
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা। এই অবিস্মরণীয় ও গৌরবদীপ্ত যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় আসে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এর চেয়ে বড় বিজয় আমাদের জাতীয় ইতিহাসে আর নেই। ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দিনকে দিন যুদ্ধ বিজয়ের পথে এগিয়েছে। তার কিছু ঘটনা পর্যায়ক্রমিকভাবে এখানে তুলে ধরা হলো। গ্রন্থনা করেছেন: সৈয়দ ইবনে রহমত।
১ ডিসেম্বর: ১ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন দিল্লিতে ভারতের রাজ্যসভার অধিবেশনে দেওয়া এক বক্তৃতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য অপসারণের নির্দেশ দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান। ইন্দিরা গান্ধী এসময় বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য অপসারণই সমস্যার শ্রেষ্ঠ সমাধান।’
এদিন সকাল পৌনে ৮টায় ঢাকা ইস্কাটনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) কার্যালয়ে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এতে দুজন সামান্য আহত হয়। গেরিলাদের এ বোমা হামলায় অফিসের ৩টি কক্ষ ও কাগজপত্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এই অফিস দুমাস আগে জুলফিকার আলী ভুট্টো উদ্বোধন করেছিলেন।
২ ডিসেম্বর: এই দিনে মুক্তিবাহিনী ঘোড়াশালে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর চারদিক থেকে আক্রমণ করে ২৭ জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। এখান থেকে বেশ কিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনী।
৩ ডিসেম্বর: দিনটি ছিল শুক্রবার। এদিন পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে বসে। আর এর মাধ্যমেই ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বের ইতিহাস শুরু হয়। মুক্তি বাহিনীর সর্বাত্মক হামলায় পাকিস্তানী হানাদাররা দিশেহারা হয়ে পড়ে। একের পর এক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে পাক সেনাদের ঘাটি। শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ, আত্মসম্মান বাঁচানোর লড়াইয়ের শেষ ধাপ।
এদিন কুমিল্লায় মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মিয়াবাজারে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালায়। ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা মিয়াবাজার দখল করে নেন। আখাউড়ার আজমপুর স্টেশনে দুই পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দিনভর যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, পাকিস্তান আজ ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের আক্রমণ ঐক্যবদ্ধভাবেই প্রতিহত করতে হবে। তিনি দেশবাসীকে চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য তৈরি হবার আহ্বান জানান।
৪ ডিসেম্বর: একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত হতে থাকে। সে খবর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সেই বিজয়ের বার্তা যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের করে তোলে আরও দুর্বার, অপ্রতিরোধ্য। রণাঙ্গনে যখন যুদ্ধ চলছিল তখন আরেক যুদ্ধ চলছিল জাতিসংঘে। বাংলাদেশের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির মধ্যে। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে তখন দারুণ উত্তেজনা। নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের পক্ষে মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ (জর্জ ডব্লিউ বুশের বাবা) যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব উপস্থাপন করে। প্রস্তাবে দাবি করা হয়, এ মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানকে নিজ নিজ সীমান্তের ভেতর সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
ওদিকে ভারতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারও তখন চরম উৎকণ্ঠায়। এদিন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে লিখিত এক পত্রে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানান। পত্রে বলেন, ভারত সরকার অবিলম্বে আমাদের দেশ ও সরকারকে স্বীকৃতি দান করুক।
৫ ডিসেম্বর: এদিন দিল্লিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব কে বি লাল বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি দেশ। ভারত খুব শিগগির বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। আমরা এরই মধ্যে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি।’
এদিন ঢাকায় ভারতের বিমানবাহিনী বিমান থেকে ১২ ঘণ্টাব্যাপী বোমা হামলা চালায়। এ সময়ের মধ্যে তারা তেজগাঁও ও কুর্মিটোলায় ৫০ টনের মতো বোমা ফেলে। এতে হানাদারদের ৯০টি অস্ত্রবাহী ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এদিন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ বিষয়ক প্রশ্নে যুদ্ধ বিরতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ভারত ও পাকিস্তানের সেনা অপসারণ সংক্রান্ত প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।
৬ ডিসেম্বর: এদিন ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ফলে রণাঙ্গন আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মিত্রবাহিনীর আক্রমণে দিশাহারা হানাদার বাহিনী সূর্য ওঠার আগেই বিভিন্ন সীমান্ত ঘাঁটি থেকে পালাতে থাকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয় শুধুই সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এদিন মিত্রবাহিনী অবিরাম বিমান আক্রমণ চালায়। বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌবাহিনী সৃষ্টি করে নৌ-অবরোধ। দশম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কর্নেল জাফর ইমামের নেতৃত্বে ফেনী মুক্ত করেন। মেজর জলিলের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা সাতক্ষীরা মুক্ত করে খুলনার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ঝিনাইগাতির আহম্মদ নগর হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন কোম্পানি কমান্ডার মো. রহমতুল্লাহ। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও মুক্ত করে বীরগঞ্জ ও খানসামার পাক অবস্থানের দিকে এগিয়ে চলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। লাকসাম, আখাউড়া, চৌদ্দগ্রাম, হিলিতে মুক্তিবাহিনী দৃঢ় অবস্থান নেয়। রাতে আখাউড়া ও সিলেটের শমসেরনগর যৌথবাহিনীর অধিকারে আসে। ঝিনাইদহ শহর শত্রু মুক্ত করে যৌথবাহিনী।
৭ ডিসেম্বর: এদিন ভোরে ভারতীয় ছত্রীসেনা সিলেটের নিকটবর্তী বিমানবন্দর শালুটিকরে নামে। তারপর চতুর্দিক থেকে পাক ঘাঁটিগুলির উপর আক্রমণ চালায়। দুপুর বেলাতেই এখানকার পাকিস্তানি সেনানায়ক আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। এদিন যৌথবাহিনী চান্দিনা ও জাফরগঞ্জ অধিকার করে। বিকালের দিকে বগুড়া-রংপুর সড়কের করতোয়া সেতু দখল নিয়ে পাকিস্তান ও যৌথবাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। এসময় জেনারেল নিয়াজি গোপন বার্তা পাঠিয়েছিলেন রাওয়ালপিন্ডির হেডকোয়ার্টার্সে। গোপন এ বার্তা পেয়ে হেডকোয়ার্টার থেকে ৭ ডিসেম্বর সম্মুখসমর থেকে সৈন্যদের পিছিয়ে এনে প্রতিরোধ ঘাঁটিতে সমবেত করার জন্য নিয়াজির পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয়।
৮ ডিসেম্বর: দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা পাকিস্তানী সৈন্যদের ঢাকার দিকে পালানোর কোনো পথই খোলা ছিল না। একের সঙ্গে অন্যের যোগ দেওয়ারও কোনো উপায় ছিল না। এই সুযোগে মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তারা তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করে পুরো পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। জেনারেল জগজিৎ সিংকে তিনটি কলাম নিয়ে ঢাকার দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার জন্য বলা হয় এবং একটি ব্রিগেডকে দ্রুত হালুয়াঘাটের দিক থেকে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এদিকে সন্ধ্যার মধ্যে ১১তম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট আশুগঞ্জের পূর্ব পাশে আজমপুর ও দুর্গাপুরে সমাবেশ করে। সরাইল ও শাহবাজপুরের মধ্যে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল এবং সেক্টরভুক্ত এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য পেছন দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকে। ভারতীয় ৩১১তম মাউন্টেন ব্রিগেডের দশম বিহার রেজিমেন্ট দুর্গাপুরের দক্ষিণে সমবেত হয়।
যৌথ বাহিনীর এই অগ্রগতির ফলে পাকিস্তান সরকার ও তাদের মিত্র দেশগুলোর বুঝতে বাকি থাকে না যে যুদ্ধে তাদের হার নিশ্চিত। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি পালন এবং সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে।
৯ ডিসেম্বর: দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মিশন প্রধান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বলেন, ‘আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই ঢাকা মুক্ত হবে। ঢাকার পতনের মধ্য দিয়ে আমাদের মাতৃভূমি হানাদার শত্রুদের কবল থেকে মুক্ত হবে। বাংলাদেশ মুক্ত হলেই মুক্তিবাহিনী থেমে যাবে না। পাকিস্তান যদি ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ প্রত্যাহার না করে তবে আমাদের মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় জওয়ানেরা পশ্চিম পাকিস্তানেও যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।’ এদিন গাইবান্ধা, নেত্রকোনা, খুলনার কপিলমুনি, কুষ্টিয়ার কুমারখালী, কুমিল্লার দাউদকান্দি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস, গাজীপুরের শ্রীপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ, গফরগাঁও, ত্রিশাল, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত করে মুক্তিবাহিনী।
১০ ডিসেম্বর: ময়মনসিংহে যৌথ বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আঘাত হানে। পাকিস্তানি সেনারা দিনের বেলা কিছুটা প্রতিরোধ করলেও রাত থেকে টাঙ্গাইলের ভেতর দিয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। জামালপুরে বিকেল চারটার দিকে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্টকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়ে একটি পত্র পাঠানো হয়। পাকিস্তানি অধিনায়ক একটি বুলেট কাগজে মুড়ে পাঠিয়ে উত্তর দেয়, অর্থাৎ তারা যুদ্ধ চালাবে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমানগুলো বোমাবর্ষণ করে তাদের অবস্থা শোচনীয় করে তোলে। সন্ধ্যা থেকেই মুক্তিবাহিনী চারদিক থেকে জামালপুর শহরে ঢুকতে থাকে। তবে পাকিস্তানি সেনারা ১০ ডিসেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে যৌথ বাহিনীর ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ভোরের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যুহে ঢুকে তাদের পাতা ফাঁদে আটকা পড়ে যায়। ভারতের ১০ বিহার রেজিমেন্ট এবং মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি তাদের ফাঁদমুক্ত করার জন্য দুর্গাপুরের দিক থেকে আক্রমণ করে। বেলা প্রায় সাড়ে ১০টায় পাকিস্তানি সেনারা ভৈরব সেতুর আশুগঞ্জসংলগ্ন অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ভারতীয় বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন ট্যাংকও দুর্গাপুরের দিক থেকে এ আক্রমণে অংশ নেওয়ার সময় পাকিস্তানি ট্যাংকবিধ্বংসী মাইনফিল্ডের ফাঁদে পড়ে যায়। যুদ্ধে দুই পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আশুগঞ্জে থাকা পাকিস্তানি সেনারা রাতে ভৈরব চলে যায়। ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়। আশুগঞ্জও মুক্ত হয়। মেঘনা নদী পেরিয়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সেনারা ভৈরব বাজারের কাছে ঘাঁটি করেন। মুক্তিবাহিনীর নৌ ইউনিট ও ভারতীয় নৌবাহিনী এদিন যৌথভাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর চালনা মুক্ত করে।
১১ ডিসেম্বর: পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ড. এম এ মালিক যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া শুরুর প্রস্তাব এই দিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নাকচ করে দেন।
এদিকে, রণাঙ্গণে যৌথ বাহিনীর সাথে বিভিন্ন স্থানে জোর সংঘর্ষ শুরু হয়। কোনো সংঘর্ষেই পাকিস্তানি বাহিনী যৌথ বাহিনীর সুসংগঠিত আক্রমণের মুখে টিকতে পারে না। কোথাও তারা আত্মসমর্পণ করে, কোথাও পালিয়ে ঢাকার পথে রওয়ানা হয়।
১২ ডিসেম্বর: এদিন থেকে ঢাকা দখলের লড়াই শুরু হয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকা কার্যত মুক্ত। আগের দিন ভারতীয় বাহিনীর ছত্রীসেনারা ঢাকার আশপাশে মুক্ত কিছু এলাকায় নেমে পড়ে। সবকিছু পরিকল্পনামতো চলছিল। ভৈরব বাজার থেকে যৌথ বাহিনী এদিন নরসিংদীতে এসে পৌঁছায়। আগের দিন যারা ময়মনসিংহ দখল করেছিল, তারাও ক্রমশ ঢাকার দিকে আগুয়ান হয়।
এদিন রাতে নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক ডাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জোর চেষ্টা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ডের জোরালো দাবির মুখে তা স্থগিত হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকে চীন সমর্থন জানিয়েছিল।
১৩ ডিসেম্বর: এদিনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শিগিগরিই যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। তিনি ঘোষণা করেন, যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধ চায় না, তবে যুদ্ধ বাধলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাতে জড়িয়ে পড়বে না। এদিকে যৌথবাহিনী ঢাকার পতন দ্রুততর করার প্রয়োজনে যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে। কেননা ঢাকার পতন হলে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের পরাজয় চূড়ান্ত হবে। তাই সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের উপকূলে পৌঁছানোর আগেই পতন চূড়ান্ত করতে চাইছিল যৌথবাহিনী। তবে এত দ্রুত যে ঢাকা আক্রমণ করা সম্ভব হবে এটা ধারণাতেও ছিল না ভারতীয় সেনাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াইয়ের কারণেই দ্রুত মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে এগুতে পারে।
১৪ ডিসেম্বর: এদিনটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর দিন। মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে বাঙালি জাতিকে চিরতরে মেধাশূন্য ও পঙ্গু করে দেওয়ার লক্ষ্যে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, আইনজীবী ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি পেশাজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করা হয়। ওদিকে এদিন বিভিন্ন রণাঙ্গনে ক্রমাগত উড়তে থাকে বাংলাদেশের বিজয় পতাকা। শত্রুমুক্ত হয় ঢাকার পার্শ্ববর্তী গাজীপুরের পূবাইল, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও বৈদ্যের বাজার, বগুড়া জেলার শেরপুর ও শিবগঞ্জ থানাসহ জেলা শহরের একাংশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুরসহ সিরাজগঞ্জ এলাকা, আক্কেলপুর ও পাঁচবিবিসহ জয়পুরহাট জেলা, যশোরের কেশবপুর, রংপুরের মিঠাপুকুর, চট্টগ্রামের বান্দরবান, চান্দনাইশ, সাতকানিয়া, পটিয়া ও কুমিড়া, ব্রাহ্মবাড়িয়ার নবীনগর, কিশোরগঞ্জের তাড়াইল প্রভৃতি এলাকা। এদিনই সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান পূর্বাঞ্চলীয় দখলদার বাহিনী প্রধান নিয়াজী ও গভর্নর ডা. মালিকের কাছে যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দিয়ে এক তারবার্তা পাঠান।
১৫ ডিসেম্বর: ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য শেষবারের মতো নির্দেশ দেন। এর আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বাট ডি স্পিভাকের মাধ্যমে দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে যুদ্ধবিরতির আরজি পাঠান। নিয়াজির বার্তায় সাক্ষী হিসেবে সই করেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সেটি ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশের কাছে পাঠায়। জেনারেল মানেকশ সঙ্গে সঙ্গে বিকেল ৫টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকায় বিমান হামলা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে মানেকশ যুদ্ধবিরতির বদলে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তিনি জানান, বিমানবাহিনীর আক্রমণ বন্ধ থাকলেও স্থলবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অভিযান চলবে। সকাল ৯টার মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে আবার বিমান হামলা শুরু হবে। তারা আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশনের পূর্ণ সুযোগ প্রদানের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।
এদিন পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের একাংশ বঙ্গোপসাগরে এসে হাজির হয়। বহরে ছিল আক্রমণক্ষম হেলিকপ্টারবাহী জাহাজ ত্রিপোলিসহ কয়েকটি রণতরি। ত্রিপোলিতে ছিল ২৩টি হেলিকপ্টার, অন্য জাহাজে ছিল ডেস্ট্রয়ার এবং উপকূলে অবতরণের উপযোগী জলযান। সপ্তম নৌবহরের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে এদিন ২০টি সোভিয়েত রণতরি ভারত মহাসাগরে এসে জড়ো হয়। বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ভারতীয় নৌবাহিনীর সমর্থনে সোভিয়েত রণতরি ভারত মহাসাগরে অবস্থান নিলে সপ্তম নৌবহর তার দিক পরিবর্তন করে।
১৬ ডিসেম্বর: ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিন। রক্তক্ষয়ী দীর্ঘ যুদ্ধের পর এদিন মুক্ত হয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজীর নির্দেশে এদিন ভোর ৫টা থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যুদ্ধবিরতি শুরু করে।
বিকেল ৪টায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজী রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছালে তাকে ২ পক্ষের সেনারা গার্ড অফ অনার দেয়। এরপর বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন। আত্মসমর্পণ দলিলে পাকিস্তানি নৌ-পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার রিয়ার-অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শরিফ, পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় বিমান বাহিনীর কমান্ডার এয়ার ভাইস-মার্শাল প্যাট্রিক ডেসমন্ড কালাঘানও সই করেন। আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন এ কে খন্দকার। তিনি এ সময় সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ভারতের পক্ষে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় ৪র্থ কোরের কমান্ডার লে. জেনারেল সগত সিং, পূর্বাঞ্চলীয় বিমান বাহিনীর কমান্ডার এয়ার মার্শাল হরি চাঁদ দেওয়ান ও ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব। আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটল স্বাধীন বাংলাদেশের।
১৬ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় দিন। এই দিনটি কেবল বিজয়ের উৎসব নয়, এটি আত্মত্যাগ, মানবিক মর্যাদা ও জীবনের অধিকারের স্মারক। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতার মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে মানুষ নিরাপদে বাঁচবে, নির্বিঘ্নে চলাচল করবে এবং সম্মানের সঙ্গে জীবন যাপন করতে পারবে। অথচ স্বাধীনতার পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পর দাঁড়িয়ে আজ প্রশ্ন জাগে-আমাদের সড়কগুলোর বর্তমান অবস্থা কি সেই বিজয়ের চেতনাকে সত্যিই ধারণ করতে পেরেছে?
প্রতিদিন সড়কে যে প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, আমরা সেগুলোকে খুব সহজে দুর্ঘটনা বলে চিহ্নিত করি। শব্দটি ব্যবহার করে যেন আমরা দায় এড়িয়ে যেতে স্বস্তি পাই। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এগুলো কি নিছক দুর্ঘটনা? নাকি দীর্ঘদিনের অব্যবস্থা, দুর্বল আইন প্রয়োগ, দায়িত্বহীনতা এবং সামগ্রিক উদাসীনতার ফল? যে দেশের স্বাধীনতা রক্তে কেনা, সে দেশে সড়কে মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া কি বিজয়ের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে?
সড়ক নিরাপত্তা কোন বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, এটি সরাসরি মানুষের জীবনের অধিকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত। নিরাপদ সড়ক মানে শুধু মসৃণ বা প্রশস্ত রাস্তা নয়। এর অর্থ শৃঙ্খলিত যানবাহন ব্যবস্থা, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চালক, নিয়ম মানার সংস্কৃতি, পথচারীবান্ধব অবকাঠামো এবং সর্বোপরি কার্যকর আইন এর প্রয়োগ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের সড়কগুলোতে বেপরোয়া গতি, অদক্ষ ও অপ্রশিক্ষিত চালক, যাত্রী টানার প্রতিযোগিতা এবং ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা নিত্যদিনের চিত্র। এর প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ মানুষ—শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী মানুষ, নারী, শিশু ও বয়স্করা।
রোডক্র্যাশে নিহত একজন মানুষ কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, তিনি একটি পরিবারের স্বপ্ন, নির্ভরতা ও ভবিষ্যৎ। একটি দুর্ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে একটি পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে অনিশ্চিত এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে একটি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারানোর অর্থ আজীবনের সংগ্রাম। তবুও আমরা প্রায়শই এসব মৃত্যুকে নিয়তির দায় বলে এড়িয়ে যাই। এই মানসিকতাই আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এবং সড়ক নিরাপত্তা অগ্রগতির প্রধান অন্তরায়।
রাষ্ট্রের দায়িত্বের জায়গায় তাকালে দেখা যায়, সেফ সিস্টেম এর আলোকে সড়ক নিরাপত্তা আইন না থাকা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সীমাবদ্ধতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি এবং জবাবদিহিতার অভাব সড়ক ব্যবস্থাপনাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। প্রকৌশল, আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতা- এই তিন স্তরের সমন্বয় ছাড়া সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবে এই সমন্বয় এখনো প্রত্যাশিত মাত্রায় গড়ে ওঠেনি।
তবে বর্তমানে সড়ক নিরাপত্তা শুধু প্রশাসনিক সমস্যা নয়, এটি সামাজিক মূল্যবোধ ও জনমনের পরিবর্তনেরও প্রশ্ন। আমাদের প্রতিটি নাগরিক যদি ছোট ছোট দায়িত্বগুলো নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ করে, যেমন সীটবেল্ট পরা, হেলমেট ব্যবহার এবং মোবাইল ফোনে কথা না বলা, তবে রোডক্র্যাশের ঝুঁকি উল্লেখ্যযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ও মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যুবসমাজকে সড়ক নিরাপত্তার অংশীদার হিসেবে ধরে নিলে পরিবর্তন গড়ে ওঠা আরও ত্বরান্বিত হবে। সরকারের পরিকল্পনা ও নাগরিক উদ্যোগ মিলিত হলে, প্রতিটি পথ, প্রতিটি শহর ও গ্রামে নিরাপদ চলাচলের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়বে। এই ধরনের সমন্বিত প্রচেষ্টা শুধু জীবন বাঁচাবে না, বরং দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে শুধু রাষ্ট্রের দিকে আঙুল তুললেই দায়িত্ব শেষ হয় না। নাগরিক হিসেবেও আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে। চালক হিসেবে নিয়ম মানা, পথচারী হিসেবে সচেতন থাকা, যাত্রী হিসেবে অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। এসবই সড়ক নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আইন মানাকে যদি আমরা ভয় বা বাধ্যবাধকতা হিসেবে না দেখে নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করতে পারি, তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা অনেকটাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
এই জায়গায় তরুণ ও যুব সমাজের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিজয় উদযাপনকারী প্রজন্ম হিসেবে তরুণদের কাঁধেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের দায়িত্ব বর্তায়। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা তৈরি, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা, নীতিনির্ধারকদের কাছে জবাবদিহি দাবি করা—এই কাজগুলোতে যুবসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলে সড়কে মৃত্যু কমানো সম্ভব।
বিজয় দিবস আমাদের শুধু অতীত স্মরণ করায় না, ভবিষ্যতের জন্য নতুন করে অঙ্গীকার করতেও শেখায়। এই দিনে আমাদের শপথ হওয়া উচিত—সড়কে আর কোনো প্রাণ ঝরবে না। নিরাপদ সড়ক কোনো বিলাসিতা নয়; এটি একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কঠোর ও ধারাবাহিক আইন প্রয়োগ এবং নাগরিক সচেতনতার সমন্বয় ঘটাতে পারলে সড়কে মৃত্যুহার শূন্যের কাছাকাছি নামানো অসম্ভব নয়।
প্রশ্ন থেকেই যায়—নিরাপদ সড়ক ছাড়া কি বিজয় সত্যিই সম্পূর্ণ? বিজয় দিবস তখনি অর্থবহ হবে যখন আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে পারব, যেখানে মানুষ সড়কে নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে চলাচল করতে পারবে। বিজয়ের চেতনা তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন স্বাধীন দেশের সড়কেও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানে শুধু প্রাণ বাঁচানো নয়, এটি দেশের বিকাশ ও সামাজিক স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি।প্রযুক্তি,পরিকল্পিত অবকাঠামো এবং সচেতন সমাজের মিলিত প্রচেষ্টাই রোডক্র্যাশ কমাতে পারে। শহীদদের ত্যাগকে সার্থক করা যাবে তখনই, যখন আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষ সড়কে নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে চলাচল করতে পারবে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা হল সত্যিকারের বিজয়ের চেতনার প্রতিফলন।
আজ ১৬ই ডিসেম্বর জন্মদিন বাংলাদেশের ! সবাইকে আমাদের মহান বিজয় দিবসের রক্তিম শুভেচ্ছা । এ মহান বিজয়ে সাথে মিশে আছে লাখো শহীদের রক্ত ও আত্মত্যাগ ।এ আত্মত্যাগ আমাদের অনুপ্রেরণা, আমাদের চলার পাথেয়, আমাদের চেতনা ।শহীদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা । উপনিবেশবাদ থেকে মুক্ত করে তোমাদের রক্তের বিনিময়ে তোমরা আমাদের দিয়েছ স্বাধীনতা, কিন্তু আমরা এখনো নব্য উপনিবেশবাদের অন্তর্জালে বন্দী ! তোমরা আমাদের মুক্ত করেছ পাকিস্থানী নামক নরপিশাচদের নিষ্ঠুর যাতাকল থেকে , কিন্তু আমরা এখনো মুক্ত হইনি সাম্রাজ্যবাদের কড়াল থাবা থেকে।
আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে-কি পররাস্ট্র, কি স্বরাস্ট্র সবখানেই সাম্রাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদীদের ভয়াল থাবা ও নগ্ন হস্তক্ষেপ ! তোমরা চুপিসারে দেখে যাও বাংলা মায়ের আজ করুণ আর্তনাদ ! তোমাদের উত্তরসুরি নবপ্রজন্ম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ! এ ব্যর্থতা আমাদের, এ ব্যর্থতা আমাদের রাজনীতিকদের! তোমরা যে পাকিস্থানী জান্তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলে, যুদ্ধ করেছিলে সেই জান্তাও নতুন খোলসে, নতুন পোশাকে, গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে পালাক্রমে ধর্ষণ করে যাচ্ছে তোমাদের চেতনাকে, তোমাদের স্বপ্নকে। তোমরা যে দেশীয় পিশাচদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল সেই পিশাচরাই এখনো নবরুপে নতুন নামে , নতুন পোশাকে সারা বাংলা মায়ের উপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তারা যেমনি নরপিশাচ তেমনি নরখাদক, তারা আগুনে ঝলসে দিচ্ছে, বোমায় ক্ষত-বিক্ষত করছে আমাদের প্রিয় বাংলা মায়ের শরীর !
এর মূল কারণ-তোমরা রক্ত দিয়েছ, কিন্তু তোমাদের রক্তের মূল্য ও আত্মত্যাগ বোঝার সাধ্য এপ্রজন্মেরও নেই ! তাই নব্য উপনিবেশবাদ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে এ বাংলা মাকে, সাথে হিপনোটাইজ করেছে নতুন প্রজন্মকেও। তোমাদের রক্তের শপথ-তোমাদের আত্মত্যাগ কখনো বৃথা যাবে না । কবির কন্ঠের সাথে গাহিতে চাই-আসিতেছে শুভদিন, দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ ।
জয় হোক মানবতার ও মুক্তিকামী মানুষের যারা নব্য উপনিবেশবাদের বলির পাঠা হতে চায় না হলে।
এখন ডিসেম্বর মাস চলছে। বাংলাদেশে ডিসেম্বর মানেই বিজয়ের মাস। কারণ এই মাসের ১৬ তারিখে গোলামী জীবনের অবসানের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশ নামের স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। এই উপলক্ষকে সামনে রেখে প্রতিবছর আমরা মহাসমারোহে ষোলোই ডিসেম্বর ‘বিজয় দিবস’ পালন করে থাকি।
প্রতি বছর ১৬ ডিসম্বরকে কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধভাবে বিজয় দিবস হিসাবে পালন করার নিয়ম দীর্ঘদিন ধরে চলে আসার ফলে বিজয় দিবস এখন আমাদের জাতীয় দিবস।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত