শেখ আব্দুল হামিদ : দীর্ঘ ১৬ বছরের মধ্যে এবারই ভয়াবহ ঘূর্ণি ঝড়ের তান্ডব থেকে রেহাই পেল খুলনা। ‘মোখা’র প্রভাব কোথাও দেখা যায়নি। প্রতি বছরই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণি ঝড় খুলনার উপকূল এলাকায় আঘাত হেনে ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয় জনজীবন। ঘটেছে বহু প্রাণহানিসহ অপরিসিম ক্ষয়ক্ষতি। ঘূর্ণি ঝড়ের তীব্রতার ঝড়ো হাওয়া, বৃষ্টি অথবা বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বহু এলাকা প্লাবিত করে তোলে। বিগত ১৬ বছরের মধ্যে এবারই তার ব্যতিক্রম হয়েছে। অতিপ্রবল ঘূর্ণি ঝড় ‘মোখা’র কোন প্রভাবই পড়েনি খুলনায়। ঝড়ো হাওয়া বৃষ্টি নদীর পানি বৃদ্ধি কোনটাই দেখা যায়নি। ফলে খুলনার মানুষ ১৪ মে স্বস্তিতেই ছিলেন।
রোববার খুলনায় বড় কোন ঝড়ো বাতাস বইতে দেখা যায়নি। আকাশ কিছুটা মেঘলা দেখা যায়। তাছাড়া মোখার প্রভাবে নদীতে পানিও বৃদ্ধি পায়নি। উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ, কয়রা, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছায় মানুষের মাঝ তেমন কোন উদ্বেগ উৎকন্ঠাও পরিলক্ষিত হয়নি।
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী আশরাফুল আলম জানান, মোখার কোন প্রভাব না পড়ায় জোয়ারের পানি বাড়তে দেখা যায়নি। পানির উচ্চতা অন্যান্য জোয়ারের মতই স্বাভাবিক রয়েছে।
খুলনা আবহাওয়া অফিস ইনচার্জ আমিরুল আজাদ বলেন, ঘূর্ণি ঝড় মোখা ছিল অন্যান্য বারের ঘূর্ণি ঝড় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির। আগের ঘূর্ণি ঝড় গুলোতে ঝড়ের অগ্রভাগে মেঘ ছিল। আর সেই মেঘ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে বৃষ্টি হতো। কিন্তু এবারের মেঘ ঘূর্ণি ঝড় কেন্দ্রের মধ্যে সিমাবদ্ধ ছিল। সে কারণে চট্রগ্রাম, কক্্রবাজার এলাকায় আঘাত করা মোখার প্রভাবে খুলনায় কোন বৃষ্টি হতে দেখা যায়নি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ বছরে ঘূর্ণি ঝড়ে কমপক্ষে ১৪ বার আঘাত হেনেছে খুলনার উপকূল এলাকায়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘন্টায় ২৬০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে ‘সিডর’। বাগেরহাট জেলায় ৯০৮ জন এবং খুলনায় ৪৫ জনের প্রাণহানির পাশাপাশি সুন্দরবনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। পানি উচ্চতা ১০/১২ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণি ঝড় আইলার প্রভাবে খুলনায় নিহত হয়েছিল ৫৭ জন, সাতক্ষীরায় ১১ জন এবং বাগেরহাটে ৮ জন। পাশাপাশি বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তৃর্ণ এলাকা প্লবিত হয়। ২০১৩ সালের ১৬ মে দেশের নোয়াখালী ও চট্রগ্রাম উপকূলে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ আঘাত করে। এর ফলে খুলনার উপকূলবর্তী এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’ চট্রগ্রাম উপকূলে আঘাত করে। খুলনায় ছিল ঝড়ো বাতাস ও বৃষ্টি। ২০১৬ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ চট্রগ্রাম উপকূলে আঘাত করে, এর প্রভাবে খুলনায় ব্যাপক বৃষ্টি হয় এবং সেই সঙ্গে ছিল ঝড়ো বাতাস। ২০১৭ সালের ৩০ মে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে। এর প্রভাবে খুলনায় ছিল ঝড়ো বাতাস ও বৃষ্টি। ২০১৯ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ‘ফনি’র আঘাতে খুলনায় ৪ হাজার ৬৪০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এর আঘাতে খুলনায় গাছ চাপা পড়ে ২ জন নিহত হয়। সুন্দরবনের ৪ হাজার ৫৮৯টি গাছ ও সাড়ে ৯ হাজার ঘরবাড়ি, ২ হাজার ৭৭২টি চিংড়ি ঘের ও পুকুর প্লাবিত, ২৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ এর আঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙে খুলনায় লোকালয় ও জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের বনভূমি প্লাবিত হয়। লোকালয়ের ৮৫ হাজার ঘরবাড়ি ও সুন্দরবনের ১২ হাজার ৩৫৮টি গাছপালা ভেঙে যায়। ২০২১ সালের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর আঘাতে খুলনার কয়রায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়ে। প্রায় ৬ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতির শিকার হয়। ৪/৫ ফুট উচ্চতার জোয়ারে তলিয়ে যায় সুন্দরবনের বনভূমি। মারা যায় ৪টি হরিণ। ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর ঘূর্ণিঝড় ‘জাওয়াদ’ এর প্রভাবে খুলনার কয়রায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হয়। ২০২২ সালের ৯ মে ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’র প্রভাবে খুলনায় ভারী বৃষ্টি হয়। ২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর আরও একটি ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ কয়রায় আঘাত হানে। বেড়িবাঁধ ধসে যায় এবং ১ হাজার ৬০০টি ঘর বাড়ির আংশিক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত