কাজী তারিক আহম্মদ: নানা পদক্ষেপ, আন্দোলন, সভা-সেমিনারের পরও দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমেনি। প্রতিদিন একাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে, হতাহত হচ্ছে মানুষ।
তুমুল প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে সড়কে মৃত্যু কমিয়ে শৃঙ্খলা ফেরাতে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ পাস করা হয়। ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিতে সে সময় সড়ক ছেড়ে ঘরে ফেরে শিক্ষার্থীরা। আর সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ৬ দফা নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সড়ক পরিবহন আইন ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা কোনোটারই বাস্তবায়ন নেই সড়কে। এখনও সড়কজুড়ে দীর্ঘশ্বাস। প্রতিনিয়তই ঝরছে তাজা প্রাণ।
গত সেপ্টেম্বর মাসে সারাদেশে ৪৫৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৪১০ জন মানুষ মারা গেছেন। একইসঙ্গে আহত হয়েছেন ৬০৯ জন মানুষ।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়াম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার স্বাক্ষরিত সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। বিআরটিএ’র বিভাগীয় অফিসের মাধ্যমে সারাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হয়েছে বলেও জানায়।
এসবের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৮৩টি দুর্ঘটনায় ৮৩ নিহত এবং ৮৭ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৭টি দুর্ঘটনায় ৬৯ নিহত এবং ১৯৯ জন আহত হয়েছেন; রাজশাহী বিভাগে ৭৬টি দুর্ঘটনায় ৬৭ নিহত এবং ৫৬ জন আহত হয়েছেন; খুলনা বিভাগে ৬৬টি দুর্ঘটনায় ৬৬ নিহত এবং ৬২ জন আহত হয়েছেন; বরিশাল বিভাগে ৩০টি দুর্ঘটনায় ২৫ নিহত এবং ৯৫ জন আহত হয়েছেন; সিলেট বিভাগে ২১টি দুর্ঘটনায় ২০ নিহত এবং ৬৪ জন আহত হয়েছেন; রংপুর বিভাগে ৫৮টি দুর্ঘটনায় ৪৭ নিহত এবং ৩৬ জন আহত হয়েছেন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৩টি দুর্ঘটনায় ৩৩ নিহত এবং ১০ জন আহত হয়েছেন।
সেপ্টেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় সংগঠিত মোটরযানের মধ্যে মোটরকার ১৯টি, বাস ৮৪টি, পিকআপ ৩১টি, অটোরিকশা ৪১টি, ট্রাক ১৩৬টি, মোটরসাইকেল ১৫০টি, ব্যাটারিচালিত রিকশা ৫২টি, ইজিবাইক ৭টি, ট্রাক্টর ৭টি, অ্যাম্বুলেন্স ৫টি, ভ্যান ১৫টি, মাইক্রোবাস ১২টি ও অন্যান্য যান ১১৯টিসহ সর্বমোট ৬৭৮টি।
এসবের মধ্যে মোটরকার দুর্ঘটনায় ১২ জন, বাস দুর্ঘটনায় ২৫, পিকআপ ভ্যান দুর্ঘটনায় ১০, অটোরিকশা দুর্ঘটনায় ৩৬, ট্রাক দুর্ঘটনায় ৩৪, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৩০, ব্যাটারিচালিত রিকশা দুর্ঘটনায় ২৬, ইজিবাইক দুর্ঘটনায় ২০, ট্রাক্টর দুর্ঘটনায় ৩, অ্যাম্বুলেন্স দুর্ঘটনায় ২, ভ্যান দুর্ঘটনায় ৬, মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় ৩ ও অন্যান্য যান দুর্ঘটনায় ১০৩ জনসহ সর্বমোট ৪১০ জন নিহত হয়।
সড়কে মৃত্যু, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যেই জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস আজ। কয়েক বছর ধরে প্রতিবছরের ২২ অক্টোবর দেশে এ দিবস পালিত হচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনারোধে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন, যাত্রী কল্যাণ সমিতি, নিরাপদ সড়ক চাই, সেভ দ্য রোড বলছে, সড়ক পরিবহন আইন ও প্রধানমন্ত্রীর সেই ৬ দফা নির্দেশনা এবং গৃহীত ১১১টি সুপারিশের ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়ন হয়নি। এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি-বিআরটিএ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোতে দুর্নীতি কমাতে হবে। নইলে সড়কে মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘ হতেই থাকবে। বাড়বে স্বজনহারাদের কান্না, আহাজারি আর দীর্ঘশ্বাস।
এদিকে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; বেপরোয়া গতি; চালকের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; তরুণ ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি ও গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজিকে দায়ী করেছে বেসরকারি সংগঠনগুলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক গাইডলাইন প্রস্তুতকরণ, রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ও বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ না করলে সড়কে মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিনই যোগ হবে নতুন নতুন নাম। তারা বলছেন, সড়ক ব্যবস্থাপনায় সরকারি কর্তৃপক্ষ রয়েছে। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দায় নিচ্ছে না কেউ। কোনো না কোনো কর্তৃপক্ষকে বা সরকারকে এই দায়িত্ব নিতে হবে। কমাতে হবে দুর্নীতি। তাহলেই শৃঙ্খলা ফিরতে পারে সড়কে।
দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা এই প্রথম আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। ২০১৮ সালে আইন হওয়ার পর দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের এই প্রথম আর্থিক সহায়তা দিল সরকার।
গত ১৯ অক্টোবর রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সড়ক ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজনের হাতে চেক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ কার্যক্রমের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৩৬ জনের পরিবার ও আহত ২৫ জনকে ক্ষতিপূরণের অর্থ দেওয়া হচ্ছে।
এখন থেকে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ধারাবাহিকভাবে তদন্ত করে ক্ষতিপূরণের অর্থ দেবে বিআরটিএ।
বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, ক্ষতিপূরণ পেয়েছে- এমন আবেদনকারীর মধ্যে আছে চট্টগ্রামের মাসুদুর আলমের (১৭) পরিবার। ২৫ এপ্রিল মানিকছড়িতে সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। সেদিন ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বড় বোনের বাড়িতে যাচ্ছিল সে।
তবে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম সড়কের মানিকছড়িতে এক অটোরিকশা ও মাহেন্দ্রর মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারায় সে।
ক্ষতিপূরণ পেয়েছে মোনতাহা আখতারের (১৮) পরিবার। চলতি বছর ঈদুল ফিতরের পর ২৫ এপ্রিল মানিকছড়িতে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। মে মাসে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করে তার পরিবার।
বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, ১১ অক্টোবর পর্যন্ত আবেদন পড়ে ৪২০টি। প্রতিদিনই ১০ থেকে ২০টি আবেদন জমা হচ্ছে। যারা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন তারা আবেদন করলে এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করবে একটি কমিটি।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেলে বিধিমালা অনুযায়ী ভুক্তভোগীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। আর দুর্ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গহানি হলে ভুক্তভোগী তিন লাখ টাকা সহায়তা পাবেন।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হিসাব প্রকাশ করে। সংগঠনটির গত চার বছরের দুর্ঘটনার হিসাব অনুসারে, ২০১৯ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজার ২১১ জন। পরের বছর সংখ্যাটি বেড়ে হয় ৫ হাজার ৪৩১। ২০২১ সালে সড়কে নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন। সর্বশেষ ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সড়কে মৃত্যু হয়েছে ৬ হাজার ৫৪৮ জনের। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে সর্বোচ্চ ৭৩৯ জন নিহত হন।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতিও। তাদের প্রতিবেদনেও সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে গত বছর সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। তাদের হিসাবে, ২০২১ সালের চেয়ে বিদায়ী ২০২২ সালে সড়কে দুর্ঘটনা ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ আর মৃত্যু বেড়েছে ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেল, ‘পলিটিশিয়ানরা যতদিনে স্মার্ট না হবে, তাদের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনারোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা যতদিন না আসে ততদিনে এই মৃত্যু, সড়কে এই নৈরাজ্য থামবে না।’ বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব নিতে হবে। বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কিছুদিন আইনের কথা বলেন তারা, পরে এর বাস্তবায়ন ঘটে না।’
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের এক সহকারী অধ্যাপকের কাছে সড়ক দুর্ঘটনারোধে সড়কে সেইফটি ইন্সপেকশন, আনফিট গাড়ি চলতে না দেওয়া, স্পিড লিমিট গাইডলাইন প্রস্তুত, সড়কে বিভিন্ন ধরনের মার্কিং ও সাইন লাগানো, ঢাকায় গাড়ি ৩০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে না চলা, বেতনভুক্ত চালক নিয়োগ, চালকদের নিয়োগপত্র প্রদান, আনফিট গাড়ি রাস্তা থেকে তুলে দিতে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালুসহ দুর্ঘটনারোধে যে ১১১টি সুপারিশ ২০১৮ সালে নেওয়া হয়েছিল তা বাস্তায়নের কথা জানান।
২০১৮ সালের আগস্ট মাসের শুরুতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে যে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ তৈরি হয়েছিল তারপরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। সে বিক্ষোভ শান্ত করতে সরকারের দিক থেকে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ‘গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট’-এর সভায় সড়কে শৃঙ্খলা আনার জন্য ১১১ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়।
দুর্ঘটনাগুলো আমাদের হাতেই তৈরি। তাই এগুলোকে দুর্ঘটনা বলা যায় না। এটা ক্র্যাশ। চালক প্রশিক্ষিত ও দক্ষ না হলে দুর্ঘটনা আরও বাড়বে। চালকদের দক্ষ বানাতে হবে। শুধু দক্ষই নয়, চালকদের নিরাপদও বানাতে হবে। যেন যে কোনো পরিস্থিতি তারা সামাল দিতে পারেন। দেশে নিরাপদ চালক তৈরি করা খুব জরুরি। পরিশেষে বলতেই হয় কবে হবে নিরাপদ সড়ক। লেখক- সাংবাদিক ও কলামিস্ট।