বিশেষ প্রতিনিধি : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন জমজমাট হয়ে উঠেছে। রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দাপটে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূূর্ণ হয়ে উঠেছে। পঞ্চাশ ভাগের বেশি আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। জাতীয় পার্টিসহ ছাড় দেওয়া অন্য আসনগুলোতেও লড়াই করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। দল ছাড়া নির্বাচনী লড়াইয়ে নামা ৩৮৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্তেই সারাদেশে তৈরি হয়েছে উৎসবমুখর ভোটের পরিবেশ।
এর আগে দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার অনুমতি দেওয়ার ইতিহাস খুব একটা নেই। অনেক নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সাধারণত শৃঙ্খলা ভঙের অভিযোগে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এবারই ব্যতিক্রম। আওয়ামী লীগ নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সমালোচনা হচ্ছে ব্যাপক। দলের অনেক নেতা মনে করেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে দলের চেইন অব কমান্ড নষ্ট হচ্ছে। সারাদেশে কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছেন নেতাকর্মীরা। ভবিষ্যতে দলের জন্য এটি ক্ষতিকর হতে পারে। অনেক স্থানে সংঘাতের ঘটনাও ঘটতে শুরু করেছে।
আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকরা বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষপটে এই সিদ্ধান্তের কোনো বিকল্প ছিল না। বিশেষ করে এবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছিল জরুরি। বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের সমমনা দলগুলো নির্বাচন বর্জন করায় একধরনের সংকট তৈরি হয়েছিল। প্রধান প্রতিপক্ষের বর্জনে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন হয়ে পড়ত। শেষ পর্যন্ত ২৬টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত হয়েছে। এখন বড় চ্যালেঞ্জ ভোটার উপস্থিতি। দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ না দিলে নির্বাচন হয়ে যেত একপেশে। নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ থাকত না। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে এই শঙ্কা কেটে গেছে। সারাদেশে নির্বাচন হয়ে উঠেছে জমজমাট। গোটা দেশ এখন নির্বাচনমুখী।
এরমধ্যও যেসব আসনে শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই সেইসব এলাকায় নির্বাচন জমে ওঠেনি। প্রার্থীরা ভোট প্রার্থনার চেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন ভোটারদের কেন্দ্রে নেওয়ার।
এবারের নির্বাচনে সবমিলিয়ে ১৮৯৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। একক রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সবচেয়ে বেশি। নির্বাচনে দলটি প্রার্থী দিয়েছে ২৬৫ আসনে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সংখ্যা ২৬৪। অবশ্য উচ্চ আদালতে রিট করা নৌকা হারানো প্রার্থীরা প্রার্থিতা ফিরে পেলে আওয়ামী লীগ সংখ্যায় এগিয়ে যাবে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশের ৩৯ জন, ইসলামী ঐক্যজোটের ৪২ জন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের ২৯ জন, গণফোরামের ৯ জন, গণফ্রন্টের ২১ জন, জাতীয় পার্টির (জাপা) ২৬৫ জন, জাতীয় পার্টি-জেপির ১৩ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের ৬৪ জন, তৃণমূল বিএনপির ১৩৩ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২ জন, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের ১০ জন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের ৩৭ জন, বাংলাদেশ কংগ্রেসের ৯৫ জন, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির ১৬ জন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের ১১ জন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির ৫ জন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ৫৪ জন, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের ৩৮ জন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) ৫ জন, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফের ৪৫ জন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের ৪ জন, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির ৭৯ জন, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের ৬৩ জন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ২৬ জন এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের (এম এল) ৪ জন প্রার্থী আছেন।
ইসির তথ্য অনুযায়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী সংখ্যা ৩৮৩ জন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশ কিছু আসনে বিপাকে পড়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপিবিহীন নির্বাচনে বেশিরভাগ আসনেই দলীয় প্রার্থীর বাইরে দলের আরও এক বা একাধিক নেতা নেমেছেন ভোটের লড়াইয়ে। নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচার শুরু হলে গত কয়েক দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের মধ্যেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় হতাহত হয়েছে শতাধিক। ২৬৪ আসনের মধ্যে ১২৮টিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে রয়েছে শক্তিশালী একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী। এইসব আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অনেক আসনে বড় বড় নেতা, সাবেক মন্ত্রী এবং কয়েক বার নির্বাচিত সংসদ সদস্যও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।
এবার কোনো বড় নেতার প্রতিই বিশেষ কোনো নজর দেওয়া হচ্ছে না। দলের সর্বোচ্চ ফোরাম থেকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, যিনি যেমন কর্ম করেছেন তিনি তেমন ফল পাবেন। পনেরো বছর সংসদ সদস্য, দীর্ঘ সময় মন্ত্রী কিংবা দলের শীর্ষ পর্যায়ের পদে থেকেও যারা ভোটারদের মন জয় করতে পারেননি তাদের প্রতি দলেরও কোনো সহানুভতি নেই। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যারা বিজয়ী হয়ে আসবেন তাদেরই মুল্যায়ন করা হবে। দলের মনোনয়ন বঞ্চিত ১৭ বর্তমান এমপি, ৩৫ জন স্থাানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং পৌরভা মেয়র।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের বিপরীতে যারা স্বতন্ত্র হিসেবে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন, তাদের কেউ সাবেক সংসদ সদস্য। কেউ এসেছেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে। আবার অনেকেই দলের স্থানীয় পর্যায়ে পদধারী নেতা। এসব আসনে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিজ দলের পদধারী শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। দলের মনোনীন ও স্বতন্ত্র উভয় প্রার্থী শক্তিশালী হওয়ায় নির্বাচনে প্রচারকাজে কেউ কাউকে ছাড় দিতে চাচ্ছেন না।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বড়ানোর জন্য দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এখন যেসব নেতা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করছেন, তাদের সকলেই দলের মনোনয়ন বঞ্চিত। তাদের বেশিরভাগই স্থানীয়ভাবে অনেক প্রভাবশালী। তাদের প্রচুর অনুসারী রয়েছে। আবার যারা দলের প্রার্থী তারাও শক্তিশালী। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে দেশের প্রায় সকল আসনেই দলের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে দলের স্বতন্ত্রদের লড়াই হচ্ছে। তবে যারা সংঘাতে জাড়াবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত