায়িত্ব দীর্ঘ সময় থাকে। এছাড়াও পলি জমে জায়গা ভরাট হওয়ায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। ফলে, পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। অবশ্য নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়া এবং শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে ভারতের ফারাক্কা বাঁধসহ নদীর আন্তঃসংযোগমূলক প্রকল্পগুলোর দায়কে অস্বীকার করা যায় না।
এ নাব্য সংকট আগামীতে আগুনের ঘটনা বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এ বনের চারপাশে মানুষের বসতি। ফলে, বন উজাড়ের নজিরও কম নয়। নগরায়ণ, বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, বনসম্পদের (কাঠ, কাঁকড়া, ঝিনুক ইত্যাদি) অতি আহরণ বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছে সুন্দরবনকে। এছাড়া নৌপরিবহন ব্যবস্থার ত্রুটি এ সংকট আরও গভীর করেছে।
সুন্দরবনের পাশে বয়ে চলা নদীতে জাহাজ ডুবে তেল, ফার্নেস ওয়েল, ফ্লাই অ্যাশ, কয়লা, সারসহ রাসায়নিক দ্রব্যে নদীর পানি দূষিত করে এবং বনের জলজ প্রাণীদের জীবন বিপন্ন করে তোলে। এছাড়াও পলি জমে নদীর অববাহিকা ভরাট হওয়ায়, সেখানে মানুষের দখলদারিত্বের মাধ্যমে বসতিসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে।
সুন্দরবনে আগুনএকটি বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের ফুসফুসখ্যাত ওয়াার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবনে গত ২৩ বছরে ২৪ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জের মধ্যে কেবল শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে আগুন লাগে– না লাগানো হয়– তা নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বনে আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে প্রতিবার করা হয় তদন্ত কমিটি। তবে বনের সুরক্ষায় তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো থেকে যায় ফাইলবন্দি
বর্ষা মৌসুমে মাছ শিকারের সুবিধার্থে অসাধু জেলেরা পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে বনের বিভিন্ন স্থান ফাঁকা করে ফেলে। পরবর্তী সময় তারা ওই স্থানে জাল পেতে মাছ ধরে। বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট হলেও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। শুধু আগুনেই পুড়ছে না সুন্দরবন। বন্যপ্রাণী ও মৎস্য সম্পদ প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলছে একশ্রেণির অসাধু চক্র।
প্রতিবার আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান, ক্ষতি নিরূপণ ও ভবিষ্যতে অগ্নিকা-ের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়। তবে সেসব তদন্তের প্রতিবেদন ও দুর্ঘটনা এড়াতে করা সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হতে দেখা যায় না।
অগ্নিকা- এড়াতে বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে জোরালোভাবে তিনটি সুপারিশ করা হয়। তিনটি সুপারিশ হলো সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া নদী-খাল খনন, অগ্নিকা-প্রবণ এলাকার প্রতি দুই কিলোমিটার পর পর ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে নজরদারির ব্যবস্থা এবং ভোলা নদীর পাশ দিয়ে কাঁটাতার অথবা নাইলনের রশি দিয়ে বেড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
এ বিষয়ে সেফ দ্য ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বলেন, সুন্দরবনকে আগুন থেকে রক্ষার জন্য লোকালয়সংলগ্ন নদী-খাল খনন ও কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রোধে বনরক্ষীদের তৎপরতা বৃদ্ধি করা ও অসাধু বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক বলেন, এ আগুন লাগার দায়ভার কোনোভাবেই বন বিভাগ এড়াতে পারে না। আগুন লাগার জন্য দায়ী অসাধু মাছ ব্যবসায়ী ও বন কর্মকর্তারা। অদক্ষ মৌয়ালদের কারণেও আগুন লাগে।
৫ মে সুন্দরবনে পরিকল্পিত অগ্নিকা- বন্ধের দাবিতে আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির সামনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সুন্দরবন রক্ষায় আমরা ও পশুর রিভার ওয়াটারকিপারের আয়োজনে মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, মানবসৃষ্ট সুন্দরবনের পরিকল্পিত অগ্নিকা- বন্ধে বন বিভাগসহ সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।
সুন্দরবন সংরক্ষিত বনাঞ্চল হলেও আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ি অঞ্চলে চোরা শিকারিসহ মানুষের অবাধ যাতায়াত রয়েছে। পরিবেশকর্মী, সংবাদকর্মী, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা এবং অতীতে সংঘটিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করার কারণেই সুন্দরবনের আমুরবুনিয়া এলাকায় চার বছর পরে আবারও অগ্নিকা- সংঘটিত হলো বলে অভিযোগ করেন বক্তারা।
বক্তারা বলেন, আমুরবুনিয়া এলাকায় দুই দিন আগে থেকে আগুন জ্বললেও বন বিভাগের উদাসীনতায় আগুন নেভানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আগুনে প্রায় চার একর বনভূমি পুড়ে গেছে। বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন রক্ষায় বন বিভাগ, স্থানীয় জনগণ, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক হতে হবে। সুন্দরবনের মধ্যে মুনাফালোভী ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে।
তবে নীতিনির্ধারণী মহলের কাছে সুন্দরবন আজও গুরুত্বহীন। কেবল বন বিভাগের কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত কমিটি করলে সুন্দরবনের আমুরবুনিয়ার অগ্নিকাণ্ডের মূল রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে না। তাই এশিয়ার ফুসফুস সুন্দরবনের মানবসৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন এবং এ ধরনের জঘন্য কর্মকাণ্ড বন্ধে বন বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, পরিবেশকর্মী, সুন্দরবন গবেষক ও বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিকসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠন করতে হবে তদন্ত কমিটি।
সুন্দরবনকে রক্ষা করতে করণীয়
বনকে বাঁচাতে হলে তদন্ত কমিটির সুপারিশ মেনে নদী-খাল খননের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি নদী-খালকে দূষণ ও দখলমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বনের ভেতরে মানুষ কিংবা বনজীবীদের অবাধ যাতায়াত, চোরা শিকারি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ওয়াচ টাওয়ারের সংখ্যা বাড়িয়ে বনের ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ রাখতে হবে।
বনজীবী ও মৌয়ালদের এ বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক করতে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কেননা, তদন্ত প্রতিবেদনে প্রায় উঠে এসেছে তাদের অসচেতনতার দরুন ঘটা অগ্নিকা-ের ঘটনা। যদিও এ বক্তব্যে দ্বিমত রয়েছে বনজীবীদের। তাদের যুক্তি, সুন্দরবনই তাদের জীবিকার সংকুলান করে থাকে। তাই অসতর্ক ও অবহেলায় তাদের ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। তাদের যুক্তিও খুব একটা অগ্রাহ্য করা যায় না। বিশেজ্ঞরাও মনে করেন, সুন্দরবনে অগ্নিকা-ের মূলে এর বাইরে অন্য রহস্যও রয়েছে, যা হয়তো উদ্ঘাটন করা সহজ নয়।
তদন্ত কমিটি করা হয় বন বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে। ফলে, তাদের তদন্ত কতটা নিরপেক্ষ তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়। সংশ্লিষ্টদের মতে, আগুন লাগার ঘটনার সঙ্গে বন বিভাগের লোকজন, বিশেষ করে টহল ফাঁড়ি বা স্টেশন পর্যায়ের কর্মকর্তারা অনেক সময় যুক্ত থাকেন। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাদের আঁতাত থাকে।
সুন্দরবনের নদী অববাহিকায় যেসব জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে সুন্দরবন রক্ষায় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। সেসব জনগোষ্ঠীকে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে বনের ভেতরে মানুষের আনাগোনা কমবে। বনজ সম্পদ আহরণের চাপ কমবে। এতে বন উজাড়ও রোধ করা সম্ভব হবে।
অসৎ ব্যবসায়ীদের রুখতে এসব পদক্ষেপ সহায়ক হতে পারে। সার কথা, সুন্দরবনকে বাঁচাতে ও সমৃদ্ধ রাখতে বন বিভাগকে যাবতীয় সুপারিশ বাস্তবায়নে জরুরী পদক্ষেপ নিতে হবে। সুন্দরবনে অগ্নিকা- যেন প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৪ মে সর্বশেষ সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে চাঁদপাই রেঞ্জে জিওধারা স্টেশনে আমুরবুনিয়া টহলফাঁড়ি এলাকায় আগুন লাগে।
প্রায় ৫৫ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও যে ক্ষত সুন্দরবনে সৃষ্টি হয়েছে, এর দায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের এড়ানোর অবকাশ নেই। সর্বশেষ অগ্নিকা-ে চার একরের বেশি বনভূমি পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রাণবৈচিত্র্যে যে অভিঘাত লেগেছে, তা নিঃসন্দেহে বড় সংকট সৃষ্টি করেছে।
সিডর ও আইলা-উত্তর গবেষণায় জানা যায়, সুন্দরবন না থাকলে ওই দুই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত দেশের আরও বড় অংশজুড়ে বিস্তৃত হতে পরত। দুটি ঘূর্ণিঝড়ই সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি করেছিল বটে। কিন্তু এই বনের কারণে জনপদে অনেক জীবন রক্ষা পেয়েছিল। এভাবেই বারবার নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে প্রকৃতি ও জীবনকে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক বিস্ময় সুন্দরবন।
সর্বশেষ অগ্নিকা- নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড ও পুলিশ সদস্যদের অক্লান্ত প্রয়াসের জন্য আমরা তাদের সাধুবাদ জানাই। প্রশ্ন উঠেছে, কেন বারবার সুন্দরবন অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে? পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তরফে যে বক্তব্য মিলেছে, তা বরাবরের মতোই গৎবাঁধা।
দূর অতীত বাদ দিলেও ২৩ বছরে সুন্দরবনে ২৪ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রশ্ন দাঁড় করায়, এত দুর্যোগের পরও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের চেতনা ফিরছে না কেন? গত ৫৪ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবন ৪০ বার অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, কোনো সুপারিশই বাস্তবায়িত হয়নি।
জাতীয় জীবনে আনুষ্ঠানিক শপথ নেওয়া এবং তা থেকে বিচ্যুত হওয়ার অনেক নজির রয়েছে। কিন্তু শ্যামনগরের হাজার হাজার স্বতঃপ্রণোদিত মানুষের ‘বনবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করব, সুন্দরবন নিরাপদ রাখব’ -এই উচ্চারণের প্রতিপালনে তারা যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। গবেষণায় এও উঠে এসেছে, প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবন সুরক্ষা শুধু কয়েক হাজার মানুষের জীবন-জীবিকার বিষয় নয়, সুন্দরবন গোটা বাংলাদেশ, উপমহাদেশ তথা বিশ্বের পরিবেশের সুরক্ষার জন্য দৃষ্টান্তযোগ্য রক্ষাকবচ।
আমরা প্রশ্ন রাখতে চাই, অগ্নিঝুঁকি নিরসনে অতীতে এতবার সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি কেন? অভিজ্ঞতা বলে, আবারও তদন্ত হবে, সুপারিশ উপস্থাপন করা হবে এবং এক পর্যায়ে সবই চলে যাবে হিমঘরে! আমরা জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাবে ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। এই রূঢ় বাস্তবতায় সুন্দরবনের মতো অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই।
প্রাণপ্রকৃতির ওপর অভিঘাত সৃষ্টি করে অদূরদর্শী কর্মকা- বন্ধে দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থে সুন্দরবন ঘিরে সরকারের গভীর মনোযোগ আবশ্যক। সুন্দরবনের ঝুঁকি নিরসনের সর্বাত্মক চেষ্টা কালবিলম্ব না করে জোরদার করা জরুরি। সুন্দরবন যত ঝুঁকির মুখে পড়বে, আমাদের বহুমাত্রিক সংকট ততই প্রকট হবে । এই বন যেহেতু বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, সেহেতু এর সুরক্ষাদানে ব্যর্থতায় আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে।