
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : জলবায়ু পরিবর্তন ও চরম ইভেন্টের কারণে দেশের মোট আবাদি জমি শতকরা ৬ দশমিক ৫ এবং দক্ষিণাঞ্চলে শতকরা ১৮শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রে আমার প্রিয় দেশ। ভৌগোলিক অবস্থান, নিম্ন উচ্চতা এবং বিশ্বের বৃহত্তম সক্রিয় ব- দ্বীপের অংশ হওয়ায়, বাংলাদেশ জলবায়ু সংকটের ‘ফ্রন্টলাইন’ হিসেবে চিহ্নিত। আর এই সংকটের সবচেয়ে ভয়াবহ চেহারা ফুটে উঠেছে দেশের বিস্তৃত উপকূলীয় অঞ্চলে। এই সাতশত ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রেখাটি কেবল একটি মানচিত্রের রেখা নয়; এটি প্রায় ৪ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি এবং অস্তিত্বের প্রতীক।
জলবায়ু ঝুঁকির তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য যারা সবচেয়ে কম দায়ী, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এক্ষেত্রে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এখানকার জলবায়ু ঝুঁকির চিত্রটি কয়েকটি কঠিন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে আরও স্পষ্ট অনুধাবন সম্ভব।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দ্রুত বাড়ছে। জরিপে দেখা গেছে, এটি বছরে প্রায় ৩ দশমিক ৮ থেকে ৫ দশমিক ৮ মিমি পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইপিসিসি মতে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে, ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় শতকরা ১৭ হারে নিম্ন এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে, যার ফলে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। এক মিটার উচ্চতা বাড়লে দেশের শতকরা প্রায় ১৮ হারে ভূমি বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে নীরব কিন্তু মারাত্মক প্রভাব হলো লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং শুষ্ক মৌসুমে মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় লোনা পানি ক্রমাগত ভূ-ভাগের ভেতরে প্রবেশ করছে। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে (খুলনা-সাতক্ষীরা) ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে লবণাক্ততার রেখা (৫ পিপিটি আইসোলিন) প্রায় ২৪ কিমি অভ্যন্তরে সরে যেতে পারে। এর ফলে দেশের প্রায় ৮ দশমিক ৩০ লাখ হেক্টর আবাদি জমি এখন লবণাক্ততার বিভিন্ন মাত্রায় আক্রান্ত।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনত্বে গত কয়েক দশকে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং বন্যার মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলো ঘন ঘন আঘাত হানছে। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে ভোলা ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে সিডর (২০০৭), আইলা (২০০৯), ফনি, আম্ফান এবং সাম্প্রতিক কালের ঘূর্ণিঝড়গুলো উপকূলের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে। দুর্বল বেড়িবাঁধগুলো সহজেই ভেঙে গিয়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে।
জীবন-জীবিকা ও পরিবেশের ওপর বহুমুখী প্রভাবে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে লবণাক্ততা উপকূলের কৃষি ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দিচ্ছে। ধান, যা এখানকার মানুষের প্রধান খাদ্য, তার উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লবণসহিষ্ণুতার মাত্রা ১৫ থেকে ২০ পিপিটি হলেও, অনেক এলাকায় এই মাত্রা আরও বেশি। এর ফলে কৃষকরা বাধ্য হচ্ছেন ধান চাষ ছেড়ে চিংড়ি চাষের দিকে ঝুঁকতে, যা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হলেও দীর্ঘমেয়াদে মাটি ও পানির লবণাক্ততাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং কৃষিজমিকে চিরতরে অনুর্বর করে তুলছে।
সুপেয় পানির তীব্র সংকট, লবণাক্ততা ভূগর্ভস্থ এবং ভূপৃষ্ঠের উভয় ধরনের পানিকে বিষাক্ত করে তুলেছে। সুপেয় পানির জন্য উপকূলের বিশেষত নারীদের দৈনিক মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এখানকার মানুষ ঢাকা শহরের তুলনায় ৪০ গুণেরও বেশি দামে খাবার পানি কেনে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং পুকুরে বা রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং-এর অভাব এই সংকটকে আরও তীব্র করছে। সুপেয় পানির অভাবে উপকূলের মানুষের মধ্যে ত্বক ও পানিবাহিত রোগ, বিশেষ করে নারীদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা বাড়ছে।
জলবায়ু উদ্বাস্তু ও সামাজিক অস্থিরতা, ঘরবাড়ি হারানো, ফসল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়ায় উপকূলীয় মানুষজন বাধ্য হয়ে ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’তে পরিণত হচ্ছে। তারা জীবিকার সন্ধানে ঢাকা, চট্টগ্রাম বা অন্যান্য শহরে পাড়ি জমাচ্ছেন। আইপিসিসি অনুমান করে যে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৫ লাখ মানুষ ইতোমধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই বাস্তুচ্যুতি কেবল অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি সামাজিক সংহতি নষ্ট করছে, শহরে বস্তির চাপ বাড়াচ্ছে এবং উপকূলীয় সমাজে বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা ও নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি করছে।
এত বড় একটি জাতীয় সংকট মোকাবিলায় সুরক্ষা ও অভিযোজনের দায়িত্ব কোনো একক পক্ষের হতে পারে না। এটি একটি সম্মিলিত, বহুমুখী প্রচেষ্টার দাবি রাখে । কে কী করছে এবং কার কী করা উচিত, সে সবের হিসাব নিকাশ প্রত্যাশা করে।
রাষ্ট্রের নিজস্ব সক্ষমতা ও উদ্যোগ: দেশের জলবায়ুর পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজস্ব অর্থায়নে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। এটি বিশ্বের অন্যতম নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত অভিযোজন উদ্যোগ। এছাড়া, জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই কৌশলকে আরও শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। তবে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ, নদী শাসন ও ম্যানগ্রোভ বনায়ন কর্মসূচিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো, বিশেষত শক্তিশালী বেড়িবাঁধ নির্মাণে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও স্বচ্ছতার প্রয়োজ।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ন্যায়সঙ্গত দায়িত্ব, জলবায়ু পরিবর্তনের মূল হোতা উন্নত দেশগুলোকেই তাদের ঐতিহাসিক দায় স্বীকার করতে হবে। প্যারিস চুক্তি এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ সব সময়ই জলবায়ু ন্যায়বিচারের দাবি তুলে ধরেছে। উন্নত দেশগুলোর উচিত দ্রুত কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে অভিযোজন ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নিশ্চিত করা। ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ কমে যাওয়ার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তার ক্ষতিপূরণ বা সহায়তার দাবি আন্তর্জাতিক মহলে আরও জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
স্থানীয় জ্ঞান ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের সমন্বয়, এই সংকটের মোকাবিলায় স্থানীয় জনগণের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানকে গুরুত্ব দিতে হবে। উপকূলের মানুষ যুগ যুগ ধরে লবণাক্ততা ও দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে আসছে। লবণসহিষ্ণু ফসল, ভাসমান কৃষি এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মতো স্থানীয় অভিযোজন কৌশলগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে সমন্বয় করে মূলধারার উন্নয়ন পরিকল্পনায় যুক্ত করতে হবে।
সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো বাংলাদেশের জলবায়ুগত পরিবর্তনের গতিপথ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে:
গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে গত ৪৪ বছরে গড় তাপমাত্রা প্রায় শূন্য দশমিক ০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, যেখানে পূর্বাঞ্চলে এই বৃদ্ধি শূন্য দশমিক ০৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। ২০৩৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে দেশের গড় তাপমাত্রা ২৬ দশমিক ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২১০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ২৮ দশমিক ৮৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এ পৌঁছাতে পারে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এই দ্রুত তাপমাত্রা বৃদ্ধি গ্রীষ্মকালের দৈর্ঘ্য বাড়াচ্ছে এবং বর্ষাকালেও তাপপ্রবাহ দেখা দিচ্ছে।
বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তনে, জাতীয় অভিযোজন থেকে জানা যায় শীতকাল ও বর্ষা পূর্ববর্তী সময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে। পক্ষান্তরে, বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী সময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়ছে, যা অসময়ের বন্যা ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১০ থেকে ১৫ এবং ২০৭৫ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ তা প্রায় ২৭ শতাংশে বেড়ে যেতে পারে। আর্দ্রতার মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা তাপমাত্রার তুলনায়ও বেশি গরম অনুভূতি তৈরি করছে।
দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষি। জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাতে এই খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে: জিডিপি এবং উৎপাদন হ্রাস: গবেষণায় আশঙ্কা করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে দেশের কৃষি জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেতে পারে। কৃষিতে মিঠাপানির অভাব এবং লবণাক্ততার কারণে ধানের উৎপাদন বছরে ৩ দশমিক ৯ পর্যন্ত কমতে পারে, যা ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সম্মিলিতভাবে ৮ কোটি টন পর্যন্ত উৎপাদন ক্ষতির কারণ হতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও চরম ইভেন্টের কারণে দেশের মোট আবাদি জমি শতকরা ৬ দশমিক ৫ এবং দক্ষিণাঞ্চলে শতকরা ১৮শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। কৃষকরা লবণাক্ততা সহনশীল ধান বা অন্যান্য শস্যের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে লবনাক্ততার অতিমাত্রার কারণে কৃষক ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনের ফলে নতুন নতুন কীটপতঙ্গ ও উদ্ভিদ রোগের আবির্ভাব ঘটছে, যা ফসলের উৎপাদনে আরও অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসল (যেমন- গম, বার্লি) উদ্ভাবন এবং সেগুলোর বাণিজ্যিকিকরণের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
জলবায়ু পরিবর্তন কেবল পরিবেশের ওপর নয়, সরাসরি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর, পানিবাহিত রোগ বৃদ্ধি, উপকূলীয় অঞ্চলে পানিবাহিত, জল-সম্পর্কিত এবং জল-বাহিত রোগগুলো দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় শতকরা ১৪ শতাংশ বেশি বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। দূষিত ভূগর্ভস্থ পানি গর্ভবতী মহিলাদের উচ্চ রক্তচাপ, সময়ের আগে প্রসব এবং শিশুদের তীব্র শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত রোগের সাথে সম্পর্কিত।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের একটি গবেষণা অনুসারে, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া বা অনিয়মিত হওয়ার ফলে যে এলাকাগুলোর কৃষক পরিবারগুলোর আয় কমেছে, সেখানে গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ কমেছে। এর ফলে গর্ভে থাকা শিশুরা দুর্বল ও অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো মশা-বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ও বিস্তার বেড়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থনৈতিক মূল্য আমাদের জন্য অত্যন্ত চড়া, সামগ্রিক অর্থনৈতিক ক্ষতি: ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের জিডিপি-এর শতকরা ২ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কৃষি জিডিপি-তে সম্মিলিতভাবে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে পারে।
বাস্তুচ্যুতি ও নগরায়ণ: প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এই অভ্যন্তরীণ অভিবাসন গ্রামীণ সম্পদ হ্রাস এবং শহর অঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বস্তি ও অবকাঠামোতে চরম চাপ সৃষ্টি করছে।
এই গবেষণাগুলো স্পষ্ট করে যে, জলবায়ু পরিবর্তন দেশের জন্য একটি আসন্ন হুমকি নয় বরং এটি একটি অবধারিত সংকট। এই তথ্যগুলো নীতি-নির্ধারক, আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী এবং স্থানীয় পর্যায়ের নীতিতে সন্নিবেশিত করে অতিসত্তর পরিকল্পনা প্রয়োজন।
উপকূলীয় এলাকা আজ অস্তিত্বের এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। এই লড়াই শুধু বেড়িবাঁধ বা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের নয়, এটি জীবনধারণের মৌলিক উপাদান সুপেয় পানি, উর্বর মাটি এবং নিরাপদ বাসস্থানের জন্য এক কঠিন সংগ্রাম।
এই পরিস্থিতিতে সুরক্ষার দায়িত্ব কেবল সরকারের নয়, এটি উন্নত বিশ্বের, যারা জলবায়ু সংকট তৈরি করেছে, বেসরকারি সংস্থা, যারা স্থানীয়ভাবে কাজ করছে; এবং প্রতিটি নাগরিকের, যারা সচেতন জীবনযাত্রার মাধ্যমে পরিবেশের ওপর চাপ কমাতে পারে। সম্মিলিত সংহতি, ন্যায়সঙ্গত আন্তর্জাতিক অর্থায়ন এবং বিজ্ঞান-ভিত্তিক অভিযোজন কৌশলের মাধ্যমেই কেবল এই ‘ব’ দ্বীপের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকাকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করা আমাদের জন্য কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়, এটি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও টিকে থাকার প্রশ্ন। এই সত্যকে উপলব্ধি করে, যার যার অবস্থান থেকে এখনই সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোর প্রায় ৫৩ শতাংশ অঞ্চলে বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা রয়েছে। লবণাক্ততার প্রভাব কৃষি, মৎস্য, গবাদিপশু, মানবস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে দৃশ্যমান।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোর প্রায় ৫৩ শতাংশ অঞ্চলে বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা রয়েছে। লবণাক্ততার প্রভাব কৃষি, মৎস্য, গবাদিপশু, মানবস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে দৃশ্যমান। এর মধ্যে কৃষি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং ধান সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ফসল। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবিকায় বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উৎপাদন কমে যাচ্ছে। উৎপাদিত ফসলেও থাকছে নানা ত্রুটি। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর কৃষিজমিতে লবণের স্বাভাবিক মাত্রা ধরা হয় ৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি অব স্যালিনিটি (ডিএস)। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক গবেষণায়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার কৃষিজমিতে ২৫ ডিএস মাত্রায় লবণের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এ ধরনের তথ্য রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে বিশেষজ্ঞদের। ২০২২ সালেও এসব এলাকায় লবণাক্ততার মাত্রা ছিল মাত্র ৪ দশমিক ১ ডিএস। সে হিসাবে গত তিন বছরে লবণাক্ততা বেড়েছে ছয় গুণের বেশি। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এর প্রভাবে কৃষি ফলন কমে গিয়ে জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। এত দ্রুত কীভাবে লবণাক্ততা বেড়েছে তা খতিয়ে দেখতে সে বিষয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন।
এ অঞ্চলে লবণাক্ততা বিভিন্ন মাত্রায় উপস্থিতির কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি হলো—সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষ এবং উজান থেকে সীমান্তবর্তী নদীগুলোর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, খুলনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও সাতক্ষীরা জেলায় ফসল উৎপাদন ও জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষকরা বর্তমানে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। শুষ্ক মৌসুমে তারা জমি পতিত রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে (অক্টোবর-মে পর্যন্ত) খরার মৌসুমে নদীর লবণাক্ততায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে, যা পানীয় ও সেচযোগ্য পানির ঘাটতি তৈরি করবে এবং জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটাবে। নদীর লবণাক্ততা ও মিঠা পানির প্রাপ্যতার পরিবর্তন মাছ চাষের উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করবে। এতে মিঠা পানির মাছ ও চিংড়ির প্রাকৃতিক আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাশাপাশি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে প্রধান ও সর্বাধিক বাজারমূল্যের ‘সুন্দরী’ গাছের পরিবর্তে ‘গেওয়া’ ও ‘গরান’ গাছের আধিক্য দেখা দিতে পারে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় মাটির লবণাক্ততা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। ২০৫০ সালের মধ্যে গড়পড়তা লবণাক্ততা ২৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় এ বৃদ্ধি ৫৫ শতাংশেরও বেশি হতে পারে। তবে লবণাক্ততার প্রভাব মোকাবেলায় স্থানীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যেসব কৌশল বিদ্যমান রয়েছে সেগুলো পর্যাপ্ত নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে এমন কিছু অভিযোজনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে এ অঞ্চলের মানুষের উপকারে আসে।
এছাড়া বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০০৩ সাল থেকে লবণাক্ততা সহনশীল বেশ কয়েক জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে। যাতে সেসব এলাকায় এ জাতগুলো চাষ করা যায়। কারণ প্রচলিত জাতগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভালো ফলন দিতে পারে না। যদিও নতুন উদ্ভাবিত এসব জাত কৃষকদের মধ্যে তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। একটি নতুন জাত মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা করে বিস্তৃত করতে চার-পাঁচ বছর সময় লাগে, যার মধ্যে লবণাক্ততা আরো বেড়ে গিয়ে সেই জাতটি অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়। ফলে দেশের বহু আবাদযোগ্য জমি অনাবাদি বা পতিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) তথ্যমতে, দেশের আবাদযোগ্য জমির ৩০ শতাংশের বেশি উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত। ১৯৭৩-২০০৯ সাল পর্যন্ত একটি তুলনামূলক গবেষণায় দেখা গেছে, ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর উপকূল ও চরাঞ্চলের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততা রয়েছে।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, মৎস্য অধিদপ্তর, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যানের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট আবাদযোগ্য জমির মধ্যে প্রায় ২০ লাখ হেক্টর (৪৯ লাখ একর) লবণাক্ততা, খরা ও জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে রয়েছে। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে বার্ষিক গড় তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, যা সরাসরি দেশের প্রধান ফসল যেমন ধান ও গমের উৎপাদনে প্রভাব ফেলেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফসলের উৎপাদন হ্রাসের ঝুঁকি বাড়ছে। কারণ এতে কীটপতঙ্গের আক্রমণ বাড়ছে।
লবণাক্ততা বাড়ার কারণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে। লবণাক্ত পানি পান করায় উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। যেমন উচ্চ রক্তচাপ, খিঁচুনি, কলেরা, অকাল গর্ভপাত, বিকলাঙ্গ সন্তান জন্মদান, অপুষ্টি ইত্যাদি। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েই চলেছে। আইসিডিডিআর,বি গবেষকরা তাদের পর্যবেক্ষণাধীন এলাকায় ১২ হাজার ৮৬৭টি গর্ভধারণের তথ্য নথিভুক্ত করেছেন। তারা প্রতিটি গর্ভবতী নারীকে সন্তান প্রসব পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেন এবং দেখতে পান, যারা উপকূলীয় সমতলে, সমুদ্রতট থেকে ২০ কিলোমিটারের মধ্যে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাত মিটার উচ্চতায় বসবাস করেন, তারা অভ্যন্তরীণ অঞ্চলের নারীদের তুলনায় গর্ভপাতের ঝুঁকিতে ১ দশমিক ৩ গুণ বেশি থাকেন। তারা মনে করছেন, এ পার্থক্যের মূল কারণ হলো নারীরা যে পানি পান করেন, তাতে অতিরিক্ত লবণের উপস্থিতি।
লবণাক্ততার কারণে দেশের সামগ্রিক খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু ও জলজ প্রাণীর ওপরই কেবল প্রভাব পড়ছে না বরং মানুষের কর্মসংস্থানও কমছে। গ্রীষ্ম মৌসুমে কৃষিকাজ, যেমন ধান চাষ ও ঘেরভিত্তিক চিংড়ি চাষ কমে যাওয়ায় নারী-পুরুষ উভয়েরই কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। অনেক পুরুষ গ্রাম ছেড়ে নগর বা অন্যান্য গ্রামীণ কৃষিসমৃদ্ধ অঞ্চলে কাজের সন্ধানে চলে যাচ্ছেন। নারীরা কৃষি-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। যেসব পরিবার চিংড়ি চাষে সফল হয়েছেন তারাও খাদ্যনিরাপত্তায় ভুগছেন। কারণ লবণপানির ঘের চাষের কারণে যেসব জমিতে আগে গাছপালা, ফলমূল হতো এখন আর কিছুই হয় না।
লবণাক্ত পরিবেশে চাষাবাদ অভিযোজনে বিভিন্ন কৌশলের কথা উঠে এসেছে। যেমন উন্নত সেচব্যবস্থা, সার ব্যবহার, জমি উঁচু করা, উঁচু বেডে চাষ, খাড়াভাবে উদ্যানচাষ (ভার্টিক্যাল হর্টিকালচার) ও লবণাক্ত সহনশীল গাছপালা। এসবের মধ্যে স্থানীয় কৃষকরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন মিঠা পানির সেচ ব্যবস্থাকে। এ সেচ ব্যবস্থা তাদের চাষাবাদের জন্য অপরিহার্য। মিঠা পানির সহজলভ্যতা থাকলে ফসল উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু তা না থাকলে অন্য কোনো কৌশলই কার্যকর নয় বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
তাই মিঠা পানির উৎস ও প্রবাহ বাড়াতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। খাল, নদী বা পুকুর খনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে হবে। মিঠা পানি সংরক্ষণ করে প্রতিটি বাড়ি ও কৃষিজমিতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি লবণাক্ত জলাধার থেকে অন্য কোথাও যাতে পানি প্রবেশ করতে না পারে সেই ব্যবস্থাও করতে হবে। স্থায়ীভাবে মিঠা পানির সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে লবণপানির ঘের সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে।
লবণ সহনশীল গাছপালা, বিশেষ করে ধান ও গমের জাত এবং বেগুন, টমেটো, কুমড়োর মতো সবজির জাত নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা এগুলোকে সম্ভাবনাময় মনে করলেও ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার সঙ্গে প্রযুক্তি কতটা তাল মিলিয়ে চলতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ভবিষ্যতের জন্য আরো সহনশীল জাত প্রয়োজন। আরো একটি চ্যালেঞ্জ হলো একটি নতুন জাত মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা করে বিস্তৃত করতে চার-পাঁচ বছর সময় লাগে, যার মধ্যে লবণাক্ততা আরো বেড়ে গিয়ে সেই জাতটি অকার্যকর হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে কার্যকর ও প্রয়োজনীয় অভিযোজন কৌশল হতে পারে মিঠার পানির সেচ ব্যবস্থা। এলাকাভিত্তিক সমস্যার সমাধান হলেও এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি ভূমি ব্যবস্থাপনার কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে দেশে খাদ্য সুরক্ষার জন্য ভূমি লবণাক্তকরণ সমস্যার মোকাবেলা করা অতীব জরুরি।

