জন্মভূমি ডেস্ক : বাজারে গত দুইমাস ধরে আলুর দাম চড়া। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি পুরাতন আলুর দাম ৭০ থেকে ৭৫ কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর খুচরা বাজারে নতুন আলু দাম ১২০ থেকে ১৩০ টাকা।
আলুর দাম এত বৃদ্ধির কারণ খুঁজছেন ক্রেতারা। বিক্রেতাদের জানান, বেশি দামে কিনে এনে তো, কম দামে বিক্রি করতে পারব না। পাইকারি বাজারে আলুর দাম বাড়লে, খুচরা বাজারেও বাড়বে। না হয় আলু বিক্রিই বন্ধ করতে হবে। কিন্তু পাইকারি বাজারে কেন বেশি দাম- এ বিষয় সম্পের্কে জানা নেই খুচরাবিক্রেতা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আলু চাষিদের ওপর দাদন প্রথার থাবা, বাজারকাঠামোতে কোল্ড স্টোরেজভিত্তিক মধ্যসত্ত্বভোগী চক্রের প্রভাব আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে যাচ্ছে।
মিরপুরে-১৪ নম্বর নেভি গেট কাঁচাবাজারে আলুর কেজি ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বর্তমানে। এতো দামের পরও গোমড়া মুখে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। কারণ, বাঙালির পাতে আলু চাই।
সরেজমিনের খোঁজ নেওয়া হয় আলুর পাইকারি বাজার মিরপুর-১১ ও মিরপুর-১৪ এর কচুক্ষেতে। মিরপুরের পাইকারি বাজারে পুরাতন আলু বিক্রি হচ্ছে ৬৩ টাকায়। আলু বাড়তি দামেই বেশ কিছুদিন ধরে বিক্রি হচ্ছে জানালেন পাইকার ও আড়ৎদাররা।
পাইকারি আলু বিক্রেতা ইসমাইল বাণিজ্যালয়ের রাজিব আহমেদ জানান, বিক্রমপুরের আলুর দাম বৃদ্ধির ফলে আমাদের এখানেও আলুর দাম বেড়েছে। আমরা কেজি প্রতি খুব কম লাভ করি। বাজারে সবজির দাম বাড়ার সঙ্গে আলুর দাম বেড়েছে। সবজির দাম বাড়ার সঙ্গে আলুর দাম বাড়ার সম্পর্ক কী? এ প্রশ্নের জবাবে মেলেনি বিক্রেতাদের থেকে।
আলুর দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনা ত্রুটি কাজ করছে বলে মনে করেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজির হোসেন। তিনি ক্যাবের পর্যালোচনার উল্লেখ করে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, আলু সংরক্ষণে কোল্ডস্টোরেজের একচ্ছত্র আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের কারণে দাম বৃদ্ধি পায়। কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে সাত থেকে আটটি স্তর থাকার কারণে ধাপে ধাপে আলুর দাম বৃদ্ধি পায়।
ক্যাবের অনুসন্ধান তুলে ধরে নাজির হোসেন বলেন, কোল্ডস্টোরেজের মালিকরা উৎপাদন পর্যায়ে তাদের নিজস্ব ব্যাপারীদের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে দাদন দিয়ে থাকে। দাদন বণ্টন ও নিয়ন্ত্রণের কাজটি করে থাকে আলু উৎপাদন এলাকার এজেন্ট। ক্ষেত থেকে আলু ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এজেন্টরা পূর্ব নির্ধারিত দামে মাঠ থেকে সংগ্রহ করে ব্যাপারীদের মাধ্যমে কোল্ডস্টোরেজে নেয়। যত দিন কৃষকের কাছে আলু থাকে ততদিন আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর তারপরই আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় কোল্ডস্টোরেজ-ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।
এখন যে আলু কারওয়ান বাজারে আসছে- তা ট্রাক থেকে নামার পর দুইটি স্তর পেরিয়ে খুঁচরা পর্যায়ে ক্রেতাদের কাছে যায়। মূলত রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি বাজারগুলো কারওয়ানবাজারসহ দুটি বাজার থেকেই নিয়ন্ত্রণ হয়। যা থাকে কোল্ডস্টোরেজের নিয়ন্ত্রণে; তিনি উল্লেখ করেন।
আলুর দাম প্রতিবারই নভেম্বর মাসের দিকে সর্বোচ্চ আকার ধারণ করে। অজুহাত তোলা হয় আলুর মজুদ কমে আসা। এ সময় আলু আমদানিও করা হয়, এবারও করা হচ্ছে। অথচ দেশে চাহিদার তুলনায় কমপক্ষে ২০ লাখ বেশি আলুর উৎপাদন হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে আলু বার্ষিক চাহিদা সর্বোচ্চ ৮০ লাখ টন। অথচ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আলুর উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি টনের উপরে। ৩০ লাখ টন বেশি আলু বেশি উৎপাদন হয়েছে। তারপরও আলু ঘাটতির অজুহাত তুলে দাম বাড়ানো হয়।
মূলত আলু বাজার কাঠামো ত্রুটিযুক্ত হওয়া কারণে চাহিদার বেশি আলু উৎপাদন হলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আলুর দাম বাড়ানো হচ্ছে।
আলুর দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে টিসিবির খোলা ট্রাকে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজের পাশাপাশি ৩০ টাকা দরে আলু বিক্রি শুরু করেছে। রাজধানীর ৫০টি স্পটে আলু বিক্রি হচ্ছে। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত টিসিবির ট্রাকে এ সব পণ্য বিক্রি হবে।
গত ২০ নভেম্বর রাজধানীর কারওয়ানবাজারে আলু বিক্রির এ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বসির উদ্দিন। আলুর বাড়তি দামের মূলে সিন্ডিকেট রয়েছে স্বীকার করেন তিনি। বলেন, সরবারহ ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদারের মাধ্যমে আমরা সিন্ডিকেট অকার্যকর।
তিনি ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কোল্ডস্টোরেজসহ বাজার ব্যবস্থার পর্যবেক্ষণ ও উন্নয়নের তাগিদ দেন। আলু উৎপাদন করার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়
আলু উৎপাদন করেও কৃষক কোল্ডস্টোরে রাখতে পারেন না। রাজশাহী ও বগুড়ার কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। কোথাও কোথাও আগাম দাদন বা টাকা নিয়ে কৃষক আলু চাষ করেন। আলু মাঠে থেকে ওঠানোর সাথে সাথে আগে টাকা নেওয়ায় মহাজনের কাছে বিক্রি করে দিতে হয়। বাজারে আলুর বাড়তি দাম থাকলেও কৃষক তা দাবি করতে পারেন না। পূর্বনির্ধারিত দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন তারা।
এ বিষয়ে বগুড়ার কৃষক মো. আব্দুল হাফিজ বলেন, আলু ওঠানোর পর কোল্ডস্টোরে রাখার মতো সামর্থ আমাদের নেই। ধার-দেনা করে বা হাতের কিছু বাড়তি টাকা খরচ করে আলু চাষ করি। আলু ওঠানোর সাথে সাথে বিক্রি করে দেই। একই কথা জানালেন, রাজশাহীর বাগমারার কৃষক রুহুল আমিন।
আলু উৎপাদন, উৎপাদন খরচের সঙ্গে যুক্ত থাকে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে মতে গত বছরে প্রতি কেজি আলু উৎপাদনের খরচ ছিল ১০ টাকা ৫১ পয়সা। এসব আলু অধিকাংশ মাঠ থেকে কৃষকরা ২০ থেকে ২১ টাকা কেজি দরে মহজনদের কাছে বিক্রি করে দেন। অথচ সেই আলু রাজধানীর বাজারে বিক্রি হয় ৭০ টাকা কেজি দরে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা অবিশ্বাস্য। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।