
সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়াতে হারিয়ে গেছে পুরনো দিনের ধান-চাল পরিমাপ করার উপকরণ আড়ি, সেরি ও পাইয়ামালা। এইসব উপকরণ দিয়ে পরিমাপ করা হত ধান, চাল, কুড়া, বীজসহ আরো অনেককিছু। একটা সময় গৃহস্থ পরিবারে এসব উপকরণ না থাকলে তাদের বদনাম হতো। এমনকি আত্মীয়স্বজন করার জন্য এক পরিবার অন্য পরিবারের সাথে বিয়ের কথাবার্তা বলাবার সময় খোঁজখবর নিতো এইসব উপকরণ সেই পরিবারে আছে কি না। যেই পরিবারে আড়ি বা সেরি দিয়ে পরিমাপ করে ভাত রান্না করা হতো সেই পরিবারকে প্রাধান্য দিতো।
সেইসময়কার কৃষিকাজ করার জন্য বাজার থেকে কাজের মানুষ (কামলা) নিতো। সেই ক্ষেত্রেও পছন্দের একটি বিষয় থাকতো, তা হলো যেই ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি ভাত খাইতে পারতো তাকেই কামলা হিসেবে পছন্দ করা হতো, কারণ যেই সবচেয়ে বেশি খাবার খাবে সেই ব্যক্তি কাজ সবচেয়ে বেশি করতে পারবে। খাবার কম খাইলে তাদের আর কাজে নিতো না। এখন কেউ শারীরিক পরিশ্রম করতে চায় না, আর কেউ পরিশ্রম করলেও অল্প সময়ের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মানুষের ভাত খাওয়ার অভ্যাসও কমে গেছে। কোনো মানুষ এখন আর পূর্বের মতো তেমন খাবার খাইতে পারে না। অবশ্য এখন মানুষ ভাতের পরিবর্তে চা, নাস্তা ও নানা কিছু খাচ্ছে। আর যেসব জিনিস খাচ্ছে তার অধিকাংশই ভেজাল, পচা ও বাসি যা খাওয়ার অযোগ্য। এসব খাওয়ার খেয়ে মানুষ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে মানুষ সব সময় মৃত্যুর ঝুঁকিতেও থাকে। পাইয়ামালা নারকেলের মালা কেটে তৈরি করা হতো, এটা দিয়ে পরিমাপ করতো চার পোয়াতে এক সের। বেত দিয়ে তৈরি করা হতো সেরি ও আড়ি। আড়ি সেরিতে তৈরি করে অনেক বেত ও বাঁশ শিল্পী জীবিকা নির্বাহ করতেন। মৌসুমে এই আড়ি সেরির কদর ছিল অনেক বেশি। বেত পাওয়া দুষ্কর হওয়ায় এসব জিনিস এখন কেউ তৈরি করে না। আর যারা এসব জিনিস তৈরি করতেন তারাও অনেকে এখন আর বেঁচে নেই।
এখনকার লোকজন এসব জিনিস তৈরিতে তেমন আগ্রহী না, কিংবা এসব জিনিস তৈরির কাজ আর কেউ শিখতেও চাই না। তবে প্রয়োজনের জন্য অনেকে বাঁশ বেতের তৈরি আড়ি সেরির পরিবর্তে টিনের কৌটারকে পরিমাপক হিসেবে ব্যবহার করছে। সেসব পরিমাপকও হারাবার পথে। পুরনো সেই পরিমাপক এখন প্রায় ভুলতে বসেছে। এখন উন্নত প্রযুক্তিতে ডিজিটাল পরিমাপক আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে অতীতের সেই পরিমাপক জিনিসপত্র এখন কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে। যৌথ পরিবারের সংখ্যা গ্রামে একদম নাই বললেই চলে। দিন বদলের কারণে এখন আর বউঝিরা যৌথ পরিবারে থাকতে চায় না।
প্রায় প্রত্যেকেই পৃথক হয়ে ছোট সংসার করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তাই এখন গ্রামে যৌথ গৃহস্থ পরিবারগুলো সম্পত্তি ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। এই ভাগাভাগি করতে গিয়ে সামান্য বিষয়ে ঝগড়াঝাঁটি বাড়ছে। গৃহস্থ বাড়িতে ভাত রান্না করার সময় পরিবারের সদস্যদের সংখ্যানুপাতে পাইয়া মালা দিয়ে চাল পরিমাপ করে দেয়া হতো। শাশুড়িরা পুত্র বধূকে ভাত রান্না করার সময় মটকা থেকে পাইয়া মালা দিয়ে চাল পরিমাপ করে দিত। এখন পাইয়া মালার স্থান দখল করে নিয়েছে টিনের কৌটা। আড়ি ও সেরি এখন উঠে গেছে। এসব জিনিস বাজারেও দেখা যায় না। অবশ্য কোনো কোনো মেলায় এসব জিনিস দেখা গেলেও দাম অত্যন্ত চওড়া। আড়ি, সেরি পরিমাপক নির্মাণের উপকরণ বেত আর বাঁশ পাওয়া গেলেও এসব উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আড়ি সেরির দামও বেশি। আর টিন কেটে এসব জিনিস বিকল্প তৈরি করা যায় বলেও এগুলোর কদর কমে গেছে।তবে ডিজিটাল মেশিনের (ডিজিটাল মিটার) বদৌলতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে যুগ যুগ ধরে ব্যবহার হওয়া সেরি ও আড়ি পরিমাপক পাইয়া মালা।
বর্তমান যুগের সন্তানদের কাছে এ বিষয়গুলো জাদুঘরের গল্প কাহিনী মনে হবে বলে স্থানীয় কয়েকজন মুরুব্বিরা জানান।
একজাতীয় লতানো বা সোজা বেয়ে ওঠা পাম। বেত গাছে শল্কযুক্ত ফল হতে দেখা যায়। এশিয়ার গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের অধিকাংশ বনেই বেত জন্মে। বিষুবীয় আফ্রিকার আর্দ্র অঞ্চল থেকে ভারত, বাংলাদেশ, দক্ষিণ চীন, ফিজি পর্যন্ত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত এ বনগুলি ছড়িয়ে আছে। মালয়েশীয় ভাষায় বেতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপগোত্রের নাম রতন (rattan) এবং বাংলাদেশেও অনেক এলাকায় তা রতন নামেই পরিচিত।
বেতের তৈরি সামগ্রী
বেত বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য বনজ সম্পদ। অনেকে বসতভিটার আশপাশেও বেত লাগায়। আসবাবপত্র তৈরি ও অন্যান্য কুটির শিল্পএ বেত ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলা থেকে বেত রপ্তানি হয়েছে। বেত ফল খাওয়া যায়। বিশ্বে ১৩টি গণের প্রায় ৬০০ প্রজাতির বেত রয়েছে। বাংলাদেশে আছে বেতের মাত্র ২টি গণ, Calamus এবং Daemonorops। শেষোক্ত গণের আছে একটি প্রজাতি D. jenkinsianus (গোলাব বেত বা গোল্লা বেত)। Calamus গণের ১০ প্রজাতির মধ্যে আছে: C. erectus (কদম বেত), C. flagellum, C. floribundus, C. guruba (জালি বেত), C. gracilis, C. latifolius (কোরাক বেত), C. longisetus (উদম বেত), C. tenuis (সাঁচি বেত), C. viminalis var. fasciculatus (বড় বেত), C. quinquenervius। সর্বমোট ১১ প্রজাতির মধ্যে C. flagellum, C. floribundus, C. gracilis, C. quinquenverius এখন আর সহজলভ্য নয়। এগুলি খুব কমে গেছে কিংবা তাদের উৎপাদন একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে। বেত সাধারণত চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পার্বত্য-চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ে জন্মায়। শালবনে বেত দুষ্প্রাপ্য, দৈবাৎ বনপ্রান্তে C. viminalis var. fasciculatus দেখা যায়। ম্যানগ্রোভ বনেও একই পরিস্থিতি, অপেক্ষাকৃত শুষ্ক অঞ্চলে C. tenuis জন্মে।
অঙ্গজ ও বীজ উভয় ধরনে বেতের বংশবিস্তার ঘটানো যায়। অঙ্গজ চাষে ঊর্ধ্বধাবক ব্যবহূত হয়। বীজ চাষে বীজতলায় চারা প্রস্ত্তত করে পরে অন্যত্র রোপণ করা হয়। বীজের শাঁস ফেলে দিয়ে বীজতলার বীজ বপন করলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই চারা গজায়। এসব চারা ০.৭৫-১ মিটার উঁচু হলে স্থানান্তর করতে হয়। ২-৩ বছরে বেত বড় ঝাড় হয়ে ওঠে, ৭-৮ বছরে তা কাটা যায়। চাষে বেশি যত্ন লাগে না। লাগানোর পর কিছুদিন প্রয়োজনবোধে সেচ ও সার দেওয়া যেতে পারে।
বেতশিল্প বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যময় কুটির শিল্প। গৃহস্থালিতে বেতের ব্যবহার বহুবিধ। গৃহ নির্মাণে যেমন বেতের প্রয়োজন, তেমনি শৌখিন সজ্জাতেও বেতের কদর রয়েছে। দেশের কোন কোন এলাকায় মহিলারা বেতের কাজে পুরুষদের চেয়ে বেশি দক্ষ। অনেক এলাকাতেই নারী-পুরুষ সবার জন্য বেতের আসবাবপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরি রোজগারের একটি ভাল উপায়।
ভিন্ন ভিন্ন কাজে ভিন্ন ধরনের বেত ব্যবহূত হয়। বেতশিল্পে সাধারণত জালি ও গোল্লা বেত ব্যবহার করা হয়। প্রধানত বুনন ও বাঁধানোর কাজে বেত ব্যবহূত হয়। নকশার ধরন বুঝে সরু ও মোটা বেতের বিভিন্ন ধরনের অংশ তুলে নিতে হয়। জালি বেত দিয়ে চেয়ার, টেবিল, দোলনা, বাস্কেট, মহিলাদের ব্যাগ ও বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী তৈরি হয়। গোল্লা বেত ব্যবহার হয় নিত্য ব্যবহার্য আসবাবপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরির কাঠামোতে। কাজের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে গোল্লা বেতকে লম্বালম্বিভাবে কয়েক টুকরায় কাটতে হয়।
সাধারণত ২/৩ বছর বয়সের ভাল আকৃতির বেত উন্নতমানের কাজে ব্যবহূত হয়। মাঝারি পাকা বেতের মধ্যে জলীয় পদার্থ কম ও কাজ করার সময় আঠালোভাব বেশি থাকে। বেশি পাকা বেত কাজ করার সময় ভেঙে যায়, কমবয়সী বেতের দ্রব্যাদি ফেটে ও কুঁচকে যায়, ঘুণে ধরে এবং তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়। বাংলাদেশে বেতকে প্রক্রিয়াজাত করা না হলে অল্পদিনেই তা বিবর্ণ হয়ে যায়। ঘুণে ধরা অথবা ছাতা পড়ার সম্ভাবনা থাকে। রঞ্জন সম্বন্ধে অজ্ঞতার কারণে উৎপাদিত বেতসামগ্রী নিম্নমানের হয়ে থাকে। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ রঞ্জন প্রক্রিয়ার মানের ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) একটি নকশা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এই কেন্দ্রের শিল্পীরা বেতের শিল্পকর্মে নতুন নকশা ও নমুনা উদ্ভাবন করার গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন। এই শিল্পে নিয়োজিত কারুশিল্পীদের সহায়তা করার জন্য নকশা কেন্দ্র বিনামূল্যে তাদের মধ্যে নতুন উদ্ভাবিত নকশা বা নমুনা বিতরণ করে থাকে।
বিসিকই প্রথম কারুশিল্পের ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবন করার লক্ষ্যে কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই কর্মসূচির আওতায় বিসিক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কারুপল্লী খুঁজে বের করেছে এবং কারুশিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ, বিপণন ব্যবস্থা, উৎপাদন উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, যথাযথ প্রযুক্তি এবং পণ্যের গুণগত মান উন্নয়নে সহায়তা প্রদান করছে। বিসিকের সূত্রমতে, ২৯টি নির্বাচিত কারুপণ্যের সর্বমোট ৪,২২৬টি কারুপল্লীর মধ্যে বাঁশ ও বেতের জিনিসের কারুপল্লীর সংখ্যা ১,১৫৪টি। এটি কারুপণ্যের সর্ববৃহৎ উপখাত। ২০০০ সালে এতে প্রায় ১,৩৫,০০০ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
সারা বিশ্বে, বিশেষত এশিয়া ও ইউরোপে বেতের তৈরি সামগ্রীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ বেতের তৈরি বিভিন্ন ধরনের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সামগ্রী রাশিয়া, জার্মানি, সিঙ্গাপুর এবং মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি করে থাকে। জার্মানি, কানাডা, জাপান ও অন্যান্য দেশে অনুষ্ঠিত বেশ কতগুলি আন্তর্জাতিক কারুশিল্প মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বেতশিল্পে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে। ১৯৯৯-২০০০ সালে বাংলাদেশ বেত ও বাঁশজাত পণ্য রপ্তানি করে ২৫ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা অর্জন করেছে।
কাঠ ও বাঁশের পরই বেত বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বনজ সম্পদ। তবে এর উৎপাদন ক্রমাগত কমে আসছে। বাংলাদেশ ১৯৮৫-৮৬ সালে ৩৯,৩৮,০০০ ফুট এবং ১৯৯৩-৯৪ সালে ২৯,৩৮,০০০ ফুট বেত উৎপাদন করেছে। সম্প্রতি বনবিভাগ প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম বনে বেত চাষ শুরু করেছে। [এম.কে আলম]
এই পাতা শেষ সম্পাদিত হয়েছে ০৭:১০টার সময়, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে।