খুলনার ক্যাম্পাসের বাইরে ছিলনা স্বাস্থ্যবিধি
অভিভাবকদের জটলায় ঝুঁকিতে শিক্ষার্থীরা
জন্মভূমি রিপোর্ট
নগরীর ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী স্বর্নালী। যাকে সকাল ৯টায়ও অনলাইন ক্লাসের জন্য ঘুম থেকে উঠানো যেতো না, গত দেড় বছরের পুরোনো অভ্যাস ত্যাগ করে সে নিজ থেকেই উঠে নিজের ব্যাগ গুছাচ্ছে। আগের থেকেই পোশাক পরে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। নির্দেশনা অনুযায়ী স্কুলে ক্লাস শুরু হবে ১০ টায়।
দীর্ঘ ৫শ’ ৫৪ দিন পরে পরে দেখা হবে প্রিয় বান্ধবীদের সাথে, দেখতে পাবে প্রিয় ক্যাম্পাস। এই উত্তেজনায় সারারাত ঠিক মত ঘুমায়নি সে। মোবাইলে এলার্ম সেট করে ঘুমিয়েছিলো ছোট এই শিক্ষার্থী, কিন্তু সেটার প্রয়োজন পড়েনি। সে নিজ থেকে উঠে প্রস্তুত হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেবে এমন খবরে উচ্ছ্বসিত আর আন্দোলিত হয়ে পড়ে সে। দিন গুনছিল কবে আসবে সেই কাঙ্খিত মূহূর্ত। কখন সে অনলাইন থেকে বেড়িয়ে শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করবে।
দীর্ঘ অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়ে রোববার (১২ সেপ্টম্বর) সেই কাঙ্খিত মুহূর্তে তিনি।
নগরীর অধিকাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস প্রাঙ্গনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেও বাইরের অবস্থা ছিল ভিন্ন। সবাই মিলে মিশে একাকার। কোথাও স্বাস্থ্যবিধির ছিল না বালাই।
প্রায় ২ ঘণ্টা খুলনা সেন্ট জোসেফ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের গেটে ছিল প্রচ- ভিড়। বিদ্যালয়ে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময়ে ছিলনা কোনো শৃংখলা। গোটা আহসান আহমেদ সড়কটি যানজটে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। কোনো ট্রাফিক পুলিশ বা আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি ছিল না। এমনকি কোনো মনিটরিং দলের তৎপরতা দেখা যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেন্ট জোসেফ উচ্চ বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের নেওয়া স্কুলের ভিতরে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি ছিল সন্তোষজনক। বাদ্যের তালে তালে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। প্রবেশের পর তাকে শ্রেণিকক্ষে নেওয়া এবং ক্লাস শেষ পর্যন্ত তদারকি ছিল প্রশসনীয়। এ সময় শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কক্ষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, একটি ক্লাস শেষ হওয়ার পর পরবর্তী শিক্ষক ক্লাসে প্রবেশ না করা পর্যন্ত আগের শিক্ষক ক্লাসে অবস্থান করে শিক্ষার্থীদের শান্ত রাখেন। কিন্তু বাইরের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্কুলের প্রধান ফটকের সামনে অভিভাকদের জটলা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। প্রধান ফটক সম্পূর্ণ খোলা না থাকায় ছোট গেট দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ এবং বের হতে যেয়ে চিড়ে-চেপ্টা অবস্থায় পড়তে হয়। অনেক শিক্ষার্থী হাফিয়ে ওঠে। এসময় স্কুলের সামনে জট বেধে যায় মানু আর ক্ষুদ্র পরিবহনের। যা সকল অর্জন যেন ম্লান হওয়ার অবস্থা। শুধুমাত্র কিছু অভিভাবকের অনেক অর্জন ব্যর্থ হতে পারে।
স্কুল খোলার বিষয় নিয়ে একজন শিক্ষার্থীর মা সাহারা বেগম জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ায় আমরা যেমন খুশি হলেও মনের মধ্যে আছে সংশয়। কারণ কোথাও স্বাস্থ্য বিধির বালাই নেই। এসময় তিনি বাচ্চাদের টিকার ব্যবস্থাও খুব দ্রুত করার আহবান জানান।
নগরীর করনেশন স্কুলের বাইরে অবস্থানরত অভিভাবকরা জানায়, একদিকে বাচ্চাদের আনন্দ দেখে যেমন আনন্দিত আমরা ঠিক অন্যদিকে মনের মধ্যে একটা ভয়ও কাজ করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি উপেক্ষিত হতে পারে।
করোনেশন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোছা মাকামি মাকছুদা জানান, শিক্ষার্থীরা প্রায় ১৭ মাস পর শ্রেণিকক্ষে ফিরেছে এতে আমরা ভীষণ আনন্দিত। দীর্ঘদিন বাড়িতে আটকে থাকার পর, আজ তারা তাদের বন্ধুদের এবং শিক্ষকদের সাথে আনন্দে শ্বাস নিতে পারছে। শিক্ষার্থীদের হাসিখুশি, উদ্যমী এবং উৎসাহী দেখা গেছে।
আজকে প্রথম ক্লাস তাই তাদেরকে চকলেট ও ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়া হয়েছে।
তবে সুবিধাবঞ্চিত বস্তিবাসির কর্মজিবী শিক্ষার্থীদের ভিন্ন ভাবে বরন করে নিয়ে সামাজিক সংগঠন স্বপ্নপূরী। লায়ন্স ক্লাবের সহযোগিতায় সংগঠনটি ছাতা ও শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ করে। এসময় গানে ও কবিতায় মেতে ওঠে স্বপ্নপূরীর কর্মজিবী শিশুরা।
রোববার সকাল সাড়ে ৯টা। খুলনার রূপসা উপজেলার বাগমারা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ঢুং ঢাং শব্দে বেজে উঠলো প্রত্যাশিত ঘণ্টা। আর এর মধ্যদিয়েই দীর্ঘ ১৭ মাস পর শুরু হলো স্কুলের ক্লাস। স্কুলে প্রবেশ করেই আনন্দ-উচ্ছ্বাসে আত্মহারা হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। এ স্কুলের মত খুলনা মহানগর ও জেলার দেড় হাজারেরও বেশি স্কুল মুখরিত হয়ে ওঠে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পদচারণায়।
এদিকে, গেট থেকেই তাপমাত্রা মেপে এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার মাখিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে প্রবেশ করানো হয়। এছাড়া মাস্ক পড়া ছিল বাধ্যতামূলক। তবে, কেউ মাস্ক না আনলে স্কুলের পক্ষ থেকে তাদের মাস্ক দেয়া হয়। এছাড়া শিক্ষার্থীদের রজনীগন্ধা ফুলের স্টিক এবং চকলেট দিয়ে বরণ করা হয়।
নগরীর সেন্ট জোসেফস উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫ শ্রেণির শিক্ষার্থী বিজয় রায় বলেন, স্কুল ১০টায় শুরু হলেও অনেক দিন পর স্কুল খোলায় ৭টার সময় চলে এসেছি। স্কুল খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। দেখে ভীষণ ভালো লাগছে।
সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ৪ শ্রেণির ছাত্রী রাজিয়া সুলতানার মা বলেন, এতো দিন বন্দি জীবনে ছিল আমার মেয়ের। এতে সে অনেক মানসিক চাপে থাকতো। এখন ক্লাসে এসে সহপাঠীদের সাথে দেখা হওয়ায় স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে। এতে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারছি আমরা।
সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা মোসাম্মাদ মাকামী মাকছুদা বলেন, গেট থেকেই তাপমাত্রা মেপে এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার মাখিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে প্রবেশ করানো হয়েছে। এছাড়া মাস্ক পড়া ছিল বাধ্যতামূলক। তবে, কেউ মাস্ক না আনলে স্কুলের পক্ষ থেকে তাদের মাস্ক দেয়া হয়। এছাড়া শিক্ষার্থীদের রজনীগন্ধা ফুলের স্টিক এবং চকলেট দিয়ে বরণ করা হয়।
হাজী শরীয়াত উল্লাহ বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক শেখ জাহিদুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করানো হয়েছে। প্রথম দিনেই ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়েছেন। দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর স্কুল খোলায় শিক্ষার্থীদের সাথে সাথে আমরাও অনেক আনন্দিত।
খুলনা সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক বিকাশ রায় বলেন, সংক্রামক ব্যধির আগ্রাসন সে সম্পর্ক ভেঙে গৃহবন্দী করেছিল শিক্ষার্থীরা। আজ সে বন্দীদশা ছেড়ে আবার শিক্ষায়তনে ফিরেছে শিক্ষার্থীরা। এটা আসলে কতটা আনন্দের তা ভাষায় ব্যক্ত করে বোঝানো যাবে না।
সরকাররি ইকবাল নগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুহাম্মাদ ফারুকুল ইসলাম বলেন, সরকারি নিয়মনীতি ও স্বাস্থ্য বিধি মেনে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে শিক্ষার্থীরা শ্রেণি কক্ষে প্রবেশ করে। একটি বেঞ্চে ২জন করে শিক্ষার্থী বসছে।
খুলনা জেলা শিক্ষা অফিসার খন্দকার রুহুল আমীন বলেন, শিক্ষামন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে খুলনা জেলার সকল সরকারি বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা আজ খুলেছে। এর মধ্যে ৪২০টি স্কুল, ১২৫টি মাদরাসা ও ৭৩ টি কলেজ রয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সূত্রে জানা যায়, খুলনা জেলায় ১ হাজার ১৫৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৪২০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে মহানগরে ১৫৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১শ’ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বাকিগুলো জেলার ৯টি উপজেলায় অবস্থিত।