জন্মভূমি ডেস্ক : সন্ধ্যা নামতেই নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার ভবানীপুর সীমান্ত দিয়ে মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসে হাতির পাল। নষ্ট করে জমির পাকা ধান ও সবজি খেত। অনেক সময় ঘরবাড়িতেও হানা দেয়। এদের তাড়াতে গিয়ে উল্টো আক্রান্ত হয় স্থানীয়রা। খাবারের সন্ধানে কয়েক বছর ধরেই সীমান্ত পার হয়ে হাতি ঢুকছে বাংলাদেশে।
বন্যহাতির তাণ্ডব থেকে জনপদ ও মানুষের নিরাপত্তার জন্য ২০১৬ সালে সোলার ফেন্সিং (সৌরবেষ্টনী) দিয়েছিল শেরপুর জেলা বন বিভাগ। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ওই প্রকল্পের যন্ত্রপাতি মাস ছয়েকের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। প্রকল্পের সুফল না মিললেও নতুন করে ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলায় সৌরবেষ্টনী দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে বন বিভাগ। এতে ব্যয় হবে প্রায় ২৫ কোটি টাকা। অথচ এর চেয়ে অনেক কম খরচে বেত ও লেবু গাছ লাগিয়ে হাতি দূরে রাখার কৌশল প্রয়োগের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চার জেলায় হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে সৌরবেষ্টনী দেয়ার একটি প্রকল্প প্রস্তাব দিয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন বিভাগ। জেলা চারটি হলো—ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুর। এসব জেলায় বনঘেঁষা ১৭০ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে ১১৯ কিলোমিটার সড়কে সৌরবেষ্টনী দেয়া হবে।
সৌরবেষ্টনী সম্পর্কে জানতে চাইলে বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারের মধ্যে সৌরবিদ্যুতের সংযোগ থাকে। হাতি যদি এ তার স্পর্শ করে তাহলে সে বৈদ্যুতিক শক খায়। ফলে ভয় পেয়ে অন্য পথে হাঁটা শুরু করবে। কম ভোল্টেজ থাকায় প্রাণীগুলো শক খেলেও মারা যায় না। এতে অন্যান্য প্রাণীরও ক্ষয়ক্ষতি হয় না।
বন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভারত সীমান্তঘেঁষা ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুর জেলায় বন্যহাতি ব্যাপক আক্রমণ চালায়। হাতির উপদ্রব থেকে বাঁচতে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা ও আফ্রিকার দেশগুলোর মডেল অনুসরণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় প্রায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প নেয়া হয়। তখন ঝিনাইগাতীতে ১১ কিলোমিটার ও নালিতাবাড়ীতে দুই কিলোমিটার বৈদ্যুতিক তারের বেড়া ও বায়োলজিক্যাল ফেন্সিং ( লেবু ও বেত প্রজাতির বাগান) করা হয়। নির্মাণের পর চার মাস সুফল ভোগ করলেও বর্তমানে তারের বেড়া আর কাজে আসছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান বলেন, ‘এর আগে আমরাই পরামর্শ দিয়েছিলাম বায়োলজিক্যাল ফেন্সিং করার জন্য।’
স্থানীয়রা জানান, সৌর প্রকল্পে ব্যবহৃত ব্যাটারিগুলো নিম্নমানের হওয়ায় নির্মাণের চার মাসের মাথায় অকেজো হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তারগুলো হারিয়ে গেছে। তবে লেবু ও বেত প্রজাতির গাছগুলো এখনো রয়েছে। এই গাছগুলো পরিবেশের জন্যও উপকারী, আবার হাতি তাড়ানোর কাজও করে। এটাই টেকসই পদ্ধতি।
সম্প্রতি দেখা যায়, ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের ছোট গজনী এলাকা এবং তাওয়াকুচায় নির্মিত সৌরবিদ্যুতের তার ছিঁড়ে ও জটলা বেঁধে তাতে পাহাড়ি লতা-পাতায় আঁকড়ে আছে। আবার অনেক স্থানে খুঁটির সঙ্গে তারের কোনো সংযোগ নেই। এছাড়া অন্য যন্ত্রপাতিগুলোও মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরুর দিকে সৌরবেষ্টনীর ফলে সীমান্তবর্তী মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে। তবে অল্পদিন পরই যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ায় মানুষ হতাশ। নতুন করে প্রকল্প নেয়ার খবরে তারা খুব একটা আশাবাদী হতে পারছে না। স্থানীয়রা বিশেষ করে আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন বাড়ির চারপাশে বেতগাছ লাগিয়ে অনেক আগে থেকে হাতিকে কাছাকাছি ঘেঁষতে দেয় না। স্থানীয়রা পরামর্শ দিয়েছেন, বন বিভাগের উচিত লেবু বা বেত গাছের মতো টেকসই পদ্ধতি অবলম্বন করা।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আ ন ম আব্দুল ওয়াদুদ জানান, দুই দফায় পরীক্ষামূলক ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার ১৩ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় সৌর ও জৈব বেড়া চালু করে সফলতা পাওয়া গেছে। এবার ময়মনসিংহ বিভাগের তিন জেলায় ১১৯ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রকল্পটি সম্প্রসারণ হচ্ছে। যদিও আগে এটি রক্ষণাবেক্ষণে কোনো জনবল ও বাজেট ছিল না। ফলে আগের যন্ত্রপাতি অনেকটা অকার্যকর হয়ে আছে। প্রকল্প চালু হলে এবং রক্ষণাবেক্ষণ থাকলে হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব দূর করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
হাতির আক্রমণ রুখতে ফের সৌরবেষ্টনী
Leave a comment