জন্মভূমি ডেস্ক : বিদেশি ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাবরই গতি কম থাকছে। এ নিয়ে নানা সময় আলোচনা হলেও, পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। সম্প্রতি বিদেশি ঋণের প্রকল্প যথাসময়ে শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিদেশি ঋণের প্রকল্পে অর্থ ছাড় দ্রুত করতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।
বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে অর্থায়ন ও নির্মাণের নানা প্রস্তাব নিয়ে কয়েক বছর আগেও চীনের বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ধর্না দিত সরকারি সংস্থাগুলোয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড ট্রেনসহ নানা প্রকল্পে চীনের ঠিকাদারদের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) সইও হয়েছিল। যদিও পরে নানা কারণে এসব প্রকল্প আর এগোয়নি। ছিটকে গেছে চীনের ঠিকাদারদের প্রস্তাবগুলো। তবে সাম্প্রতিককালে চীনের এ প্রবণতা অনেক কমে গেছে।
চীনের ঠিকাদারদের এখন আর সরকারি নানা সংস্থায় নির্মাণ ও অর্থায়নের প্রস্তাব নিয়ে আগের মতো ঘুরতে দেখা যায় না। এমনকি বড় কোনো প্রকল্পে নেই চীনের অর্থায়নের নতুন কোনো প্রস্তাব। গত দুই বছরে কোনো বড় প্রকল্পে নতুন করে অর্থায়ন করেনি চীন। চলমান প্রকল্পগুলোতেও চীনের ঋণছাড় চলছে ধীরগতিতে। ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পাইপলাইনে চীনের অর্থায়নের অংশ কমে আসছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, বর্তমানে চলমান ৯ প্রকল্পে চীনের ঋণ দেয়ার কথা সাত দশমিক ১৩৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে গত জুন পর্যন্ত তিন দশমিক ৬৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড় হয়েছে। অবশিষ্ট রয়েছে তিন দশমিক ৩৫১ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪৮ শতাংশ। তবে গত জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এর থেকে মাত্র ৩৬ মিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে চীন। গত কয়েক বছরের তুলনায় ঋণ ছাড়ের এ হার সবচেয়ে কম।
যদিও ঋণ পুরোটা ছাড় হওয়ার আগেই কর্ণফুলী টানেলের ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হয়েছে। গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ায় উদ্বোধনের আগেই টানেলের ঋণের কিস্তি বাবদ গত অর্থবছর ১৩ দশমিক ৫২৭ মিলিয়ন ডলার শোধ করতে হয়েছে বাংলাদেশ সরকারকে।
ইআরডির তথ্যমতে, বর্তমানে চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ বাকি ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পটিতে। এ প্রকল্পে এক দশমিক ১২৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার কথা। ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর এ-সংক্রান্ত ঋণচুক্তি সই হয়। গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ছাড় হয়েছে মাত্র ১৭০ দশমিক ৫৯৭ মিলিয়ন ডলার। আর অবশিষ্ট রয়েছে ৯৫৬ দশমিক ৩৮৯ মিলিয়ন ডলার। দুই শতাংশ সুদের এ ঋণে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ রয়েছে।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) বিদ্যুৎ বিতরণ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে চীনের ঋণ বাকি রয়েছে ৮৭৩ দশমিক ৯২৫ মিলিয়ন ডলার। এ প্রকল্পে চীনের এক দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার কথা। ২০১৯ সালের ৪ জুলাই এ-সংক্রান্ত ঋণচুক্তি সই হয়। গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ছাড় হয়েছে মাত্র ১৪৭ দশমিক ৮৫ মিলিয়ন ডলার। এ ঋণে তিন শতাংশ সুদের সঙ্গে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ রয়েছে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে চীনের ঋণ বাকি রয়েছে ৬৮৬ দশমিক ৫৭১ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালের ৭ জুন এ-সংক্রান্ত ঋণচুক্তি সই হলেও, এখন পর্যন্ত কোনো অর্থই ছাড় হয়নি প্রকল্পটির বিপরীতে। এ ঋণেও তিন শতাংশ সুদের সঙ্গে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ রয়েছে।
পিজিসিবির আরেকটি প্রকল্পে (পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক) একই দিন চুক্তি সই হয়েছিল। ওই প্রকল্পে ১৯৩ কোটি ইউয়ান ঋণ দেয়ার কথা ছিল চীনের। গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ১৪৬ কোটি ১৯ লাখ ইউয়ান ছাড় করা হয়েছে। অবশিষ্ট রয়েছে ৪৬ কোটি ৮১ লাখ ইউয়ান বা প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা। এ ঋণে দুই শতাংশ সুদের সঙ্গে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ রয়েছে।
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে দুই দশমিক ৬৬৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে চীনের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছিল ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল। এ ঋণে দুই শতাংশ সুদের সঙ্গে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ রয়েছে। গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ছাড় হয়েছে দুই দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। আর মাত্র ৬১৭ দশমিক ৮২৫ মিলিয়ন ডলার ছাড় বাকি রয়েছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন প্রকল্পটিতে ৪৬৭ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে চুক্তি সই হয়েছিল ২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর। এ ঋণেও দুই শতাংশ সুদের সঙ্গে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ রয়েছে। গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ছাড় হয়েছে ৩৫৪ দশমিক ০৩১ মিলিয়ন ডলার। আর মাত্র ১১৩ দশমিক ৮০৯ মিলিয়ন ডলার ছাড় বাকি রয়েছে।
কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পে ৪০৫ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে চুক্তি সই হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর। এ ঋণেও দুই শতাংশ সুদের সঙ্গে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ রয়েছে। গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ছাড় হয়েছে ৩৭৪ দশমিক ২৭১ মিলিয়ন ডলার। আর মাত্র ৩১ দশমিক ৫২৯ মিলিয়ন ডলার ছাড় বাকি রয়েছে।
রাজশাহী ওয়াসার পানি শোধনাগার প্রকল্পে ঋণ দিতে গত বছর ১০ মে চুক্তি হয়। এ প্রকল্পে ২৭৬ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ঋণ দেয়ার কথা চীনের। এর মধ্যে জুন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ৫৫ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার। অবশিষ্ট রয়েছে ২২১ মিলিয়ন ডলার। তবে এ ঋণে দুই শতাংশ সুদের সঙ্গে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ ও শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ অন্যান্য চার্জ রয়েছে। আর বিটিআরসির টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক আধুনিকায়ন প্রকল্পে ১৫৪ কোটি ৭১ লাখ ইউয়ান ঋণ দিতে ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল চুক্তি হয়েছিল। ওই প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ১৪৭ কোটি ৬৬ লাখ ইউয়ান। এ ঋণেও দুই শতাংশ সুদের সঙ্গে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৫ বছর মেয়াদি চীনের ঋণে সাধারণত গ্রেস পিরিয়ড পাঁচ বছর।