জন্মভূমি ডেস্ক : গত দেড় দশকে সরকারি হাই-টেক ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের অনুমোদন দেয়া হয়েছে ৯২টি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি পার্ক প্রস্তুত হলেও তাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ আসেনি। এর মধ্যেই গত চার বছরে নতুন করে আরো ১০টি বেসরকারি পার্কের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (বিএইচটিপিএ)। সরকারি পার্কে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না আসা সত্ত্বেও বেসরকারি পার্কের অনুমোদন দেয়ায় প্রশ্ন তুলেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়িক সুবিধা ও কর রেয়াত পেতে হাই-টেক পার্ক ঘোষণায় আগ্রহী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
হাই-টেক পার্ক উন্নয়নের জন্য নিয়োগ করা ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক কার্যক্রম-সংশ্লিষ্ট সব ধরনের আয়কর থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সময়সীমা অনুযায়ী, ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরুর তারিখ থেকে প্রথম ১০ বছর শতভাগ, ১১তম বছর ৭০ শতাংশ, ১২তম বছর ৩০ শতাংশ হারে অব্যাহতি দেয়া হয়। পার্ক ঘোষণা পাওয়া প্রতিষ্ঠান আমদানি শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি, সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর থেকে অব্যাহতি পায়। পার্কে বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানিকে ৮০ শতাংশ এবং পার্ক উন্নয়নে পণ্য জোগানদারকে শতভাগ ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ঘোষিত পার্ককে ওয়্যারহাউজ স্টেশন সুবিধা দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে হাই-টেক পার্কে স্থাপিত শিল্প-কারখানা, প্রতিষ্ঠানটির পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার্য কাঁচামাল, উপকরণ আমদানির সময় প্রযোজ্য আমদানি শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি, মূল্য সংযোজন কর পরিশোধ না করে বন্ড ব্যবস্থায় আমদানি করতে পারবে। এছাড়া শুল্কমুক্ত যানবাহন আমদানি, মূলধনি যন্ত্রপাতি, নির্মাণ উপকরণ আমদানির ওপর নানা পর্যায়ে ভ্যাট ও শুল্ক মওকুফ করা হয়েছে।
বেসরকারি হাই-টেক পার্ক ঘোষণার বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন বলেন, ‘দেশের উৎপাদনশীল, রফতানিমুখী কোম্পানিগুলোকে আরো উৎসাহিত করতে হাই-টেক পার্কের ঘোষণা দিচ্ছে আইসিটি বিভাগ। তাদের এ সুবিধা প্রদান না করা হলে একদিকে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারবে না, অন্যদিকে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হবে না। সামনের দিনগুলোয় সফটওয়্যার রফতানির পাশাপাশি হার্ডওয়্যার রফতানিরও চিন্তাভাবনা করছি। যার কারণে আমাদের কোম্পানিগুলোকে পর্যাপ্ত সুবিধা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে হাই-টেক পার্ক হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছি।’
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মোবাইল ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দিতে এসব হাই-টেক পার্কের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি হাই-টেক পার্কে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যারা অনুমোদন পেয়েছেন তারা মার্কেটের বড় অংশীদার। এসব হাই-টেক পার্ক ঘোষণা করা হচ্ছে নামমাত্র। প্রকৃতপক্ষে নতুন বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা নেই এসব বেসরকারি পার্কে।
বিএইচটিপিএর তথ্য অনুযায়ী, হাই-টেক পার্ক ঘোষণার জন্য অনুমোদন পেয়েছে ১০টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠান মোবাইল অ্যাসেমব্লিং এবং ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মোবাইল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে আলামিন অ্যান্ড ব্রাদার্স, এডিসন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বেস্ট টাইকুন (বিডি) এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, লিনেক্স ইলেকট্রনিকস বাংলাদেশ লিমিটেড ও আনিরা ইন্টারন্যাশনাল। ইলেকট্রনিক পণ্য অ্যাসেমব্লিং এবং উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বাটারফ্লাই ম্যানুফ্যাকচারিং কো. লি.। মোবাইল ফোন অ্যাসেমব্লিং এবং ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ফেয়ার ইলেকট্রনিকস, ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড ও ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। ডেভেলপার হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে সিটি গ্রুপের প্রতিষ্ঠান সিটি হাই-টেক পার্ক লিমিটেড।
বিএইচটিপিএর একজন কর্মকর্তা জানান, সরকার হাই-টেক পার্ক করার জন্য বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। সরকার প্রদত্ত সুবিধা নিতেই এক বছর, তিন বছর, পাঁচ বছর ও ১০ বছর মেয়াদের হাই-টেক পার্কের অনুমোদন নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। সরকার নতুন বিনিয়োগ আহ্বানের জন্য হাই-টেক পার্কের সুবিধা দিলেও পুরনো বিনিয়োগ থেকে নতুন সুবিধা আদায় করতে এ পার্কের ঘোষণা আসছে। একদিকে মোবাইল ও ইলেকট্রনিক পণ্য অ্যাসেমব্লিংয়ে কর সুবিধা দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে হাই-টেক পার্ক ঘোষণার কারণে সুবিধা আরো বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বড় কোম্পানিগুলো আরো বড় হচ্ছে, ছোট অংশীদারদের বড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে।
দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ও হাই-টেক শিল্পের টেকসই বিকাশে ২০১০ সালে প্রণয়ন করা হয় বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ আইন। একই বছর বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ গঠিত হওয়ার পর থেকে সরকারের সহায়তাপুষ্ট ৯২টি হাই-টেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, ইনকিউবিশন সেন্টার তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। এসব উদ্যোগের অনেকগুলো এখনো আলোর মুখই দেখেনি। সমাপ্ত প্রকল্পগুলোয়ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ আসছে না।
বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, সরকার এ পর্যন্ত ১৬টি হাই-টেক পার্ক, চারটি সফটওয়্যার পার্ক, ৭১টি শেখ কামাল অ্যান্ড ইনকিউবিশন সেন্টার এবং একটি ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি পার্ক (মোট ৯২টি) তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি প্রকল্পকে পার্ক হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এসবের মধ্যে কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি, রাজশাহীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্কসহ সাতটি প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পার্ক প্রস্তুত হলেও মূল লক্ষ্য বিদেশী বিনিয়োগ আসছে না, এমনকি দেশীয় বিনিয়োগও পর্যাপ্ত নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় দশকের বেশি সময়ে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ১৮ কোটি ডলার। পার্কগুলোর মধ্যে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প কালিয়াকৈরের বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগকারী সবার তথ্য নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে বারবার এ বিষয়ে তথ্য চেয়েও পাওয়া যায়নি। সুনির্দিষ্ট করে বিনিয়োগের তথ্য রয়েছে মাত্র ৩১টি প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে সর্বনিম্ন ৫৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে আইটি হাব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। ৫৫ লাখ থেকে ৪৯ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা প্রতিষ্ঠান ১৯টি। এছাড়া চারটি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ৫০ থেকে ৯৯ কোটি টাকা পর্যন্ত। ১০০ কোটির বেশি বিনিয়োগ করেছে মাত্র আট প্রতিষ্ঠান।
কালিয়াকৈর ছাড়াও সিলেট ও রাজশাহীতে দুটি হাই-টেক পার্কের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। পার্কগুলোয় কার্যক্রম চালাচ্ছে স্বল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠান। বিনিয়োগকারীরা শুরুতে আগ্রহ দেখালেও দিন দিন তা কমে এসেছে। জমি বা ফ্লোর স্পেস বরাদ্দ নেয়ার পর উৎপাদন শুরুর জন্য নতুন করে বিনিয়োগ করছেন না তারা। এখন পর্যন্ত হাই-টেক পার্কগুলোয় বিপুল পরিমাণ জায়গা বরাদ্দ হলেও তা অব্যবহৃত পড়ে থাকছে। এর মধ্যে চার বছর ধরে বেসরকারি হাই-টেক পার্কের অনুমোদন দিয়ে আসছে সরকার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএইচটিপিএর দুজন কর্মকর্তা জানান, হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ পার্কগুলোর ব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাজ করলেও এর অনুমোদন দিচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। হাই-টেক পার্কের কাছে আবেদন এলে সে আবেদন যাচাই-বাছাই করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে আরেকবার যাচাই-বাছাই করা হয়। তারাই পার্কের অনুমোদন দেয়।
চার বছরের মধ্যে এত সংখ্যক হাই-টেক পার্কের অনুমোদন বিষয়ে জানতে চাইলে বিএইচটিপিএর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিএসএম জাফরউল্লাহ্ বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদনের ভিত্তিতে হাই-টেক পার্ক ঘোষণা করা হয়ে থাকে। একটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের ঘোষণার পর সাধারণত তার প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহ প্রকাশ করে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে বিগত তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। বর্তমান সরকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছে। এ খাতে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগও বাড়বে।’
উল্লেখ্য, বেসরকারি হাই-টেক পার্ক ঘোষণার বিষয়টিকে আরো উৎসাহিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জিএসএম জাফরউল্লাহ্ আরো বলেন, ‘হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি), সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা (আইটিইএস) খাতকে বিকশিত করার লক্ষ্যে ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে কাজ করছে। সরকার এ খাতকে আরো প্রসারিত করার জন্য বিভিন্ন সুবিধা দিচ্ছে। বেসরকারি হাই-টেক পার্কের অনুমোদন তার মধ্যে একটি। এসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সুবিধা পায়। সরকার কর্তৃক যেকোনো সুবিধা সাধারণত ভোক্তারা পাবে বলে প্রত্যাশা বিএইচটিপিএর।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে কম্পিউটার সেবা খাতে ৩০ কোটি ৩৭ লাখ ৩৮ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে ৬০ কোটি ৮০ লাখ ৬০ হাজার ডলারে পরিণত হয়। পরের বছর ২০২২-২৩ অর্থবছরে কমে ৫৪ কোটি ৯৫ লাখ ৭৫ হাজার ডলার হয়। কম্পিউটার সেবা খাতের মধ্যে রয়েছে কাস্টমাইজ, নন-কাস্টমাইজ কম্পিউটার সফটওয়্যার, ডেটা প্রসেসিং ও হোস্টিং সার্ভিস, কনসালট্যান্সি সার্ভিস, ইনস্টলেশন, মেইনটেন্যান্স ও রিপেয়ার প্রভৃতি। তবে এ সময়ে হার্ডওয়্যার পণ্য রফতানির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।