
দেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ অনেক পুরনো। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এখানকার ব্যাপক দুর্নীতির কথা। গণমাধ্যমেও প্রতিনিয়ত এই খাতটিতে চলা দুর্নীতির প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। অভিযোগ আছে, এখানে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় কেনাকাটায়। গতকালের কালের কণ্ঠেও প্রকাশিত হয়েছে এমনই এক উদ্ভট কেনাকাটার চিত্র। ২৪ কোটি টাকায় কেনা একটি লিনিয়ার অ্যাকসেলারেটর রেডিওথেরাপি মেশিন ১২ বছর ধরে বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে। এত দিনে মেশিনটির ওয়ারেন্টি পিরিয়ড পার হয়ে গেছে। এটি সচল করা যাবে কি না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। উপরন্তু এখনো সেটি স্থাপন করার মতো অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। অথচ ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত রেডিওথেরাপি মেশিনের স্বল্পতায় সারা দেশে অনেক রোগীর চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে।
এই কাহিনি দু-একটি নয়, শত শত। কোটি কোটি টাকা খরচ করে যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো স্থাপন করার মতো অবকাঠামো আগে তৈরি করা হয়নি। লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে দেশের অনেক সরকারি হাসপাতালে এ রকম অনেক যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। ২০২১ সালে একটি সহযোগী দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের ৪০টির বেশি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৯৩টি যন্ত্র দীর্ঘদিন অচল অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। এর মধ্যে ২৮টি যন্ত্র ছিল বাক্সবন্দি। সেগুলোর মধ্যে ছিল এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি ও ভেন্টিলেটর মেশিন। বরাবরই দেখা যায়, সংশ্লিষ্টরা বিশেষ কারণে কেনাকাটায় খুবই উৎসাহী থাকেন। কেনাকাটা হয়ে গেলে তাঁদের আর কোনো উৎসাহ দেখা যায় না। আর সে কারণেই ১২ বছর ধরে ২৪ কোটি টাকার মেশিন বাক্সবন্দি পড়ে থাকে। জানা যায়, ২০১১ সালের মে মাসে জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জন্য লিনিয়ার অ্যাকসেলারেটর রেডিওথেরাপি মেশিনটি কেনা হয়েছিল। কিন্তু ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে মেশিনটি স্থাপন করার মতো কোনো অবকাঠামো না থাকায় সেটি তখন পাঠিয়ে দেওয়া হয় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে। ওই সময় খুমেক হাসপাতালেও মেশিনটি স্থাপনের মতো কোনো অবকাঠামো বা সুযোগ ছিল না। ফলে সেটি বাক্সবন্দি অবস্থায় অনকোলজি বিভাগের সামনে ফেলে রাখা হয়। ২০১৫ সালের ১৭ নভেম্বর মেশিনটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘ভ্যারিয়েন মেডিক্যাল সিস্টেম’-এর এক প্রতিনিধিদল পরিদর্শন করে জানায়, এটি খুমেক হাসপাতালে স্থাপনের জন্য বিশেষ অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। এতে খরচ হবে সাত কোটি টাকা। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তখন সেই বরাদ্দ না দিয়ে আবার মেশিনটি জাতীয় ক্যান্সার ইনিস্টিটিউটে ফেরত নিতে চায়। যেহেতু মেশিনটি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত ও বাক্সবন্দি ছিল, তাই ক্যান্সার ইনস্টিটিউটও মেশিনটি নিতে চায়নি। এভাবেই মেশিনটি দীর্ঘ ১২টি বছর পার করেছে। এখন আর এই মেশিনের কোনো উপযোগিতা নেই বললেই চলে।
স্বাস্থ্য খাতের এমন দুর্নীতি-অনিয়মের অবসান হওয়া খুবই জরুরি। এমন কেনাকাটার সঙ্গে জড়িতদের আইনি প্রক্রিয়ায় যথাযথ জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।